(কামসূত্রে) অন্যের কর্মীবাহিনী দিয়ে নিজের কার্যোদ্ধার করার উপায় সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘পরদারে গমন করিতে হইলে প্রথম এইগুলির পরীক্ষা করিবে– সাধনের যোগ্য কি না, নিরাপদ কি না, সেটি আয়তিকর (গৌরবজনক) কি না এবং তদ্বারা বৃত্তিলাভ সম্ভব কি না।’–কলিম খান
ভারতবর্ষে ‘কাম’ ও ‘কর্ম’ শব্দে একসময় কোনো অর্থভেদ ছিল না। উপমহাদেশের কোনো কোনো ভাষা এখনো এই অর্থসম্পর্ক বহন করে। বাংলাভাষাভাষী কোনো কোনো অঞ্চলের ডায়ালেক্টেও কাম ও কাজ সমঅর্থে ব্যবহৃত হয়। সন্তান উপাদন ও পণ্য উৎপাদনসহ সব ধরনের উৎপাদন ও উৎপাদন সম্পর্ককে একই তত্ত্বের আওতায় এনে বর্ণনা করাই ছিল প্রাচীন ভারতীয় রীতি, যে রীতি থেকে আমরা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। জানাচ্ছেন কলিম খান।
কামশাস্ত্র বা কামসূত্র বলে চিহ্নিত শাস্ত্রগ্রন্থটি আদপে ছিল বিস্তারিত সমাজকর্মব্যাখ্যান, অর্থাৎ পরিপূর্ণ এক ব্যবস্থাপনা শাস্ত্র, অধুনাকার যৌনশাস্ত্র মাত্র নয়। ক্রিয়াভিত্তিক তথা অর্থগতভাবে বহুরৈখিক সংস্কৃত ও তার কন্যা বাংলাভাষা কালক্রমে অধঃপতিত হয়ে একার্থক প্রতীকী ভাষায় পরিণত হবার ফলে বহুঅর্থব্যঞ্জক কামশাস্ত্র অর্থগত ব্যাপ্তি হারাতে হারাতে একার্থক সেক্সোলজিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাতে আদিতে যা ছিল জ্ঞানী-কর্মীর মধ্যকার সম্পর্কের সূত্রাবলি, অন্তিমে একার্থক অনুবাদে-টীকায় তাই পরিণত হয়েছে কেবল মানব-মানবীর সম্পর্কসূত্রে। বস্তুতপক্ষে কামশাস্ত্রের সারকথা, মানব-মানবী, রাজা-প্রজা, পুরুষ-প্রকৃতি, জ্ঞানী-কর্মী, পরিচালক-পরিচালিত সকলের সর্বোৎকৃষ্ট কাম চরিতার্থ করা– ‘যেখানে পরস্পর পরস্পরের সুখের অনুভব করিয়া আনন্দক্রীড়ায় নিমগ্ন হয়, পরস্পর পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যবহার করিয়া থাকে, সেখানে সেই সম্বন্ধই প্রশস্ত।’
বাংলাঅনুবাদে বর্তমানে প্রাপ্ত সটীক কামশাস্ত্র গ্রন্থগুলোর মধ্যে বাৎসায়ন রচিতটিই প্রধান ও প্রাচীন। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০/৫০০ অব্দে সংকলিত। তবে এতে আদিম সাম্যবাদী ভারত সমাজের শেষপাদের আচার্যদের থেকে শুরু করে বৌদ্ধযুগের সূচনাকাল পর্যন্ত হাজার হাজার বছরের জ্ঞানকাণ্ডের সমাহার ঘটেছিল। বাৎসায়ন-পূর্বকালে ভারতবর্ষে কামশাস্ত্রের ব্যাপক অনুশীলন হয়, পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রগুলিও যার বাইরে নয়। এমনকি মহাভারতও একইসঙ্গে ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও কাম(কর্ম)শাস্ত্র।
বাৎসায়ন কামশাস্ত্রের শানেনযুলে ব্রহ্মাপ্রণীত একলক্ষ অধ্যায়ত্মক ত্রিবর্গসাধন (ধর্ম, অর্থ ও কাম সাধন), নন্দীরচিত সহস্র অধ্যায়ত্মক পৃথক কামশাস্ত্র, শ্বেতকেতু রচিত পাঁচশত অধ্যায় যুক্ত সংকোচন ও বাভ্রব্যরচিত একশত পঞ্চাশ অধ্যায়ে বিভক্ত সপ্তাধিকরণের পরম্পরার কথা বলেন। পরবর্তী সময়ে বাভ্রব্যের এক এক ভাগ নিয়ে আলাদা আলাদা গ্রন্থ সংকলিত হতে থাকায় এই শাস্ত্র ক্রমে বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছিল। সুতরাং সম্ভাব্য বিলুপ্তি থেকে একে রক্ষা এবং সম্পূর্ণ শাস্ত্রটি আকারে বিশাল বলে পাঠকষ্ট অপনোদন করতে বাৎসায়ন সাতটি অধিকরণে, ছত্রিশটি অধ্যায়ে ও চৌষট্টি প্রকরণে বাভ্রব্যের শাস্ত্রের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ দেন, যা বাৎসায়নের কামসূত্র বা কামশাস্ত্র নামে পরিচিত। বাৎসায়নের পরেও কামশাস্ত্র চর্চা অব্যাহত ছিল। পরবর্তী রচনাগুলোর মধ্যে দামোদর গুপ্ত রচিত ‘কুট্টনীমত’, কোক্কোক রচিত ‘রতিরহস্য’, পদ্মশ্রী রচিত ‘নাগরসর্বস্ব’, জয়দেব রচিত ‘রতিমঞ্জরী’, জ্যোতিরিশ রচিত ‘পঞ্চসায়ক’, কল্যাণমল্ল রচিত ‘অনঙ্গরঙ্গ’, ক্ষেমেন্দ্র রচিত ‘কলাবিলাস’, পণ্ডিত অনন্ত রচিত ‘কামসমূহ’, দেবরাজ রচিত ‘রতিরত্ম-প্রদীপিকা’, হরিহর রচিত ‘শৃঙ্গারদীপিকা’ বা ‘রতিরহস্য’, বীরভদ্র রচিত ‘কন্দর্পচূড়ামণি’, আলি আকবর শাহ রচিত ‘শৃঙ্গারমঞ্জরি’ উল্লেখযোগ্য।
পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই যেমন ধর্মপ্রবক্তা কোনো নারীকে খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি ধর্মশাস্ত্র কিংবা কামশাস্ত্র নাজেলের নেপথ্যেও কোনো নারীর অস্তিত্ব ইতিহাসসম্মত নয়। কাজেই কামশাস্ত্রের বহুরৈখিক আদিপাঠ কিংবা একরৈখিক বর্তমান পাঠ উভয়তেই প্রকৃতি-নারী-কর্মী-প্রজা হচ্ছে ব্যাখ্যাত আর পুরুষ-জ্ঞানী-মালিক-রাজা হচ্ছে ব্যাখ্যাতা। এই মৌলহেতুবশত এবং প্রতীকী বাংলার ছিন্নসূত্র পণ্ডিতদের ধকল সয়ে কামশাস্ত্রের নারী-পুরুষ সম্পর্ক কালক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভোগ্যা ও ভোক্তৃরূপে। একরৈখিক ব্যাখ্যায় শাস্ত্রে বর্ণিত নারীর চরিত্রহানি ও সতীত্ব প্রসঙ্গ, পরস্ত্রী/পরনারী/বাঞ্ছিতাকে বশীভূত করবার কৃৎকৌশলের অনুপুঙ্খ বর্ণনা, নারীর ৬৪ কলায় পারদর্শী হয়ে ওঠবার দাওয়াই ইত্যাদিকে রীতিমতো নারীস্বার্থবিরোধী বলেই মনে হয়। অধুনা সর্বত্র এই কামশাস্ত্রেরই জয়জয়কার।
তথ্যসূত্র
১. ভাষার ঔপনিবেশিকতা : প্রাচীন ভারতে ম্যানেজমেন্ট ও বাৎসায়নের কামসূত্র, দিশা থেকে বিদিশায়, কলিম খান, হওয়া ৪৫, কলিকাতা, ১৪০৬
২. বাৎসায়ন-প্রণীত কামসূত্র, পঞ্চানন তর্করত্ন ও মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার, কলিকাতা, ১৩৯৮
Leave a Reply