একদিন একটা ছোট ছেলে তার স্কুলের ব্যাগ বগলে নিয়ে দোকানে ঢুকল। দোকানটিতে সংসারের খাদ্যদ্রব্যই বিক্রি হয়।
দোকানে তখন বেশ ভিড়। সে দোকানের মাঝামাঝি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দেখতে লাগল। আর নানা রকম আওয়াজ তার কানে আসতে লাগলঃ
-এই যে, মাংসটা নিন-হেরিং মাছ পাবেন সামনের কাউন্টারে কেউ যদি চর্বি না চান, তাহলে তো মুশকিল ইত্যাদি সব কথা।
খানিক পরে ছেলেটা সামনের একটা কাউন্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কাউন্টারের কাচের ভেতর দিয়ে দেখল সেলসম্যান বা দোকানি লোকটা আস্তিন গুটিয়ে কাজে খুব ব্যস্ত। ছেলেটা একদৃষ্টে দেখতে লাগল দোকানিকে। দোকানিটা বেশ চটপট সসেজ ওজন করে খদ্দেরকে দিচ্ছে।
দোকানি হঠাৎ দেখল একটা ছেলে তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। তাকে ডেকে বলল, কী চাই, খোকা?-খদ্দেরদের বলল, একটু সরে গিয়ে বাচ্চাটাকে আসতে দিন তো।
ছেলেটা তার খাতা দেখে বলল, পিটারকে বলা হলো ১০০ গ্রাম সসেজ আনতে ২ রুবল ২০ কোপেক কিলো হিসাবে।
দোকানি শুনেই একটা কাগজে লিখে নিল, ১০০ গ্রাম সসেজ।
-আর কী চাই, খোকা?
-দেড় শ গ্রাম মাখন ৩ রুবল ৬০ কোপেক হিসাবে। ছেলেটা তার খাতা দেখে বলল আবার।
দোকানি বলল, হ্যাঁ, লিখে নিই। ১০০ গ্রাম মাখনের দাম ৩৬ কোপেক, কাজেই আর পঞ্চাশের দাম হচ্ছে ১৮ কোপেক, মোট হচ্ছে ৫৪ কোপেক। আর?
-আর ২০০ গ্রাম মাংস ৩ রুবল ৭০ কোপেক কিলো হিসাবে। তা ছাড়া সাতটা লেবু ২৫ কোপেক করে।
-বেশ, ২০০ গ্রাম মাংস, সাতটা লেবু। আর?
-আর কিছু নয়। তাহলে পিটারকে কত দিতে হবে?
-বলছি, দাঁড়াও-দোকানি কাগজের ফর্দে যোগ দিয়ে বলল, মোট হচ্ছে ৪ রুবল ১৬ কোপেক। জিনিসগুলো ওজন করে দেব?
-না না। আমি শুধু হিসাবটা জানতে চাইছিলাম। ছেলেটা দিব্যি সরলভাবেই বলল কথাটাঃ মানে, ব্যাপারটা কী জানো, স্কুলে অঙ্কটা দিয়েছে, বেশ শক্ত অঙ্ক। তাই না?
ছেলেটা হিসাবের যোগফলটা তার খাতায় লিখে নিয়ে চলে গেল।
এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই এক মহিলা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন ওই দোকানে। গায়ে কমলা রঙের স্কার্ফ, মাথায় ওড়না আর শক্ত হাতে ধরা সেই ছেলেটা।
-কোথায় সেই লোক? মহিলা চেঁচিয়ে বলতে বলতে খদ্দেরের ভিড় ঠেলেঠুলে ঢুকতে লাগলেন, কোথায়, তাকে দেখা।
-ওই যে, কাউন্টারে। ছেলেটা ভয়ে ভয়ে দেখিয়ে দিল মাকে।
মহিলা কনুইয়ের গুঁতা মেরে মেরে সেই দোকানির কাউন্টারের সামনে হাজির হলেন। বললেন, ওহে, তোমাদের কমপ্লেন বইটা দাও। একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে ইয়ার্কি করার মজা বুঝিয়ে দেব তোমাকে।
-কেন, কী হয়েছে, ম্যাডাম? দোকানি অবাক হলো! আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
-আমাকে চেনার দরকার নেই। বলি, এই ছেলেটাকে চেনো?-ছেলেটাকে ঠেলে এগিয়ে দিলেন মহিলা। ছেলেটা স্কুলের অঙ্কের খাতায় একটা গোল্লা পেয়েছে, জানো? এই স্টেপান, দেখা তোর খাতাটা। বলেই মহিলা খাতাটা ছিনিয়ে নিয়ে দোকানির নাকের সামনে ধরলেন, দেখলে, দেখলে ভালো করে?
দোকানি হকচকিয়ে বলল, দেখলাম তো। তা আমি কী করেছি?
-তার মানে? তুমিই তো করেছ। মহিলা বললেন, তুমিই তো হিসাব করে বলেছ ৪ রুবল ১৬ কোপেক। কিন্তু অঙ্কটা কষে দেখো তো-হবে ৩ রুবল ২৫ কোপেক।
এতক্ষণে দোকানি ব্যাপারটা বুঝল।
ঝাঁঝ দেখিয়ে বলল, আপনার ছেলের স্কুলের অঙ্ক দিয়ে আমি কী করব, ম্যাডাম? আমি দোকানের জিনিসের বর্তমান দর হিসাবেই যা লাগবে তা-ই বলেছি। এটা দোকান, ম্যাডাম, স্কুল নয়।
নাউম ল্যাবকোভস্কি
অনুবাদঃ কুমারেশ ঘোষ
নাউম লাবকোভস্কিঃ রাশিয়ান রস সাহিত্যিক। চার খণ্ডে প্রকাশিত রঙ্গ-ব্যঙ্গ গল্পগুচ্ছ, কয়েক শ চলতি ব্যঙ্গরচনা এবং বিদেশি সরস ভ্রমণকাহিনীর লেখক হিসেবে তিনি পরিচিত। জন্ম ১৯০৮ সালে। সাহিত্যে প্রথম আবির্ভাব ১৯২৭ সালে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৮
Leave a Reply