দেওয়ানির দুঃখ কেবল একটাই, তিনি একদম ক অক্ষর গো-মাংস। সুধীজন সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলে বসেন, ‘ডিগ্রি কলেজকে আমি ইন্টারমিডিয়েটে উন্নীত করব।’ এ নিয়ে দশ গ্রামের মানুষের হাসাহাসির অন্ত নেই। আড়ালে-আবডালে লোকে তাঁকে বলে, ‘মূর্খ দেওয়ানি।’ মনের দুঃখে দেওয়ানি সাহেব ঠিক করলেন একমাত্র ছেলেকে তিনি যেকোনোভাবেই হোক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। ভর্তি হওয়ার পর দেওয়ানি সাত গ্রামের মানুষ ডেকে জেয়াফত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। এরপর দেওয়ানিকে আর পায় কে। ‘মোর ব্যাটা বিশ্ববিদ্যালয়োত ভর্তি হইছে, মূর্খ কাকে কয় সেইটাই এবার দেখাইম।’ বিভিন্ন সভামঞ্চে এভাবেই বক্তৃতা দিয়ে চলেন দেওয়ানি। ছেলের পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করতে করতে তাঁর যে ত্রাহি অবস্থা হয়ে উঠেছে, সেদিকে তাঁর নজর নেই। আজ এটা বিক্রি করেন তো কাল অন্যটা। এমন করে বিক্রি করতে করতে অবশিষ্ট থাকে শুধু ভিটেবাড়ি। তো শেষমেশ ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছে। বাবার আনন্দের যেন শেষ নেই। বাড়িতে ফিরেছে ছেলে। ছেলের আগমন উপলক্ষে বিরাট সভা বসেছে। সভায় বক্তৃতা দিতে উঠল ছেলে। গ্রামবাসীর উদ্দেশে বলল, ‘আমি এমকম পাস করিয়া বাবার কাছোত আসছি। আপনাদের গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করছি।’ ছেলের কথা শেষ হতে না হতেই বাবা চিৎকার করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। একপর্যায়ে একদম মাটিতে গড়াগড়ি।
গ্রামবাসী কান্না থামাতে বলছে, কী হলো দেওয়ানি সাহেব, কী হলো। এ সময় তিনি বলেন, ‘চুপ করেন তো তোমরাগুলা বাহে…।’ এ অবস্থায় গ্রামবাসী বলাবলি করে, ‘ওনাক জিন ধরেছে, ভূতে ধরেছে। জিন-ভূত ছাড়াতে কবিরাজ ডাকতে হবে।’ কবিরাজ ডাকতে গ্রামের মানুষ ছুটে চলে। দড়ি দিয়ে দেওয়ানিকে একটি গাছের সঙ্গে দুই হাত বেঁধে রাখা হলো। শীতের দিন। বেশ শীত পড়েছে। কবিরাজ এসে হুঙ্কার দিতেই দেওয়ানির মুখে খই ফোটে, ‘মোর একনা ব্যাটার জন্য জমি বেচানু, (বেচলাম) ধান বেচানু। বেচে বেচেয়া শোগ (সব) শেষ করি ফেলানু (ফেললাম)। আর ব্যাটা কি না মোর ‘বেশি’ ‘বেশি’ পাস না করিয়া ‘কম’ পাস করি আইসে(আসল)। এইগলা দুঃখের কথা এলা মুই (আমি) কোন্টে (কোথায়) শোনাও (শোনাব) বাহে।
আরিফুল হক রুজু, রংপুর
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮
Leave a Reply