অনেক কাল আগের কথা। হ্যামিলিন শহরের মানুষের মনে কোনো সুখ ছিল না। সুখ থাকবে কী করে, হ্যামিলিনের ফুটফুটে সব শিশু-কিশোরের মনেই যে দুঃখ। সবার দুঃখের একটাই কারণ-শহরের সব গুঁড়োদুধে পাওয়া গেছে ক্ষতিকর মেলামিন। দুধ খাওয়াতে না পেরে তাই সব মা-বাবাই চিন্তিত। অন্যদিকে শিশুরা প্রথমে খুশি হয়ে ভেবেছিল-যাক, বিরক্তিকর দুধ আর খেতে হবে না। কিন্তু কয়েক দিন পরই তারা বুঝতে পারল, ‘দুধ’ খাবার হিসেবে আসলে ততটা খারাপ না! কিন্তু এখন বুঝতে পেরেই বা কী লাভ? মেলামিনের কারণে তো আর দুধ খাওয়া যাবে না। যেসব দুধে মেলামিন আছে, কর্মকর্তারা প্রথমে সেগুলো নিষিদ্ধ না করলেও সবার চাপে এখন মোটামুটি সব দুধই নিষিদ্ধ। ওদিকে দুধ খেতে না পেরে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। ফলে কারও মনে শান্তি নেই।
হ্যামিলিন শহরের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নগরকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেছেন। কিন্তু বৈঠক করে কী হবে? মেলামিন তাড়ানোর কোনো উপায় কেউ বলতে পারল না। সবাই যখন হতাশ, তখন দরজা খুলে ঘরে ঢুকল অদ্ভুত-দর্শন লম্বা এক লোক। তারপর সেলাম ঠুকে বলল, ‘আমি চাইলে হ্যামিলিনের সব দুধ থেকে সব মেলামিন ভ্যানিশ করে দিতে পারি।’
সবাই প্রথমে তাচ্ছিল্য করলেও স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ভাবলেন, যদি সত্যি ও পারে, তাহলে মন্দ কী! তিনি বললেন, ‘কীভাবে?’
‘সেটা আমার ব্যাপার। তবে বিনিময়ে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে।’
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা চমকে উঠলেন। বললেন, ‘বাপু, এটা শায়েস্তা খাঁর আমল পেয়েছ নাকি? তোমাকে বড়জোর ৫০০ টাকা দিতে পারি।’
কিন্তু লোকটি অনড়। তাই সবাই পাঁচ লাখেই রাজি হলো।
লোকটি ঘর থেকে বের হয়ে তার ঝোলা থেকে একটি লম্বা সুন্দর বাঁশি বের করে বাজাতে লাগল। অমনি সবাই অবাক হয়ে দেখল-হ্যামিলিনের সব ফ্যাক্টরি থেকে, এর-ওর বাসা থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো কী সব বের হয়ে এক জায়গায় জড়ো হচ্ছে। সবাই বুঝল, এগুলোই মেলামিন। খালি চোখে দুধের সঙ্গে যে মেশানো তা বোঝা যায় না। মেলামিনের গুঁড়োগুলো লোকটির পেছন পেছন যেতে লাগল। দেখে মনে হচ্ছে কোটি কোটি পিঁপড়া যাচ্ছে। তারপর লোকটি সব মেলামিনের গুঁড়ো পানিতে ফেলে দিল। সবাই খুব খুশি হলো।
লোকটি ফিরে এসে তার পাঁচ লাখ টাকা চাইলে সবাই খুব হাসাহাসি করল। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বললেন, ‘বাপু, শ পাঁচেক টাকা নিলে নাও, নয়তো ভাগো।’
এই বেঈমানি বাঁশিওয়ালা সহ্য করল না। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আরেকটি বাঁশি বের করে বাজাতে লাগল। অদ্ভুত তার সুর। সেই সুরে পাগল হয়ে সব শিশু বের হয়ে বাঁশিওয়ালার পেছন পেছন ছুটতে লাগল। বাঁশির সুরে সবাই মোহিত হয়ে থাকায় কেউ বাধাও দিতে পারল না। বাঁশিওয়ালা তাদের ওই দূরপাহাড়ের আড়ালে নিয়ে গেল।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার মুখে হাসি দেখা গেল, ‘যাক বাবা, ঝামেলা গেল!’
‘ঝামেলা গেল মানে?’ সবাই অবাক হলো।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বললেন, ‘এখন কোনো শিশুই নাই। অতএব শিশুখাদ্যেরও দরকার নাই। দুধে মেলামিন থাকুক আর স্টিল থাকুক-তাতে কী আসে-যায়? খাওয়ার মানুষই তো নাই!’
মহিতুল আলম পাভেল
সূত্রঃ প্রথম আলো, নভেম্বর ১৭, ২০০৮
Leave a Reply