‘ভ্রমণের এই সব পুঙ্খানুপুঙ্খ আপনি মনে রাখেন কী করে?’ বিদেশ-বিভুঁই থেকে একবার মেইলে প্রশ্ন করেছিলাম ফারুক মঈনউদ্দীনকে। জবাবে তিনি লিখেছেন, ‘নোট নিন, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’ কিন্তু সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরের মতো একটি দীর্ঘ বিস্তারিত ভ্রমণগল্পের বই লিখতে শুধু যে নোট করলেই চলবে তা আমার বিশ্বাস হলো না। এই বইতে ফারুক মঈনউদ্দীন দেশগুলোয় বর্তমানে চষে বেড়াতে বেড়াতে নিকট কিংবা দূর অতীতেও ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছেন পাঠকদের। ভ্রমণগল্পের ফাঁদে ফেলে ইতিহাসচর্চা করতে ফারুক সিদ্ধহস্ত। জীবনানন্দ দাশের ‘সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে’ যে ভ্রমণের কথা আমরা জানি তা ছিল মূলত প্রতীকী। মানসলোকের ভ্রমণ। আর ফারুক মঈনউদ্দীন আক্ষরিক অর্থে সেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন বাস্তবে। আর তার বৃত্তান্ত তিনি পাঠকের কাছে হুবহু তুলে ধরেছেন স্মৃতিতে ধরে রাখা শব্দের চলচ্চিত্রে। ওখানে কিছুই বাদ যায়নি। সুন্দরী গাইডের চোখ জুড়ানো দেহভঙ্গি পর্যন্ত, ‘ওর বিনম্র বুকের ওপর নেমে আসা কালো রঙ করা সরল রেশমের মতো চুল মৃদু বাতাসে দোল খায়, সংক্ষিপ্ত স্কার্টের ঝুল বরাবর উঠে আসা উরু কামড়ে ধরা কালো স্টকিং এর ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত হয় প্রচ্ছন্ন উজ্জ্বলতা’ (‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’)। এ রকম বিশদ ও মজাদার বর্ণনা বইটির সবখানে। ফলে বর্ণিত পথ, ঘাট আর মানুষ এবং তাদের সংস্কৃতি সর্বোপরি ইতিহাস পাঠকের কাছে মূর্ত হয়ে ওঠে।
বইটিতে পাঁচটি দেশের ভ্রমণবৃত্তান্ত রয়েছে। ভিয়েতনাম, চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। ভিয়েতনাম ও চীনের জন্য তিনি চারটি করে আটটি গল্প লিখেছেন। আর অন্য তিনটি দেশের জন্য লিখেছেন একটি করে। প্রতিটি রচনার আলাদা বৈশিষ্ট্য। স্বাদেও রয়েছে তারতম্য। যাওয়ার পথে ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করার বৈশিষ্ট্যটি তিনি সব কটি লেখাতেই বজায় রেখেছেন।
ভিয়েতনামে, হ্যানয় এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার সময় ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজেই পথ চিনতে পারছিলেন না। পথের মানুষজন থেকে জেনে নিচ্ছিলেন পথের নির্দেশনা। আগন্তুক পর্যটকের মনের কী অবস্থা এবং কীভাবে তিনি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দেখছিলেন তার অসাধারণ বর্ণনা উদ্ধৃত করলেই পাঠক বইটির শিল্পরস সম্পর্কে কিছুটা অবহিত হবেন, ‘গাড়ি চালাতে মুখ ফিরিয়ে ড্রাইভার হোটেলের হদিস জানতে চাইলে ঠিকানা লেখা বুকিংয়ের কাগজটা ধরিয়ে দিই। ভুরু কুঁচকে মনোযোগ দিয়ে ওটা দেখে রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে মোবাইল ফোনে কার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে বলতে ঘন ঘন মাথা নাড়ে লোকটা। আমি উদ্বেগ নিয়ে গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে ওর চেহারায় পরিবর্তনশীল বলিরেখার নড়াচড়া দেখি। একসময় সন্তুষ্ট চেহারায় গাড়ি নিয়ে রাস্তায় উঠে এলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে সিটে হেলান দিতে পারি।’ (‘অবাক নামের ভিয়েতনাম’)
ফারুক সেই সব জনপদের মানুষকেও পাঠ করেছেন গভীরভাবে; স্পর্শ করতে চেয়েছেন তাদের মনোভূমি। নামের কারণে বইটির কয়েকটি ভ্রমণগল্পের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল বেশি। ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কাউয়াই’ গল্পটি সবার আগে পড়েছি। কারণ এই নামের বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রটি আমরা চট্টগ্রামের সিনেমা হলেই দেখেছি। তবে শুনে অবাক হলাম, ছবিটির শুটিং নাকি থাইল্যান্ডের সত্যিকারের কাওয়াই নদীতে হয়নি। এ তথ্য ফারুক মঈনউদ্দীন তাঁর ভ্রমণগল্পে দিয়েছেন। এমনিভাবে প্রায় প্রতিটি গল্পের নামের মধ্যে চমক দিতে চেয়েছেন তিনি। যেমন, ‘অবাক নামের ভিয়েতনাম’, ‘সুদূর চীনের এককোণে’, ‘প্রাচীন লিজিয়াং’, ‘দ্বীপের নাম ম্যাকাউ’, ‘কোঙ্কান কন্যা গোয়া’।
‘কোঙ্কান কন্যা গোয়া’ গল্পটি পড়েছি আমি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে। ফারুক নিজের পেশার কারণে দীর্ঘদিন ধরে মুম্বাই শহরে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে তিনি ‘মুম্বাইয়ের চিঠি’ নামে একটি নিয়মিত কলামে সমকালীন মুম্বাইয়ে নানা দিক তুলে ধরে পাঠকদের আদৃত হয়েছিলেন। সে কারণেই মনে করেছি, ফারুকের ভারতভ্রমণের গল্পে অন্যান্য গল্পের চেয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ থাকবে। হলোও তাই। এখানে তিনি একেবারে ঝরঝরে ভাষায় গোয়ার কালাংগুট, কোলভা, মিরামার, আনজুনা, ভাগাটর, বাগাসহ বেশ কয়েকটা সৈকত ঘুরিয়ে এনেছেন সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষের বিবরণসহ। সঙ্গে তার প্রিয় অনুষঙ্গ ইতিহাস তো আছেই।
বিভিন্ন দেশের নানা ঘটনা, দৃশ্যের সঙ্গে নিজের দেশের সাদৃশ্য খুঁজে বেড়িয়েছেন অথবা তুলনা করেছেন কখনো, ‘আমাদের বান্দরবান, খাগড়াছড়ির সুউচ্চ পাহাড়গুলো মহাবালেশ্বরের কালচে গম্ভীর পাথুরে পাহাড়ের চেয়ে অনেক সবুজ ও সুন্দর’ (‘কোঙ্কান কন্যা গোয়া’); ‘শহরতলি যখন পার হচ্ছিলাম তখন পথে পড়ে বাংলাদেশের চিরপরিচিত শহরতলির মতো অবিকল ঘিঞ্জি বাজার, কাঁচাবাজারের বর্ধিতাংশ, ঝুলন্ত মাংসের খোলা দোকান….’ (‘অবাক নামের ভিয়েতনাম’)। এভাবেই দূরদেশের জানালা দিয়ে দেখেছেন বাংলাদেশকেও।
ফারুক মঈনউদ্দীনের দক্ষিণ এশিয়ার ভ্রমণগল্প সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে হয়ে উঠেছে উত্কৃষ্ট ভ্রমণসাহিত্যের উদাহরণ। তবে ভ্রমণসাহিত্যে পাঠকের প্রত্যাশা থাকে বর্তমান ভূগোলের সরস বর্ণিল উপস্থাপন। তাতে অতীতের ইতিহাস, তথ্য ও তত্ত্বের উপস্থিতি প্রাসঙ্গিক, তবে তা মাত্রারিক্ত হয়ে গেলে তা ভ্রমণের রস আস্বাদনে বিঘ্ন ঘটায়। এই বই পড়তে গিয়েও কোথাও কোথাও অতিরিক্ত তথ্যের ভার অনুভব করেছি। অবশ্য অনেক পাঠক আবার এ কারণেও বইটি সংগ্রহে রাখবে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৬, ২০১০
Leave a Reply