আত্মজীবনীর শিরোনাম কেন প্রণীত জীবন?
সৈয়দ শামসুল হকের আত্মকথা প্রণীত জীবন হাতে পেয়ে এই জিজ্ঞাসা মনে জাগল। বইটি পড়তে পড়তে দেখা মিলল এমন কথার: ‘প্রণীত আমার নারীরা’, ‘প্রণীত আমার পুরুষেরা’। তিনি বলছেন তাঁর রচিত গল্প, উপন্যাস, নাটকের চরিত্র নারী-পুরুষের কথা। তারা সবাই লেখকের প্রণীত। মানে কল্পিত, নির্মিত, সৃজিত। গল্প-উপন্যাস তো তা-ই। সে জন্য এগুলোকে বলে ফিকশান। কিন্তু আত্মজীবনী, নিজের জীবনকাহিনি? তাও কি ফিকশান?
এ নিয়ে মুশকিলে পড়া গেল। কারণ জলেশ্বরীর গল্পগুলোর স্রষ্টা, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, দূরত্ব, খেলারাম খেলে যা, বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণসহ অজস্র উপন্যাসের নির্মাতা, বৈশাখে রচিত পংক্তিমালাসহ অনেক ক্যাব্যের জনক, নূরলদীনের সারা জীবন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়সহ অনেক নাটকের নির্মাতা সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের নিজের জীবন সম্পর্কে তো সত্য কাহিনী জানতে চাই, ফিকশান নয়।
কিন্তু কী সত্য আর কী ফিকশান—এ বড় জটিল প্রশ্ন বলে মনে হয়। কেননা সৈয়দ শামসুল হক বলছেন, ‘পেছন ফিরে তাকানোই যদি সত্য, তবে তার বার্তা এই যে, দৃষ্টিপাতও হয়ে পড়ে রঞ্জনমণ্ডিত। এ রঞ্জন কল্পনার প্যালেট থেকে পাওয়া। এ প্যালেট অতীত আমাদের জোগায়—অতীতের কাজই এই। তাই দেখি, জীবনের কাহিনী মাত্রেই রঞ্জিত কাহিনী, শাদা কথায় কাল্পনিক কাহিনী—যদিও তার নায়ক এবং বর্ণনাকারী ওই যাতি জীবনের বাস্তব ব্যক্তিটিই। শেষ পর্যন্ত আর কিছু নয়, স্মৃতি থেকে উদ্ধারকৃত জীবন—প্রণীত একটি জীবন।’
বইটির প্রারম্ভিক পাতায় লেখকের এই বক্তব্য পাঠ করে খানিক হতাশ হতে হলো এই সংশয়ে যে, তাহলে তিনি বুঝি এবার নিজেকে নিয়ে একটি উপন্যাসই আমাদের সামনে হাজির করলেন; কিন্তু উপন্যাস বলে চিহ্নিত না করে বলছেন এইটি তাঁর জীবনের সত্য কাহিনী।
কিন্তু বইটি পড়তে পড়তে এই হতাশা ভুলে যাই, কারণ যা পড়ছি তাই সত্য বলে বোধ হয়। তাঁর লেখায় বাস্তবের বিশ্বাস উৎপাদনের ক্ষমতা বিলক্ষণ রয়েছে। কিন্তু ঠিক উপন্যাসের কাহিনির মতো নয়, আবার সাধারণ আর দশটি আত্মজৈবনিক কাহিনির মতোও নয়। প্রণীত জীবন যেন একই সঙ্গে একজন কুশলী কাহিনিকার ও একজন গভীর পর্যবেক্ষণশীল দার্শনিকের রচনা। জন্মমৃত্যুর কাহিনি এখানেও আছে, নানা ঘটনার উল্লেখও আছে যথেষ্টই। কিন্তু কালক্রম অনুসরণ করে শুরু থেকে আরম্ভ করে পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে চল, তা এখানে একদমই ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রথমে নিজের জন্মকাহিনি, তারপর বাবা, বাবার বড়ভাই, মা, তারপর পিতামহ, আবার তারই মধ্যে পিতামহের পূর্বপুরুষদের কাহিনি ও প্রসঙ্গ চলে এসেছে। এবং এসেছে শুধু কাহিনি বা ঘটনা বর্ণনার খাতিরে নয়, বরং চরিত্র-চিত্রণের নিমিত্তে।
পুরো বইটি জুড়ে লেখকের পূর্বপুরুষদের চরিত্র-নির্ণয় ও সেসবের বিশ্লেষণই যেন মুখ্য ব্যাপার হয়ে উঠেছে। মনে হয়, পূর্বপুরুষদের এই চরিত্রবিচার লেখকের নিজের চরিত্রবিচারেরই অংশবিশেষ; পূর্বপুরুষদের সঙ্গে নিজের যোগসূত্রটা খুঁজে পেতে চেয়েছেন তিনি। খানিক পেয়েছেনও: তাঁর আদিপিতা আলী মাহমুদের দুই ছেলের একজনের নাম ছিল গোমর। ‘অতি সুদর্শন গোমর ছিলেন বংশের কৃষ্ণ মেষ: তিনি ইসলামে বিশ্বাসভ্রষ্ট এবং সুরা ও নারীতে আসক্ত ছিলেন; পীর পরিবারের পক্ষে আরো গ্লানিকর বলে যা মনে করা হয়, তিনি এক হিন্দু বারনারীর করতলগত হয়েছিলেন..। অচিরে আলী মাহমুদ তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন…পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হয়ে অজানার উদ্দেশে যাত্রা করবার কালে…তিনি আগামীর জন্য এই রুদ্র অভিশাপ উচ্চারণ করে যান যে, বংশের পর বংশ আলী মাহমুদের পরিবার থেকে অন্তত একজন সন্তানকে তিনি তাঁর নিজের দলে টেনে নেবেন।’ তারপর লেখক লিখছেন, ‘জীবনের পথ হাঁটতে হাঁটতে কখনো এমন আমার মনে হয়েছে, গোমর হয়তো আমার প্রজন্ম থেকে আমাকেই তাঁর শিকার হিসেবে সংগ্রহ করেছেন।’
কিন্তু এও খণ্ডিত পরিচয়। লেখক নিজেই অন্যত্র বলে নিয়েছেন, ‘আমি একের ভেতরে অনেক মানুষ। এবং এই বহু আমির ভেতরে, কী আশ্চর্য, আপাত কোনো যোগসূত্র নেই। শেষ পর্যন্ত যদি আমি এমত সিদ্ধ বলে বিবেচিত হই যে, আমার জীবন-চরিত রচনার দরকার কেউ দেখছেন, তবে যোগসূত্রটি অপেক্ষা করে আছে তাঁর হাতে আবিষ্কৃত হবার জন্যে।’
মনে হয়, সৈয়দ শামসুল হকের আত্মজীবনীর এটি প্রারম্ভিক খণ্ড। কারণ এ বইতে তাঁকে তেমন করে পাওয়া যায় না, প্রায় পুরো বইটি জুড়েই রয়েছে কেবল তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা। বইটির বর্ণনা যেখানে শেষ হয়, সেখানেও তিনি বালকই থেকে গেছেন। তাঁর সাত দশকের দীর্ঘ জীবনের পরবর্তী অনেকগুলো ধাপের কাহিনি অবর্ণিতই রয়ে গেছে। বারো বছর বয়সে তিনি জন্মস্থান কুড়িগ্রাম ছেড়ে ঢাকা এসেছেন পড়াশোনা করতে। তাঁর যখন ১৮ বছর বয়স তখন তাঁর পিতা প্রয়াত হন। বারো বছরের দেখা ও শোনার বিবরণই তিনি দিয়েছেন গোটা বইজুড়ে। শুধু বিবরণই দেননি, বিশ্লেষণ করেছেন, পেছন ফিরে তাকিয়ে গোটা বংশের সমুদয় জীবনকে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং তার মধ্যে নিজের জায়গা ও অতীতের সঙ্গে নিজের যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু বইটি পড়া শেষে দারুণ অতৃপ্তি বোধ হয়: আরও আরও অনেক খণ্ডের প্রত্যাশা জেগে ওঠে। পটভূমিকা তো হলো; এবার আমরা খোদ সৈয়দ শামসুল হককেই তাঁর পূর্ণাঙ্গরূপে দেখতে চাই। ১৯৩৫ সালে জন্ম যে কবি-ঔপন্যাসিক-নাট্যকারের; ভারত-বিভাগ, পুরো পাকিস্তানি আমল, ষাটের দশকের উত্তাল রাজনৈতিক সময়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, তার পরের অস্থির, ভঙ্গুর সময়, পঁচাত্তর ও তার পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলি, আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—প্রায় পৌনে এক শতাব্দীর ইতিহাসের সাক্ষী যে লেখক, তাঁর জীবনকাহিনিতে এসব নিশ্চয়ই আসবে।
আমরা প্রণীত জীবন-এর পরবর্তী খণ্ডলহরীর প্রতীক্ষায় রইলাম।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৬, ২০১০
Leave a Reply