ধানমন্ডিতে সেদিন গিয়েছিলাম কী একটা কাজে। হঠাৎ আমার এক বেকার বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দেখা। এই বয়সে বেকার বন্ধু থাকার কথা নয়, কিন্তু আমার এই বন্ধুটি শখের বেকার। বউ যেহেতু একটা এনজিওতে বিরাট বেতনের চাকরি করে, কাজেই মাঝেমধ্যে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়ায়। তারপর কিছুদিন পর ফের একটা চাকরি ধরে ফেলে (অবশ্য চাকরি ছাড়া এবং চাকরি ধরায় ইতিমধ্যে সে রেকর্ড করে ফেলেছে। বন্ধুরা তাকে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছে বা দিয়ে যাচ্ছে!)। সে যা-ই হোক, তো···তার সঙ্গে যখন দেখা তখন সে সদ্য আবার বেকার হয়েছে। ধানমন্ডি এলাকায় গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়াচ্ছে।
আরে দোস্ত, খাওয়া।
কী খাবি?
একটা কিছু খাওয়া। এদ্দিন পর তোর সঙ্গে দেখা।
ধানমন্ডি এলাকা খাওয়াদাওয়ার জন্য রিস্কি। আমি বলি।
বার্গার খাওয়া···তাহলেই চলবে। আমি রাজি হলাম, হাজার হোক পুরোনো বন্ধু, বার্গার খাওয়া যায়।
কিন্তু কোথায় খাব। হঠাৎ দেখি একটা বিজ্ঞাপন- ‘সাহস বদলে দেয় সবকিছু।’ ঠিক কিসের বিজ্ঞাপন ধরতে পারলাম না। অবশ্য আজকাল বিজ্ঞাপন দেখে বোঝা মুশকিল, কোনটা কিসের বিজ্ঞাপন। যেমন-সেদিন টিভিতে দেখি, এক লোক ভুঁড়ি কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমি যখন ধরে নিচ্ছি বিজ্ঞাপনটি বোধহয় ভুঁড়ি কমানোর কোনো যন্ত্রের হবে, তখন দেখা গেল, না, বিজ্ঞাপনটি আসলে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ব্যবহারকারী সুন্দরী তরুণীকে আকৃষ্ট করতে সে ভুঁড়ি কমাচ্ছে। সে যা-ই হোক···আমরা দেখলাম সেই বিজ্ঞাপনের (সাহস বদলে দেয় সবকিছু) পাশ দিয়েই একটা ফাস্টফুডের দোকান দেখা যাচ্ছে। বেশ পশ দোকান। সাহস করে ঢুকে পড়লাম। যা থাকে কপালে, বার্গারই তো খাব। দুটো বার্গারের অর্ডার দেওয়া হলো, সঙ্গে দুটো ড্রিংকস।
খেয়েদেয়ে ঢেঁকুর তুলতে যাব। বিল এসে হাজির। ঢেঁকুর আর তোলা হলো না (ঢেঁকুর তোলার মতো অবস্থায় ঢেঁকুর আচমকা গিলে ফেলা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম কাজ, আমি টের পেলাম সেই প্রথম!)। দুটো বার্গার আর দুটো ড্রিংকসের বিল এসেছে একুনে ৫৫৮ টাকা (+ভ্যাট, টিপস তো আছেই)!! আমার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখি, সে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে গভীর মনোযোগে। জীবন বাজি রেখে কোনোমতে বিল দিয়ে বাইরে এসে আবার নজর পড়ল সেই বিজ্ঞাপনটির দিকে···‘সাহস বদলে দেয় সবকিছু!!’ এবার আমি বিজ্ঞাপনের মর্মার্থê হৃদয়ঙ্গম করতে পারলাম যেন। আমাদের সাহস আমার মানিব্যাগ বদলে দিয়েছে নিদারুণভাবে।
ফাস্টফুডের দোকানের বাইরে এসে বন্ধুকে বললাম, আমাকে এখন ঘাড়ে করে বাসায় পৌঁছে দিবি তুই।
কেন?
আমি মানিব্যাগ খুলে দেখালাম, সেখানে গোটা-কয়েক ভিজিটিং কার্ড আর একটা দুই টাকার কয়েন ঠনঠন করছে। বেকার বন্ধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, ওঠ। তুই ঘাড়ে উঠতে পারলে আমি তোকে নিয়ে যেতে পারব আশা করি···তোর ওজন আর কত হবে।’
না, শেষ পর্যন্ত বন্ধুর ঘাড়ে করে বাসায় না পৌঁছে হেঁটেই রওনা দিলাম। অন্তত পায়ের ব্যায়াম হোক। এবং হাঁটতে হাঁটতে সাহসের ওপর চমৎকার একটা কোটেশন মনে পড়ল। ‘তুমি তখনই সাহসী, যখন তোমার আশপাশের মানুষগুলো প্রচণ্ড রকম ভীতু।’ কোটেশনটি ফ্রেড গেটিংসের। ফ্রেড গেটিংস একজন দার্শনিক ছিলেন, আবার একজন বিখ্যাত পামিস্টও ছিলেন। তবে তিনি সাহসী ছিলেন নিঃসন্দেহে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২০, ২০০৮
Leave a Reply