নিউ ওয়েভ পত্রিকার নিজের কামরায় মুখে জোর করে একরাশ গাম্ভীর্য টেনে বসে আছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সম্পাদক সাহেব। কিছুক্ষণ আগে তাঁর এক বন্ধু এসেছিলেন। তিনি বেশ কিছু রসালো গল্প শুনিয়ে গিয়েছেন তাঁকে। চুইংগাম চিবুতে চিবুতে আপনমনেই সেই গল্পের জাবর কাটছিলেন তিনি। আর মাঝেমধ্যে আপনমনেই হেসে উঠছিলেন।
হঠাৎ তাঁর কামরায় এক তরুণের আবির্ভাব। দেখেই বোঝা যায়, ইনি একজন উঠতি লেখক। সংকোচ, লাজুক লাজুক মুখ আর চোখে ভীরু-সন্ত্রস্ত চাউনি। হাতে রোল করা একগুচ্ছ কাগজ। সম্ভবত স্বহস্তে রচিত গল্প, উপন্যাস অথবা কবিতার পাণ্ডুলিপি। এ পত্রিকায় ছাপানোর বাসনা নিয়ে সঙ্গে করে এনেছেন। এমনভাবে লেখাটি ধরে আছেন তিনি, যেন ওটা একটা সদ্য ফোটা গোলাপ, যা অতিসাবধানে তুলে এনেছেন প্রিয়াকে উপহার দেওয়ার জন্য।
তরুণটিকে দেখামাত্র টেবিলে রাখা ফাইলে গভীর মনোনিবেশ করলেন তিনি। তিনি এখন কাজে খুব ব্যস্ত-এটা বোঝানোর চেষ্টা।
জলজ্যান্ত তরুণটি তাঁর নজরেই পড়ল না। তাই সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আস্তে করে গলা খাঁকারি দিলেন তরুণ। তারপর একটু উশখুশ করে সামনের টেবিলে ইচ্ছে করে দুইবার গুঁতোও দিলেন তিনি। কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত কাতর কণ্ঠে তোতলাতে তোতলাতে তরুণ বললেন, ‘একটা গল্প এনেছিলাম, যদি দয়া করে দেখতেন···। এর আগে আমি দু-চারটা অন্য ম্যাগাজিনেও লিখেছি···।’
সম্পাদক সাহেবের দৃষ্টি যেমন ফাইলে ডুবে ছিল তেমনি রইল। শুধু মুহূর্তের জন্য বাঁ হাতের আঙ্গুলটা উল্টে ‘কচু’ দেখানোর ভঙ্গি করলেন। আসলে তিনি ওই ঘরের মধ্যে বসে থাকা এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে দিলেন নিঃশব্দে।
কাঠপেনসিলের মতো সরু এক ভদ্রলোক সম্পাদকের আঙ্গুল বরাবর আয়েশ করে চেয়ারে বসে সিগারেট ফুঁকছেন। তাঁর সামনের টেবিলে পড়ে আছে বিশাল আকৃতির এক খাতা। হাত থেকে পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে বিশাল ওই খাতাটায় তরুণের নাম-ধাম চটপট তুলে নিয়ে বললেন, ‘এখন আপনি আসতে পারেন।’
‘আমি আবার কবে আসব?’ আমতা আমতা করে বললেন তরুণ। চোখে মিনতি ঝরে পড়ল তাঁর।
‘আর আসতে হবে না আপনাকে। লেখা মনোনীত হলে আমরাই জানাব।’
এ জানানোটা যে কী আর ওই বিশাল আকারের খাতাটি যে কী ভয়ঙ্কর, তরুণ তা খুব ভালো করেই জানেন।
এরপর একে একে আরও তিন তরুণ ঢুকলেন সম্পাদকের কামরায়। তিনজনই পরপর নিস্তেজ-নিষ্প্রাণ হয়ে বেরিয়ে এলেন। দৃশ্যপটে প্রথম তরুণের আবির্ভাব ঘটল পুনরায়। জমা দেওয়া লেখাটির ব্যাপারে জানতে এসেছিলেন বোধহয়। কিন্তু চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখে চুরমার হয়ে গেল তাঁর ভেতরটা। হয়েছে কি, সম্পাদক সাহেবের টেবিলে চা রাখতে গিয়ে ছলকে পড়ল খানিকটা। সহকারী সাহেব মহা বিরক্ত হয়ে হাতের কাছে মোছার মতো কিছু না পেয়ে তরুণটির সাধের লেখাটি থেকে খানিকটা কাগজ ছিঁড়ে নিলেন। তারপর টেবিলটা মুছে টেবিলের নিচের ওয়েস্টপেপারের বক্সে ফেলে দিলেন। বাকিটুকুর কী হাল হবে বুঝতে দেরি হলো না তরুণের।
কিছুক্ষণ পর কামরার দৃশ্যপটে আবার পরিবর্তন এল। দৃশ্য পরিবর্তনের কারণ সুদর্শনা এক তরুণীর আবির্ভাব। তার সুগন্ধির সৌরভে ঋষির ধ্যান ভাঙল যেন। সম্পাদকের জমাটবাঁধা বিরক্তি মুহূর্তেই বরফের মতো গলে পানি হয়ে গেল। কান পর্যন্ত বিস্তৃত দেঁতো হাসিতে আর চকচকে আগ্রহী চোখে সাদর অভ্যর্থনায় তরুণীকে বসতে দিলেন তিনি।
তরুণীটি একটু হেসে সম্পাদক সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘একটা লেখা এনেছিলাম।’
‘অবশ্যই! আপনার মতো তরুণীদের ভালো লেখার জন্যই এতকাল আমি অপেক্ষা করছি।’
সম্পাদক সাহেব অত্যন্ত আগ্রহসহকারে তরুণীর হাত থেকে পাণ্ডুলিপিটি নিলেন। পাতা উল্টে দু-একটা লাইনে চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘ওহ্, চমৎকার! অপূর্ব! আমার নিউ ওয়েভ পত্রিকার ক্রিসমাস সংখ্যাতেই ছাপাব এটি।’
সম্পাদকের অতি উচ্ছ্বাস দেখে অবাক তরুণী বললেন, ‘মাত্র দু-এক লাইনে চোখ বুলিয়ে কী করে বুঝলেন যে লেখাটি ভালো হয়েছে?’
‘আরে, আমি জহুরি। আমি না চিনলে কে চিনবে বলুন!’
অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে তরুণীটি উঠতে যাচ্ছিলেন। সম্পাদক সাহেব অনুরোধ করে তাঁকে আবার বসালেন। তারপর বেয়ারাকে ডেকে এক কাপ স্পেশাল চা আর ডাবল ডিমের পোচ আনতে বললেন। তরুণী লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘আবার এসব কেন।’
‘আরে, কী বলেন আপনি! আপনার মতো একজন লেখককে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেব ভেবেছেন?’ তরুণীটি তখন হঠাৎ বললেন, ‘আপনি আমাকে লেখিকা ভেবেছেন বুঝি? এটা আমার লেখা নয়। এটা আমার বাবার লেখা!’
এ কথা শুনেই জোঁকের মুখে লবণ পড়ার মতো মুখের অবস্থা হয়ে গেল সম্পাদকের। তেতো ঢোক গিলে বললেন তিনি, ‘তা বাবার লেখা আপনি নিয়ে এসেছেন কেন?’
একটু যেন লজ্জা পেয়ে তরুণী বললেন, ‘বাড়িতে বিয়ের কারণে বাবা ব্যস্ত। আর তাঁকে না জানিয়ে তাঁর লেখাটি পত্রিকায় ছাপলে দারুণ একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে তাঁকে।’
একরাশ বিষাদ নিয়ে সম্পাদক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও, বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত? তা কার বিয়ে?’
তরুণীটি লাজুক হেসে বললেন, ‘আমার!’
সম্পাদক সাহেব যেন বোবা হয়ে গেলেন। নিস্তব্ধতা ভেঙে তরুণী বললেন, ‘লেখাটা একনজরে যখন আপনার এত পছন্দ হয়েছে, তখন ক্রিসমাস সংখ্যায় না হোক, পরবর্তী সংখ্যায় নিশ্চয়ই ছাপাবেন। কিন্তু আমি আর আসতে পারব না।’
‘কেন? আপনি কোথায় যাবেন?’
‘বিয়ের পরই বন থেকে হানিমুনে সুইজারল্যান্ড···তারপর রিভিয়েরা···।’
এমন সময় বেয়ারা এসে জানালেন, ‘স্যার, ক্রিস্টোফারের ডিমের অমলেট ভাজতে নাকি একটু দেরি হবে। ডিম নাকি ফুরিয়ে গেছে। তাই আনতে পাঠিয়েছে। তা এখন শুধু স্পেশাল চা-ই নিয়ে আসব? পরে নাহয় আনা যাবে ওটা···।’ খেঁকিয়ে উঠে সম্পাদক সাহেব বললেন, ‘যা এখান থেকে, কিছুই আনতে হবে না। যা, ভাগ!’
রূপান্তরঃ শারমীন আফরোজ
সূত্রঃ প্রথম আলো, অক্টোবর ২৭, ২০০৮
Leave a Reply