খবরের কাগজে দেশ সম্পর্কে নতুন কোনো খবর বের হলে একদল লোক বেশ তারিয়ে তারিয়ে তা পড়ে এবং তার ইঞ্চি ইঞ্চি বিশ্লেষণ করে তবেই ছাড়ে। এক সহকর্মী আমাকে খবরের কাগজের একটা খবর আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, পড়ে দেখুন। আমি বরাবরের মতো অনাগ্রহ নিয়ে তাকাই। বলি, এসব গা সওয়া বিষয়, বাদ দেন। তিনি ছাড়েন না-না না, আপনি বুঝতে পারছেন না, কত লোকের সর্বনাশ হয়ে গেছে এত দিনের আশ্বাসের আশায়। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বললেন-শোনেন, একজনের ঘটনা বলি।
প্রত্যেক এলাকাতেই এক ধরনের লোক থাকে, যারা চায়ের দোকানে আসর গরম করা লেকচার ঝাড়তে ওস্তাদ। আমাদের পাড়ার হাশেম সাহেব সে রকমই একজন গুণধর লোক। দেশের যেকোনো পরিস্থিতিতে তাঁর একটা বয়ান পাওয়া যাবে অবধারিত। তিনি আমাদের পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছুটির দিনে ঘণ্টাখানেক লোক জমায়েত করে রাখতেন অনায়াসে। ইদানীং সবাই কেমন যেন ছাড়া ছাড়া হয়ে গেছে। লোকজন তেমন আর মোড়ে দাঁড়িয়ে ছুটির সকালে আড্ডা দেয় না। সবারই নিজস্ব জগৎ এত বেশি যে অন্যকে সময় দেওয়া ভার। তবুও একেবারে যে হয় না, তা তো না। মোড়ে না হোক, বিকেলে চায়ের দোকানে খানিকটা হলেও জমে যায়। কিংবা ছেলেমেয়েকে স্কুল থেকে আনতে বা দিতে গিয়েও আলোচনার তুফান বয়ে যায় এখনো।
তো, এবারের পট পরিবর্তনের পর হাশেম সাহেব হাসিমুখে নানা জায়গায় নানা রকম মতামত প্রকাশ করতে লাগলেন-এবারে বাছাধনেরা বুঝবে, কত ধানে কত চাল।
আবার হয়তো বলে বসলেন-এখন বোঝো, লগি মেরে নৌকা কত দূর নেওয়া যায়।
তার চেয়ে উৎফুল্ল দেখা গেল, যখন রাঘববোয়ালেরা সব গ্রেপ্তার হতে লাগল। একজন করে লাল দালানে যায় আর তিনি লাফিয়ে ওঠেন-এইবার বুঝেছে বাছাধনেরা, বাপেরও বাপ আছে। সবচেয়ে বেশি লাফিয়ে উঠলেন, আমাদের এলাকা যার পেশিবহুল হাতের নির্দেশে চলাফেরা করত সে যখন গ্রেপ্তার হলো। হাশেম সাহেব বহুদিন পর রাস্তার মোড়ে ছুটির দিনের আমেজে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন-বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান! এইবার যাবে কোথায়! তোমার ওস্তাদও চৌদ্দ শিকের ভেতরে, কে তোমায় বাঁচাবে এবার?
এভাবে আরও কিছুদিন গেল। বেশ কিছু বাড়িঘর ভাঙাচোরা হলো, আবার তার দ্বিগুণ হারে তৈরি হতেও দেরি হলো না। ক্রমে সবাই চোরকুঠুরি থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। শুধু তা-ই না, যাদের নামে অভিযোগের ফিরিস্তিতে খবরের কাগজের পাতা ভরে যাচ্ছিল, তারাও হাসতে হাসতে বের হয়ে আসতে লাগল। বুক আগের চেয়ে আরও ইঞ্চি দুয়েক বেশি ফুলিয়ে ফুলের মালা গলায় দিয়ে আমাদের মতো গিনিপিগদের উদ্দেশে হাত নাড়ছে। আর আমরা খাবি খেতে খেতে পুরোনো অভ্যেসগুলো রপ্ত করার চেষ্টায় আছি। কিন্তু হাশেম সাহেব! তাঁর অবস্থা কাহিল। সবে সেদিন সেই পেশিবহুল হাতের ওস্তাদ চৌদ্দ শিক থেকে বের হয়ে এসেছেন। দু-একজন পেশিবহুল লোকও বের হয়ে আসছে। আর কিছুদিনের মধ্যে হয়তো আমাদের এলাকার পেশিও বের হয়ে আসবে। আর সেই কথা চিন্তা করে হাশেম সাহেব শুকিয়ে কাঠি হয়ে যাচ্ছেন। এখন তাঁর অবস্থা গ্রিক দেবতা অ্যারিস্টিউসের ছেলে বিখ্যাত শিকারি অ্যাকটিয়নের মতো। শিকারে বের হয়ে দেবী আর্টেমিসের শাপে যে নিজেই শিকারে পরিণত হয়েছিল।
সেদিন শুনলাম, তিনি নাকি এই এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার চেষ্টায় আছেন। বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় হাশেম সাহেবের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, বিষয় কি, আপনি নাকি এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?
মুখটা আমসি করে উত্তর দিলেন, কী ভুল যে করেছি! তালে পড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কত কথা বলেছি। এখন থাকি কোন ভরসায়। বের হয়েই তো আমাকে ধরে বসতে পারে।
বললাম, কিন্তু ওদের হাত তো অনেক লম্বা, পালিয়ে কোথায় যাবেন?
চেহারার ওপর আরেক দফা কালির পোঁচ পড়ল, তাহলে কী করি, বলেন তো?
হঠাৎ করে একটা কার্টুনের কথা মনে পড়ে গেল। এক বিছানার মশারি শতচ্ছিন্ন। মশারা ছিদ্রপথে শিকারের আশায় দলে দলে ভেতরে ঢুকেছে, আর বিছানার মালিক দিব্যি মশারির বাইরে এসে নিশ্চিন্তে ঘুম দিয়েছে। সেই আলোকে হাশেম সাহেবকে বুদ্ধি দিলাম, এক কাজ করেন, কর্তৃপক্ষকে একটা দরখাস্ত দেন। তারা যেন আপনাকেই চৌদ্দ শিকের ভেতর ভর্তি করে নেয়। কিছুদিনের মধ্যে সেটাই বোধহয় সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হয়ে যাবে।
সাজ্জাদ কবীর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৮
Leave a Reply