ছুটির দিন। দুপুর। রাজধানীর এক মহল্লায় রাস্তার ধারে এক মেসে খাওয়া শেষে বিছানায় শুয়েছে দুজন। এক বিছানায় রবিউল হক ওরফে রবি। আরেক বিছানায় দিদারউদ্দিন।
যুবক রবি স্মাতকোত্তর শেষে চাকরির ধান্দা করছে। বছর তিনেক ধরে বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছে সে। এত দিনে তার জুতার তলি তো গেছেই, চাঁদিও ফরসা হতে শুরু করেছে। এ জন্য মেজাজ প্রায় সারাক্ষণ তিরিক্ষি থাকে।
দিদারউদ্দিন সরকারি চাকুরে। অবসর নিতে বেশি দেরি নেই। রবি তাঁকে সহ্য করতে পারে না। বুড়োর সঙ্গ মানে বুড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু কী করা? কপালের লিখন। বেকারত্বের কীট রবির সুন্দর স্বপ্নগুলো এক এক করে খেয়ে ফেলছে। এ যন্ত্রণায় সারা রাত ছটফট করে সে। ভোরের দিকে চোখ দুটো যেই ভারী হয়ে আসে, এ সময় খুট করে শব্দ। শব্দ তো নয়, যেন মাথার ওপর দশমণি হাতুড়ির বাড়ি! কে আর করবে? ওই দিদারউদ্দিন। অফিসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত চলতেই থাকে এই খুটখাট। এর মধ্যে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে যখন তিনি সালমার গান ধরেন, রবির তখন সিমির মায়ের মুখচ্ছবি কল্পনা করা ছাড়া উপায় থাকে না। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় পাশের বাড়ির সিমিকে চিঠি দিতে গিয়েছিল রবি। জানালা গলে যেই হাত বাড়িয়েছে, অমনি শিকারি বিড়ালের মতো খপ করে চিঠিসহ হাতটা ধরে ফেললেন সিমির মা। ওরে বাপ, তাঁর যে চাহনি। এখনো রবির জন্য তা রাগ দমানোর এক মোক্ষম দাওয়াই।
আজ একটু আগে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট টেস্ট নিয়ে দিদারউদ্দিনের সঙ্গে রবির একচোট বাতচিত হয়েছে। দিদারউদ্দিনের মতে, মাশরাফির রান আউট দেওয়া ঠিক হয়নি থার্ড আম্পায়ারের। রবি ফস করে বলে উঠল, এত ভালো বুঝলে তো আপনিই আম্পায়ার হতেন। ব্যস, কথায় কথায় হয়ে গেল একচোট। শেষে দিদারউদ্দিন উপসংহার টানলেন, রবির বায়ুচড়া আছে। ফস করে জ্বলে ওঠে। এর সমাধান হচ্ছে উত্থিত পদাসন আর চিরতার পানি।
ঘটনা যখন এত দূর পৌঁছেছে, এমন সময় ঠকাস! সামনের রাস্তা থেকে সজোরে কিছু একটা লেগেছে দরজার ওপর। প্রথমে দিদারউদ্দিন ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। তারপর রবি। এক মিনিট স্থির হয়ে রইল দুজন। কিন্তু কৌতূহল মেটানোর আগ্রহ দেখা গেল না কারও। আবার দুজন গা এলিয়ে দিল বিছানায়। দুজনের চোখ যখন লেগে এসেছে, এমন সময় আবার ঠকাস! তড়াক করে উঠে বসল দুজন। সাধের ঘুম টুটে যাওয়ায় রবির চাঁদি গরম। এক ছুটে গিয়ে দরজা খুলল সে। দেখে, রোদ-ঝলমল রাস্তায় টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলছে একদল ছেলে। ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে তাদের বয়স।
রাগ দমাতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল রবি, ‘এই পোলাপান, রাস্তায় খেলা কিসের? মাঠে যাও।’
এক ছেলে দাঁত বের করে বলল, ‘মাঠ নাই বইলাই তো রাস্তায় খেলতাছি।’
রবি বলল, ‘রাস্তায় খেলবা, ভালো কথা। এই দিকে যেন বল না আসে। আবার যদি দরজায় বল লাগে, খুব খারাপ হবে কিন্তু।’
দিদারউদ্দিন এর মধ্যে রবির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি সব শুনলেন, দেখলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। ঘরে ঢুকে আবার শোয়ার আয়োজন করল দুজন। খানিক পর দুজন যখন গভীর ঘুমে ডুবতে যাবে, এমন সময় আবার ঠকাস! একইভাবে আবারও জেগে উঠল দুজন। এবার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবেগে ছুটে বের হলো রবি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গলা ফাটাতে লাগল, ‘ভালো কইরা বললে কথা কানে যায় না, না? গুড়ুম-গুড়ুম কিছু দিলে যাইব। শিগগির দূর হ। নইলে টেংরি ভাইঙ্গা হাতে ধরাইয়া দিমু।’
কিন্তু ছেলেদের মধ্যে ভয়ের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। বরং দু-তিনজন ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ‘ওই মিয়া, এত তেজ দেখান ক্যান? রাস্তা কি আপনের বাপের? পারলে দরজায় ফোম লাগান। শব্দ হইব না।’ এই বলে সবাই মিলে হি-হি হাসি।
পরাজিত রবি ফিরে এসে আপন মনে গজগজ করতে লাগল। দিদারউদ্দিন বললেন, ‘রাগ দেখিয়ে সবকিছু হয় না। বুদ্ধি লাগে।’
তেতে উঠে রবি বলল, ‘এখানে বুদ্ধির কী কাজ শুনি?’
‘শুনবে কী, তোমাকে আমি দেখাব।’
‘পারলে দেখান।’
পরদিন দুপুরে ছেলেরা যখন রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে এল, দিদারউদ্দিন গিয়ে মিষ্টি কথায় দুই মিনিটে তাদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেললেন। বললেন, ‘দেখো বাবারা, তোমাদের এ খেলা দেখে আমার শৈশবের ্নৃতি মনে পড়ে যায়। আমিও এমন করে ক্রিকেট খেলতাম। তোমরা যদি প্রতিদিন দুপুরে না খেলে বিকেলের দিকে খেলো, তাহলে অফিস করে এসে তোমাদের খেলা দেখতে পারব। এতে আমার দারুণ বিনোদন হবে।’
দিদারউদ্দিনের টোপ ঘপাত করে গিলে ফেলল ছেলেরা। তারা বলল, ‘এতে আমাদের কী লাভ?’
দিদারউদ্দিন বললেন, ‘এ জন্য তোমাদের প্রতি সপ্তাহে এক শ টাকা করে দেব।’
দিদারউদ্দিনের সঙ্গে চুক্তিমতো ছেলেরা পরদিন থেকে বিকেলে এসে খেলতে লাগল রাস্তায়। রবিও বেঁচে গেল ঘুমের ব্যাঘাত থেকে। দিদারউদ্দিনের ওপর থেকে সব অশ্রদ্ধা দূর হয়ে গেল তার।
কিন্তু দিদারউদ্দিন পড়লেন ফ্যাসাদে। প্রতি সপ্তাহেই ছেলেরা এসে এক শ টাকা করে নিয়ে যায়। এভাবে তিন সপ্তাহ পার হলো। চতুর্থ সপ্তাহে ছেলেরা এলে দিদারউদ্দিন বললেন, ‘বুঝলে বাবারা, আমার এক আত্মীয়ের ভয়ানক অসুখ। তার পেছনে এর মধ্যে অনেক টাকা ঢেলে ফেলেছি। এ সপ্তাহে পঞ্চাশ টাকার বেশি দিতে পারব না।’
কিশোরেরা তা-ই মেনে নিল। পরের সপ্তাহে দিদারউদ্দিন ছেলেদের বললেন, ‘বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরেক ধাপ চড়েছে। এ সপ্তাহে তিরিশ টাকার বেশি দিতে পারব না।’
ওরা তা-ই মেনে নিল। পরের সপ্তাহে দিদারউদ্দিন ছেলেদের বললেন, ‘তোরা শুধু টাকা টাকা করিস কেন? টাকাই সব নাকি। আমি একজন বুড়ো মানুষ। মুরব্বি হিসেবেও তো বিনোদন দিতে পারিস। তোদের কি মায়া-মমতা বলে কিছু নেই? এই নে, এবার ১০ টাকা নিয়ে যা। আর কিন্তু দিতে পারব না।’
টাকা না নিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল ছেলেরা। ওদের দলপতি ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ‘কী যে কন, চাচামিয়া! ১০ টেকায় কি খেলা দেহান যায় নাকি? আমাগোর কি মানসম্মান নাই? ওই, তোরা চল। দূর, এই রাস্তায় আমরা আর খেলুমই না।’
বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে
সূত্রঃ প্রথম আলো, অক্টোবর ২৭, ২০০৮
Leave a Reply