সেইন্ট অ্যানার চেনা এক সরাইখানায় যাওয়ার পথেই হাঁটছিল দুজন। তাদের হাঁটার ভঙ্গিই বলছিল তারা স্থানীয়।
চওড়া রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটা লম্বা লোকটাকে বেপরোয়া দেখাচ্ছিল। মাথায় চওড়া কানওয়ালা টুপি। তাতে তার জমানো পাপের মতো নিকষ কালো রঙের রিবন। গায়ে আলখেল্লা, পায়ে রাখালদের জুতা আর আটো পায়জামা। চুল কোঁকড়ানো। জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলছে চোখ। লম্বুর বেশভূষা দেখে দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছিল সে ওই সব লোকের প্রতিনিধি, যারা শিকারে গিয়ে শুধু ঘোড়াকে খাটিয়ে মারে। কিন্তু কোনো শিকার ধরতে পারে না। অকর্মার ধাড়ি!
হাঁটতে হাঁটতে দুজন সরাইখানাটায় ঢুকল। ওদের পিছু পিছু ঢুকে পড়লাম আমিও। ওরা পান করছিল। ওদের নাম অলিভার বালবেসা ও রোনাল্ড পালপেট।
ওরা যেন আমাকে দেখতে না পায় সে জন্য দ্রুত চেয়ারে বসে পড়লাম। ওরা অবশ্য ফিরেও তাকাল না। বুঝি ভাবল, তারা দুজন ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। লম্বু, মানে অলিভার তার সঙ্গীকে বলল, ‘পালপেট, এখন আমরা হাতে ছুরি নিয়ে দুজন দুজনের মুখোমুখি হব। তুমি ওদিকটায় আর আমি এদিকটায়, ঠিক আছে? তার আগে এসো আরেকটু পান করি আর গান গেয়ে নিই।’
রোনাল্ড মেঝেতে থুথু ফেলে বলল, ‘বালবেসা, হয়তো কিছুক্ষণ পর তোমার ছুরির ফলায় আমি মারা যাব, কিন্তু আমি লা গরসার মতো ভীতু নই। চলো, আরেকটু পানীয় হোক। তারপর রক্ত··· রক্তের লড়াই হবে···।’
গ্লাস ঠোকাঠুকি করে ওয়াইন পান করে উঁচু স্বরে গান শুরু করল তারা। শরীর থেকে আলখেল্লা খুলে এদিক-ওদিক ছুড়ে ফেলে খাপ খুলে ছুরি বের করল। নগ্ন ছুরিগুলো আলোয় ঝকমকিয়ে উঠল। এই ছুরি দিয়ে তারা একজন আরেকজনকে আঘাত করবে! ছুরি দেখে মনে হলো, ওগুলো যুদ্ধের চেয়ে চোখের ছানি অপারেশনের জন্য বেশি উপযুক্ত।
দুজন বেশ কয়েকবার ছুরি চালাল। কিন্তু কেউ কাউকে লাগাতে পারল না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিই ঘটছিল।
হঠাৎ পালপেট হাত তুলল। তারপর হাঁসফাঁস করে বলল, ‘বালবেসা, বন্ধু আমার! প্লিজ, আমার মুখে মেরো না। আমি কুৎসিত হতে চাই না।’
‘ঠিক আছে।’
‘পেটেও মেরো না। এইমাত্র যা পান করলাম তা এখনো হজম হয়নি।’
‘ঠিক আছে, ওপরের দিকেই মারব।’
‘আমার বুকের দিকেও একটু খেয়াল করো। ওটা সব সময়ই যে একটু দুর্বল, তুমি তো জানোই।’
‘তাহলে আমাকে বলো, আমি তোমাকে কোথায় আঘাত করব?’
‘আমার বাঁ হাতে একটা টিউমার আছে। সেখান থেকে তুমি ইচ্ছামতো মাংস কেটে নিতে পার।’
‘এখানে ওসব ফাঁকিবাজি চলবে না···’, এ কথা বলেই বালবেসা তীরের মতো ছুটে গেল পালপেটের দিকে। তীব্র যুদ্ধ শুরু হলো আবার। কিন্তু কেউ কারও এক টুকরো চামড়া ছিলতে পারল না। এদিকে সরাইখানার মালিক গায়ের সব শক্তি দিয়ে গিটারে সুর তোলার চেষ্টা করছিল।
ঠিক এ সময় ২০-২২ বছরের একটি মেয়ে সরাইখানায় এল। তাকে দুঃসাহসী আর একই সঙ্গে সুন্দরী বলেই মনে হলো। তার পায়ের মোজা ও জুতা পরিচ্ছন্ন। কোমরে ছোট কালো স্কার্ট বেল্ট দিয়ে বাঁধা। মেয়েটির দিকে চোখ পড়তেই সরাইখানার মালিক গিটার সরিয়ে রাখল।
সরাইখানার মালিককে অগ্রাহ্য করে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেল মেয়েটি। বালবেসা ও পালপেট মেয়েটিকে আসতে দেখে প্রথমে বিরক্ত হলো। কিন্তু পরক্ষণেই ভবিষ্যৎ পুরস্কারের লোভে তারা আক্রমণ আর লাফালাফি বাড়িয়ে দিল। তার পরও কেউ কারও একটা চুলও ছিঁড়তে পারল না।
মেয়েটির নাম ডোনা গরসা। সে নারীসুলভ আনন্দ নিয়ে দৃশ্যটা দেখল। কিছুক্ষণ পর তার ভ্রূ কুঁচকে গেল। সে তার কমনীয় কান থেকে কোনো ফুল বা দুল নয়, একটা সিগারেটের টুকরো বীর যোদ্ধাদের দিকে ছুড়ে মারল। যুদ্ধ থামিয়ে দুজনই গরসার সামনে এসে দাঁড়াল! গরসা দৃঢ়ভাবে বলল, ‘এটা কি আমার জন্য খুব ভালো হচ্ছে?’
বালবেসা ও পালপেট হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘তোমার জন্য কে উপযুক্ত? আমি না হলে, কেউই না···’
‘শোনো! এ ধরনের কোনো চুক্তি বা চাপাচাপিতে আমি বিশ্বাস করি না। অর্থহীন কিছু করি না আমি। তোমরা যদি আমার জন্য যুদ্ধ করে থাক, তাহলে তোমরা ভুল করছ। আমি তোমাদের কাউকেই ভালোবাসি না। জাফরার মিনগালারিওসকে আমি পছন্দ করি। সাহস থাকলে আমার হবু বরের সঙ্গে লাগতে এসো, বিদায়।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যেভাবে সরাইখানায় ঢুকেছিল, সেভাবেই বেরিয়ে গেল সে।
দুই যোদ্ধা তার চলে যাওয়া পথের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। ছুরিতে রক্ত লেগেছে, এমন ভাব করে ছুরি মুছে প্রায় একসঙ্গে যার যার খাপে ভরে ফেলল। একই সঙ্গে দুজনই বলে উঠল, ‘মেয়েদের জন্য পৃথিবী হারিয়ে গেলে বা মেয়েদের জন্য স্পেন হারিয়ে গেলেও কেউ কোনো দিন জানতে পারে না। এর জন্য কোনো কবিতা লেখা হয় না। এমনকি কোনো অন্ধ ভিক্ষুক এটা নিয়ে কোনো গান গায় না। কোনো বাজারে বা জনসভায় এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। অথচ দেখো, দুজন সাহসী মানুষ তাদের প্রেমিকার জন্য একজন আরেকজনকে খুন করতে যাচ্ছিল!’
হাত ধরে কথা বলতে বলতে রাস্তায় নেমে এল দুজন। পৃথিবীতে ওরা একজন আরেকজনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আমাকে ফেলে রেখেই ওরা ওদের পথে চলে গেল।
–সেরাফিন এস্তেবানেস কালদেরন
রূপান্তরঃ শারমীন আফরোজ
সেরাফিন এস্তেবানেস কালদেরনঃ জন্ম-২৭ ডিসেম্বর ১৭৯৯, মৃত্যু-৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৭। স্প্যানিশ কবি ও লেখক। তিনি এল সলিতারিও ছদ্মনামে বেশি পরিচিত ছিলেন। স্পেনের মালাগায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ‘এসসেনাস আন্দালুসাস’ তাঁর সেরা কাজ বলে ধরা হয়।
সূত্রঃ প্রথম আলো, নভেম্বর ১৭, ২০০৮
Leave a Reply