In my beginning is my end—T.S. Eliot
মানুষের মত ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু কবিতার/ জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কবিতাকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চেয়েছেন তিনি, অথবা জীবনকে আনতে চেয়েছেন কবিতার সমতালে; তাঁর ওই দ্বিমাত্রিক যাত্রা অদ্যাবধি অব্যাহত। ইতিপূর্বে বিভিন্ন গদ্য রচনায় বিক্ষিপ্তভাবে কবি বেলাল চৌধুরীর জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সন্ধান পাওয়া গেলেও প্রচলিত অর্থে এই প্রথমবারের মতো স্মৃতিকথা লিখলেন তিনি। কিন্তু একে কি ঠিক প্রথাগত স্মৃতিকথা বলা যায়?
সমগ্র গ্রন্থটি যেন এক নির্মলচিত্ত, বিস্মিত তরুণের রচনা। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে বন্দরনগর চট্টগ্রামে এক রেলওয়ে কর্মকর্তার পরিবারে তাঁর জন্ম থেকে বিগত শতাব্দীর ’৮০ ও ’৯০-এর দশকে ভারত বিচিত্রার সম্পাদকরূপে তাঁর প্রায় এক যুগ দায়িত্ব পালন, ওই সমগ্র যাত্রাই তিনি ধারণ করেছেন এই গ্রন্থে, কিন্তু লঘু, অথবা গুরু কোনো প্রসঙ্গেই তাঁর বিন্দুমাত্র কোনো ক্ষোভ অথবা অনুশোচনা নেই। এমনকি মধ্য পঞ্চাশের দশকে ৯২-ক ধারার আওতায় প্রায় বছরখানেক কারাবাসও তাঁর কাছে আদৌ কোনো তিক্ত স্মৃতি নয়। তিনি বরং ওই সুযোগে যে সকল ত্যাগী কমিউনিস্ট রাজবন্দীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল, তাঁদের স্মৃতি রোমন্থনেই অধিকতর আগ্রহী। অর্থাৎ তিনি এ বয়সেও যেন প্রায় দ্বিতীয় জীবনের জন্য প্রস্তুত।
বেলাল চৌধুরীর স্মৃতিচারণা, তাঁর জীবনের মতোই আদৌ সরলরৈখিক নয়। বিভাগপূর্ব চট্টগ্রামে তাঁর জন্মের পরে তিনি দীর্ঘ একটি অধ্যায় ব্যয় করেছেন শৈশবে সন্দ্বীপে অতিবাহিত কয়েকটি বছরের বর্ণনায়। কিন্তু সমগ্র গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে বারংবার কুমিল্লায় অতিবাহিত তাঁর স্মরণীয় বাল্যকালের উল্লেখ থাকলেও, কোথাও তার বিস্তারিত কোনো বর্ণনা নেই। প্রকৃতপক্ষে বিগত শতাব্দীর মধ্য পঞ্চাশের দশকে তরুণ বেলাল চৌধুরীর ঢাকা শহরে পদার্পণের পরেই কাহিনি দানা বাঁধতে শুরু করে।
ঢাকা তখনো প্রায় জেলা পর্যায়ের এক মফস্বল শহর, যদিও নামে প্রাদেশিক রাজধানী। ওই শহরের সীমানা তখনো সদরঘাট থেকে নবাবপুর লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত বিস্তৃত; পল্টনের পুরোটাই তখনো প্রায় উন্মুক্ত প্রান্তর। অধুনালুপ্ত গুলিস্তান সিনেমা হলই সমগ্র শহরে একমাত্র আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন। কোনো যান্ত্রিক শকট নয়, বরং ঢাকার কিংবদন্তিখ্যাত ঘোড়ার গাড়ি এবং রিকশাই শহরবাসীর প্রধান বাহন। অর্ধশতাব্দী পূর্বের ওই প্রায় মফস্বল শহরের ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনেই বেলাল চৌধুরীর প্রথম ঢাকায় পদার্পণ।
কবি বেলাল চৌধুরীর বিখ্যাত, বর্ণাঢ্য বোহেমিয়ান জীবনের শুরু শেষ-পঞ্চাশের ঢাকাতেই। তরুণ বেলাল চৌধুরী অতি দ্রুত যোগ দিলেন কিংবদন্তিপ্রতিম বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডায়। এভাবেই আরেক কিংবদন্তির জন্ম।
বেলাল চৌধুরী যুক্তিসংগতভাবেই তাঁর স্মৃতিকথার একটি দীর্ঘ অধ্যায় ব্যয় করেছেন বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডার বর্ণনায়। লক্ষণীয়রূপে ওই উপাখ্যানে শামসুর রাহমান অথবা সৈয়দ শামসুল হকের মতো খ্যাতিমান সাহিত্যিকের প্রায় সমান গুরুত্বে উল্লিখিত হয়েছেন কতিপয় ‘অসাহিত্যিক’ অথচ স্মরণযোগ্য চরিত্র, যাদের মধ্যে একাধিক অবাঙালিও রয়েছেন।
ওই বিউটি বোর্ডিংয়েই কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে বেলাল চৌধুরীর প্রবাদপ্রতিম বন্ধুত্বের শুরু। বেলাল চৌধুরী গভীর মমতায় তাঁর বোহেমিয়ান বন্ধুর ঈর্ষণীয় কবিত্বশক্তির উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর কাহিনি টেনে এনেছেন তাঁর বর্তমান প্রবাসজীবন পর্যন্ত।
এরপর প্রথম-ষাটের দশকে কলকাতা গমনের মাধ্যমে বেলাল চৌধুরীর জীবনের সর্বাধিক বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের শুরু। স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র গ্রন্থে ওই অধ্যায়টিই দীর্ঘতম। এখানে বর্ণিত হয়েছে কৃত্তিবাস পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সূত্রপাতের কাহিনি; অধিকন্তু রয়েছে কমলকুমার মজুমদারসদৃশ উজ্জ্বল চরিত্রসমূহের বর্ণনা। কিন্তু যেমন পূর্বের অধ্যায়ে শহীদ কাদরী, অনুরূপভাবে সমগ্র অধ্যায়টি আচ্ছন্ন করে রয়েছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তাঁর অমিত কবিত্বশক্তি ও বিচিত্র জীবনযাপনপদ্ধতিসহ। সহযাত্রীসুলভ স্নেহে ও সম্মানে বেলাল চৌধুরী স্মরণ করেছেন সন্দেহাতীতরূপে জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষকে। গ্রন্থশেষে ’৮০-এর দশকের সচিত্র সন্ধানী পর্ব ও ’৯০-এর দশকের ভারত বিচিত্রা পর্ব প্রসঙ্গে দুটি পৃথক অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে।
কিন্তু ওই দীর্ঘ, বর্ণাঢ্য জীবনযাত্রার অর্থময়তা প্রকৃতপক্ষে কোথায় নিহিত? বিগত শতাব্দীর মধ্য-পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একজন কর্মী হিসেবে যার যাত্রা শুরু, দুই বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে সমান বিচরণের মাধ্যমে সে জীবন আজকে পরিণতিতে উপনীত। অসাম্প্রদায়িকতা তাঁর শৈশবলব্ধ; জনপ্রিয় ধারণার বিপরীতে, আন্তঃসাম্প্রদায়িক যোগাযোগ চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে সহজতর ছিল। বাধার দেয়াল তখনো এত উঁচু হয়নি।
কিন্তু সমগ্র বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বেলাল চৌধুরীর অনায়াস যোগাযোগ তাঁর নিজস্ব ব্যাপক অভিজ্ঞতা দ্বারা অর্জিত। বিশ্বব্যাপী সমগ্র বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সহমর্মিতাই সম্ভবত বেলাল চৌধুরীর জীবনের প্রধানতম বার্তা। প্রথাগত অর্থে স্মৃতিচারণা নয়, নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায় বরং প্রকৃতপক্ষে তারই বার্তাবহ।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৬, ২০১০
Leave a Reply