দাঁড়িয়ে না থেকে আসুন বসি
মেহেদী আল মাহমুদ ও তাওহিদ মিলটন
খালেদাঃ আরে, হাসিনা আপা যে! কেমন আছেন?
হাসিনাঃ আল্লাহ, এ যে দেখি খালেদা ভাবি! আমি ভালো। ভাবি, আপনি কেমন আছেন?
খালেদাঃ আর ভালো থাকি কেমনে, আমাদের রাখল সাব-জেলে! সেই দুঃখে-অপমানে মনে হয়, বাকি জীবনটাই খারাপ যাবে। কত ছোট নেতা-পাতি নেতার পূর্ণাঙ্গ সেলে জায়গা হলো, আর আমাদের জায়গা হলো সাব-জেলে! এর পরও আপা, আপনি ভালো থাকেন কীভাবে!
হাসিনাঃ ভাবি, ওই কথাটা মনে করায়া দিয়েন না, বুকটা হাহাকার করে।
খালেদাঃ ইচ্ছা ছিল, এরশাদ সাহেবের লাগানো বরইগাছ থেকে লবণ-মরিচ দিয়ে কয়েকটা বরই খাব। আহা রে! জেলে এমন একটা বরইগাছ লাগানোর আমারও কত দিনের শখ! আমরা না পারি, আমাদের যোগ্য বংশধরেরা তো ছিল। তারা একদিন নিশ্চয় সেই বরই খেতে পারত।
হাসিনাঃ ভাবি, আপনি দেখি এখনো দেশি বরইয়ের কথা বলছেন! আরে এখন আপেলকুল না কী সব হাইব্রিড বরই বের হয়েছে না! এক বছরেই বাম্পার ফলনসহ বরই ধরে। খুব নাকি মিষ্টি।
খালেদাঃ বলেন কী! তাই নাকি! ইস্, কত বড় সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেল।
হাসিনাঃ বাদ দেন ওই সব। পুরানা কথা বলে আর কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ! তা ভাবি, জেলে আপনার খাবার আসত কেমনে?
খালেদাঃ আমার জন্য তো টিফিন ক্যারিয়ারে করেই কোত্থেকে যেন খাবার রেঁধে নিয়ে আসত।
হাসিনাঃ কোত্থেকে নয়। ওরা একচুলায় খাবার রেঁধে দুই টিফিন ক্যারিয়ারে করে আমাদের জন্য নিয়ে আসত। জেল থেকেই ওরা আমাদের একত্র করার পরিকল্পনা করছে, বুঝলেন?
খালেদাঃ এত কষ্ট না করে আমাদের এক কক্ষেই রাখলে পারত। আমরা কি বলেছি আমরা আলোচনা করতে চাই না?
হাসিনাঃ ঠিক, তাহলেই বোঝেন এক বছর টানা আলোচনা করার সুযোগটা পেলে দেশের জন্য কত কিছুই ভাবতে পারতাম। সাধে কি আর বলছি, দেশ ও জাতির বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে।
খালেদাঃ তা আপা, আপনি নির্বাচনে যাওয়ার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠলেন কেন? দু-চার দিন সবুর-টবুর করলে কী এমন ক্ষতি হয়! মনে হচ্ছে পারফরমেন্স খুবই ভালো যাচ্ছে আপনার? আমরা চার দল মিলে চারটা দফা দিলাম আর আপনি চৌদ্দ দল মিলে একটা দফাও দিতে পারলেন না!
হাসিনাঃ কী যে বলেন না ভাবি! এই বয়সে আবার পারফরমেন্স! আর কদিনই বা বাঁচব। তাই দফাটফা আর দিতে চাই না। এ ছাড়া শীত আসার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে চাইছি। শীতে বাইরে বেশি ঘোরাঘুরি সহ্য হয় না।
খালেদাঃ শীতে আমারও সহ্য হয় না। কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে এখনো কাপড়চোপড়ই তো ঠিকমতো কেনা হয় নাই। নির্বাচন করব কি, কয়টা ভালো শাড়ির অর্ডার দিছি বাইরে। ওগুলো এলেই নির্বাচনে নেমে যাব ইনশাআল্লাহ। দফা দিবেন না ক্যান? মূল রহস্যটা কী, কোনো গ্রিন সিগনাল পাইছেন?
হাসিনাঃ না, সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখছি। দেশ নিয়া আর এভাবে ছেলেখেলা খেলতে মন চাইছে না। ক্ষমতা কয় দিনের। হয় আপনি থাকবেন, নাহয়আমি। কিন্তু দেশ তো আমাদের এই একটাই।
খালেদাঃ আমিও তো ইদানীং প্রায়ই স্বপ্নে দেখি। অনেক ভালো ভালো স্বপ্ন। আমারও মাঝেমধ্যে সত্যি সত্যি দেশ নিয়া কিছু একটা করার জন্য মনটা আকুপাকু করে ওঠে। আসেন, আমরা দুজন মিলে এবার দেশটাকে বদলে ফেলি।
হাসিনাঃ তার আগে বলেন, জামায়াত কি এবারও আপনাদের সঙ্গেই থাকবে?
খালেদাঃ আর বইলেন না আপা, এমন শক্ত আঠা জীবনে দেখি নাই। সত্যি কথা বলতে আপা, ওরা কিন্তু মাঠে ভালোই খেলে। ২০০১-এর নির্বাচনে ওরা আমাদের হয়ে না খেললে তো আপনারাই কাপ নিয়া যাইতেন।
হাসিনাঃ আসেন আমরা আর কাপের চিন্তা না করে দেশটাকে নিয়া চিন্তা করি।
খালেদাঃ একাত্তরে তো আপা আমরা-আপনারা কেউ আলাদা ছিলাম না। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ডাক দিল, আপনার ভাই বঙ্গবন্ধুর হয়ে ঘোষণাপত্র পাঠ করল, দেশটা কী সুন্দর নয় মাসেই স্বাধীন হয়ে গেল। কিন্তু এখন কী হইতে কী হয়ে গেল। কেমন করে যে জামায়াত আমাদের সঙ্গে মিশে গেল!
হাসিনাঃ জামায়াত মেশে নাই। আমরাই জামায়াতের সঙ্গে মিশে গেছি। এখন কাঁধ থেকে ওই ভূত নামাইতে হবে।
খালেদাঃ আসেন আমরা দুজনই ওদের বয়কট করি, আমরা বয়কট করলে ওরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। না হলে কিন্তু ওরাই একদিন আমাদের দুজনকে নাকানি-চুবানি খাওয়াবে।
হাসিনাঃ ঠিকই বলছেন। ক্ষমতার লোভে পড়ে আমরা নিজেদের পায়েই কুড়াল মারছি। আর দেখছেন
ভাবি, আমেরিকার মতো একটা দেশে পরিবর্তনের ঢেউ লাগছে?
খালেদাঃ দেখছি। বারাক ওবামার ্লোগানটা কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছে।
হাসিনাঃ আমারও খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে দেশে এবার সত্যি সত্যি একটা বদল দরকার। আর সেটা শুরু করতে হবে আমাদের দুজনকেই, এখনই তার শ্রেষ্ঠ সময়।
খালেদাঃ এটা আপা সত্যি বলছেন। এ জন্য প্রয়োজনে আমি আমার ঘর থেকেই সংস্কার শুরু করব। এরপর দলের খারাপ লোকগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করব।
হাসিনাঃ আমার দল থেকেও আমি খারাপ লোকগুলোকে বহিষ্কার করব। তাতে আমাদের সংসদ ভালো মানুষে ভরে উঠবে।
খালেদাঃ আহা! কী যে শান্তি লাগছে শুনে। আমরা যদি এমনটা করি তাহলে সত্যি সত্যি দেশটা পাল্টাবে তো!
হাসিনাঃ আমরা আন্তরিক হলে অবশ্যই পাল্টাবে। এ জন্য আগে আমাদের পাল্টাতে হবে। আমরা পাল্টালে শুধু দেশ কেন, দেশের মানুষও পাল্টাবে।
খালেদাঃ আমারও তা-ই মনে হয়, আমরাই এত দিন দেশের জনগণকে নিজেদের স্বার্থের জন্য বন্দী করে রেখেছি।
হাসিনাঃ এভাবে আর নয়। আপনি আমার বাড়িতে আসবেন। আপনাকে নিয়ে ডালভর্তা দিয়ে চারটা ভাত খাব। আর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে লম্বা একটা প্ল্যান করব।
খালেদাঃ অবশ্যই আপা, আপনাকেও কিন্তু একদিন আমার বাড়িতে আসতে হবে, চারটা ডাল-ভাত খেতেই হবে।
হাসিনাঃ দেশটা তো আমাদের সবারই। আমরা দেশটাকে না দেখলে কে দেখবে, বলেন?
খালেদাঃ আজ আমরা শপথ নিলাম, দেশকে মন থেকেই ভালোবাসব।
হাসিনাঃ দেশের সব সমস্যা-জঞ্জাল দূর করব। আসেন ভাবি, সাংবাদিক ভাইদের এই সুসংবাদটা জানিয়ে দেই। এও বলি, দেশের জনগণকে যেন আমাদের পরিবর্তনের কথাটা তারা বেশি ফুলিয়ে না লেখে।
খালেদাঃ ঠিক। এবার কথায় নয়, কাজে পরিচয় দিব।
হাসিনা ও খালেদাঃ আহা! দেশকে মন দিয়ে ভালোবাসলে যে এত আনন্দ, এত সুখ! এখন মরে গেলেও শান্তি পাব। আমরা আর ক্ষমতা চাই না, আমরা দেশের মঙ্গল চাই। আমরা দেশকে ভালোবাসি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৪, ২০০৮
Leave a Reply