সেবার ঈদ ঘনিয়ে আসতেই আমার অতিব্যস্ত কাকা গরুর বাজারের হালহকিকত নিয়ে ব্যাপক ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বৈধ হোক আর অবৈধ হোক, টাকা-পয়সার অভাব তাঁর কোনোকালেও ছিল না। তাই বরাবরই পাড়ার সেরা গরুটা তাঁর বাড়ির সামনে বাঁধা থাকত। কিন্তু গতবার তাঁর শোচনীয় পরাজয় ঘটে পাড়ার জগলুল মিয়ার কাছে। জগলুল মিয়ার গরুর তুলনায় পাক্কা এক ইঞ্চি উচ্চতায় ও দুই ইঞ্চি প্রস্থে কম ছিল কাকার গরুটা। এবার তাই কাকা আদাজল খেয়ে নেমেছেন তাঁর সেই অপমানের শোধ তুলতে। তা ছাড়া কাকার গরুটা নিয়ে নিন্দুকেরা নানা কথা ছড়াচ্ছিল-সেবার গরুটার নাকি একটা চোখ ট্যারা, আর দাঁতের মধ্যে কয়েকটা বাঁধানো দাঁতও নাকি ছিল। কাকার ধারণা, বদমাশ জগলুল মিয়াই এসব নিন্দুকের নিন্দার বন্দুকে রসদ জোগাচ্ছে।
তাই এবার এক হাত দেখে নিতে কাকা হাত খুলে খরচ করা শুরু করলেন। কোরবানির বাজারে আগেই কয়েকজন স্পাই নিয়োগ দিয়ে বসলেন; যারা প্রতি ঘণ্টায় বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজারের আপডেটেড নিউজ জানাচ্ছিল কাকাকে। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। স্পাইরা নতুন আসা গরুদের দৈর্ঘø-প্রস্থ মেপে রিপোর্ট করতেই কাকা একে একে নাকচ করতে থাকেন। নাহ্, ওতে চলবে না, আরও বড় সাইজের নিশ্চয়ই হাজির হবে দুই দিন পর।
এভাবে ঈদের সপ্তাহখানেক বাকি থাকতে শোনা গেল জগলুল মিয়া একটি গরু কিনে ফেলেছে। তা সেটাকে গরু না বলে শুঁড় ছাড়া আর শিংওয়ালা হাতি বললেই বোধ হয় মানানসই হয়। ‘হাম্বা’ করে ডাক দিলে পাড়ার বিল্ডিংগুলোর সব জানালা ঝনঝন করে ওঠে। চারজন জওয়ান লোক রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যায় ওটাকে শান্ত রাখতে।
দেখেশুনে তো কাকার মাথায় হাত! তাঁর বাকি সম্মানটুকুও দেখি পাংচার হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার দশা। রেগেমেগে তিনি তাঁর নিয়োজিত স্পাইদের সেই দণ্ডেই বরখাস্ত করলেন, সবাইকে একসঙ্গে। ‘নিমক হারামের দল, এত দিন দানাপানি খাইয়ে রাখলাম, আর শেষমেশ চোখের সামনে দিয়ে বড় গরুটা ওই ব্যাটা নিয়ে নিল।’ কাকা ফোঁস ফোঁস করতে থাকেন।
সেই দণ্ডে আমি ভয়ে ভয়ে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসি কাকাকে। টিভিতে কোরবানির হাটের নিউজ দেখে দেখে আমিও বাজারের আপডেটেড নিউজটা জানতাম। বললাম, ‘কাকা, না হয় একটা উটই কিনে ফেলেন, সঙ্গে একটা ছাগল ফ্রি দিচ্ছে।’
শুনে কাকা প্রথমে ধমকান, পরে থমকান এবং সবশেষে চমকান। তাঁর মুখে যেন ১০০ ওয়াটের ফুল রেঞ্জের বাতি জ্বলে ওঠে।
‘ভালো বলেছিস তো মন্টু। উটের গুরুত্ব তো গরুর গরুত্বকেও হার মানায়। তা ছাড়া গলা লম্বা করে দাঁড়ালে কতটা লম্বাও হয় তা ভেবেছিস মন্টু, সে তুলনায় ওর গরুটা তো নেহাত···নেহাত···।’ কাকা ভাষা খুঁজে পান না, ‘মানে নেহাত গরু।’ কাকা থামেন। কিন্তু পা আর থেমে থাকে না। শেষ দণ্ডে কোরবানির পশুর হাটে রওনা হয়ে যান আমাকে সঙ্গে করে। হাটে গিয়েই আমরা আস্ত এক অ্যারাবিয়ান উটের অর্ডার দিয়ে আসি। তিন দিন আগে অর্ডার দিলেই তবে পাওয়া যায়। দাম যদিও খানিকটা বেশিই পড়ল। কিন্তু দামের সঙ্গে কাকার হাসির জেল্লাও বাড়তে থাকে।
বাড়ি ফিরেই কাকা বহু লোক লাগিয়ে দেন উটের থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে। বাড়ির সামনের গ্যারেজটা বালি দিয়ে উঁচু করে বেড তৈরি করেন, আর সেখানে যাতে সূর্যের আলো ঠিকভাবে পড়ে তার জন্য গ্যারেজের চালটালও খুলে ফেলেন। দুই দিন পর ফ্রি খাসিসহ হাজির হয় লম্বা গ্রীবার উট। দেখে আমাদের উৎসাহ তো আর ধরে না;
যদিও নিন্দুকে এবারও ছড়াতে থাকে-এ নির্ঘাত রাজস্থানি উট, মোটেও অ্যারাবিয়ান নয়। কিন্তু তাতেও কাকার বিশেষ গায়ে লাগল না। ‘নাহ্, এবার সত্যি সত্যিই জগলুল মিয়াকে হেনস্তা করা গেছে।’ কাকার আত্মতৃপ্তি থামে না; কিন্তু ঝামেলাটা বাধল ঈদের আগের দিন। গ্যারেজে গিয়ে দেখি কাকা, চাচাতো ভাই ঝন্টু আর বোন বিনুকে নিয়ে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে উটটাকে দেখছেন। ঝন্টু মাথা নেড়ে নেড়ে কাকাকে যেন কী বোঝাচ্ছে, ওর এত মায়াময় কণ্ঠ আগে শুনেছি বলে মনে পড়ল না। কাছে গিয়ে আমিও কিছুটা শুনি। যা বুঝলাম তা হলো, ঝন্টু শুধু পাড়ার ছোট ছেলেদের পটিয়ে নানা ফাইফরমাশ খাটায় তাই-ই নয়, বরং কাকার মতো রাশভারী লোককেও পটাতে ওস্তাদ। ও বোঝাচ্ছে, ‘দেখেন আব্বা, এই উটটা সুদূর মরুর দেশ থেকে এই বঙ্গভূমে এসেছে, কত বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে বন্ধুর খোঁজেই হয়তো, অথচ আমরা এটাকে এ দেশের হাওয়া-জলে আর কিছুদিন না চরিয়ে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি-কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?’ সঙ্গে সঙ্গে ঝন্টুর বোন বিনুর সীমাহীন সমর্থনে আমার কাকাও যে গলছে এর অন্যতম কারণ বোধ হয় তাঁরও এই তিন দিনে উটটার প্রতি ব্যাপক মায়া পড়ে গেছে। তাঁর চোখ দেখি ঝন্টুর বক্তব্যে অশ্রুসিক্ত।
আমি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে উটের মাংস চাখার এমন সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে সেই আশঙ্কায় বলে উঠি, ‘কাকা, যত মায়া পড়বে ততই ভালো।’
কিন্তু আমার এ বক্তব্য ঝন্টু-বিনুর কলকাকলিতে ঢাকা পড়ে যায়। তাই শেষমেশ উটটি পোষার জন্যই কাকা রেখে দিলেন।
সেবারও তাই জগলুল মিয়ার কাছে আমাদের এক রকম হারই হলো। উটের সঙ্গে ফ্রি পাওয়া প্রমাণ সাইজের ছাগলটা দিয়েই ঈদের আনন্দ উদ্যাপিত হলো-আর সে আনন্দে উটটাও যে যোগ দিয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০১, ২০০৮
Leave a Reply