খসরু চৌধুরী নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। তিনি প্রথম বনযাত্রায় বাঘ দেখেছিলেন। সুন্দরবনের বাঘ গ্রন্থে শুরুতেই তিনি এ কথা বলেছেন। ১৯৭৪ সালের কথা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯ বছর। মূলত তখনই সুন্দরবনের সঙ্গে তাঁর একটি বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। সেই থেকে শুরু। তারপর কতবার যে বনে গেছেন, বাঘ দেখেছেন, বাঘের মুখোমুখি হয়েছেন তার সঠিক হিসাব বোধ করি তিনি নিজেই জানেন না। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা আর বিচিত্র সৌন্দর্যের সুন্দরবন তাঁর জীবনকে সাজিয়েছে ভিন্নভাবে। বাঘের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাঁর জীবন। আলোচ্য গ্রন্থে সেসব গল্পই তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। বইটি পড়ে মনে হয়েছে, এটি একটি চমৎকার উপন্যাসও হতে পারত। এর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য অণুগল্প। তার বলার ভঙ্গিও চমৎকার। আর এ সবই তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা, বিচার-বিশ্লেষণ, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ থেকে নেওয়া। লেখায় একদিকে যেমন অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়া যায়, অন্যদিকে ঘুরে বেড়ানোর যাবতীয় আয়োজন, সংশ্লিষ্ট জীবজগৎ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপুঙ্খ বয়ানও পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও আছে সরস আলোচনা। ভাষার ওপর তিনি যে একজন দখলদার, বইটিতে তার প্রমাণ আছে। লেখক বড় বড় শিকারি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘যারা ভালো শিকারি তারা একেবারেই ভালো গল্প বলিয়ে হন না।’ গ্রন্থের কোথাও কোথাও তার প্রমাণ মেলে।
সুন্দরবনের বাঘ আমাদের জাতীয় পশু। এরা বেঙ্গল টাইগার নামে পৃথিবীবিখ্যাত। এ বাঘ নিয়ে আমাদেরও অনেক গর্ব, অনেক কৌতূহল। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে কত চটকদার কাহিনি। আছে কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা। এ বইয়ে লেখক খসরু চৌধুরী এসব ভুল ও কুসংস্কারের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তুলে ধরেছেন প্রকৃত তথ্য। যেমন, সব বাঘ মানুষখেকো নয়, বাঘের ঘ্রাণশক্তি ততটা প্রখর নয়, বাঘ কয়েক দিনের বাসি বা পচা মড়িও খায়। লেখক মোট ১২ পর্বে আমাদের এ রাজসিক প্রাণীটির জীবনপ্রণালী তুলে ধরেছেন। আমাদের দেশে সুন্দরবন নিয়ে কিছু প্রকাশনা থাকলেও সে তুলনায় বাঘ সম্পর্কে তেমন কিছু নেই। ২০০৪ সালে আইইউসিএন বেঙ্গল টাইগার ইন দ্য বাংলাদেশ সুন্দরবনস নামে একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। তবে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে দুটো বই আলাদা। সুন্দরবনের বাঘ গ্রন্থে পাঠকমাত্রই কল্পনায় বাঘ দেখবেন, তার হিংস্রতা উপভোগ করবেন, তার সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠবে অচেনা এক বনের ছবি।
গ্রন্থের মূল বিষয় বাঘ হলেও প্রসঙ্গত অনেক দরকারি তথ্যের অবতারণা করেছেন লেখক। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, আকৃতি-প্রকৃতি, বাস্তুসংস্থান, ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান, বিপন্নতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একাধিকবার কথা বলেছেন তিনি। ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কাউই দ্বীপের পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট ওয়েলিতে। …এরপরই ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার চেরাপুঞ্জির স্থান।’ ব্রিটিশ আমলে ১৮৯১ সালের দিকে উভয় সুন্দরবনকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ছয়টি রেঞ্জে ভাগ করা হয়। এসব তথ্য লেখক বেশ দক্ষতার সঙ্গেই ব্যবহার করেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছপালার দেখা মেলে সুন্দরবন ও ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপে।
বাঘ বেড়াল গোত্রের সবচেয়ে বড় প্রাণী। বিগত ৫০ বছরে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় বাঘটি ১৯৬৫ সালের ২ এপ্রিল আঠারোবেঁকি এলাকায় মেরেছিলেন কিংবদন্তি শিকারি পচাব্দী গাজী। বাঘটির দৈর্ঘ্য ছিল ১১ ফুট নয় ইঞ্চি। লেখক বাঘ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার মাত্র ৫/১০ মিটার দূর থেকে বাঘ দেখেছেন। কটকার বাঘ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি বেশ ভয়ার্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। সারা রাত মাত্র ১০ ফিট উঁচু মাচায় বসে ছিলেন বাঘ দেখার জন্য। ভোরে মাচা থেকে নেমে হাঁটতে লাগলেন। এমন সময় হরিণেরা দলবেঁধে সশব্দে তাঁর দিকে ছুটে আসতে লাগল। ওদের পেছনে বাঘ আছে ভেবে তিনি বোকার মতো উন্মুক্ত বালিয়াড়িতে শুয়ে পড়লেন। ‘আমার হার্টবিট এত বেড়ে গেল যে কানে ধপধপ করে লাগছে। এভাবে চললে তো স্ট্রোক করতে পারি। …কতটা সময় এ রকম রয়েছি কে জানে? …উঠে দাঁড়ানোর পর আমরা বাঘের ছাপ দেখতে পেলাম। আমি যেখানে পড়ে ছিলাম, তার ২৫ মিটার দূরে বাঘ এই রাস্তায় এসেছে।’ এ গ্রন্থে এমন অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা পাওয়া যাবে।
বাঘের শারীরিক গড়ন ও পারিবারিক সংগঠন—এ দুটি অংশে জানা যাবে ওদের প্রজনন মুহূর্তের বিস্তারিত বর্ণনা, বাচ্চা লালনপালন, খাদ্যাভ্যাস, শিকার ধরার কৌশল ইত্যাদি। জানা যায় যে, বাঘ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র আড়াই ঘণ্টা কর্মতৎপর থাকে। এর চেয়ে বেশি তৎপরতা দেখানোর মতো শারীরিক সক্ষমতা তার নেই। বাকি সময় গাছের ছায়ায় বসে শক্তি সঞ্চয় করে। সুন্দরবনের বাঘ শীতকালে বিকেল চারটা, গরমের দিনে সাড়ে পাঁচটার দিকে শিকারে বের হয়। এ কারণেই বাঘের সঙ্গে যখন-তখন আমাদের দেখা হয় না। লেখক এ তথ্যগুলো জানিয়েছেন একান্তই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। মূলত এ কারণেই গ্রন্থটিকে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য গ্রন্থ থেকে আলাদা করা যায়। লেখকের এই নিজস্ব অভিজ্ঞতার বয়ানকে আমরা গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।
গ্রামে ঢোকা বাঘ নিয়ে চমকপ্রদ বর্ণনার পাশাপাশি একটি পরিসংখ্যান থাকলে ভালো হতো। তবে বাঘ কেন গ্রামে ঢোকে এমন প্রশ্নের জবাবে দুটো প্রধান কারণ উঠে এসেছে। প্রথমত, বন উজাড়ের ফলে সৃষ্ট খাদ্যসংকট; দ্বিতীয়ত, পোষা গরু-মোষের উৎপাতে বাঘের স্থানীয় খাবারগুলো এলাকা ত্যাগ করার ফলে সৃষ্ট খাদ্যসংকট। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ আমাদের অবশ্যই খুঁজতে হবে। বইয়ের কোথাও কোথাও একই তথ্য একাধিকবার ব্যবহূত হয়েছে, কোনো কোনো বাক্য আরও নির্মেদ ভাষায় উপস্থাপন করা যেত। সবকিছু মিলিয়ে সুন্দরবনের বাঘ বইটি বেঙ্গল টাইগার ও সুন্দরবন সম্পর্কে আমাদের আরও বেশি উৎসাহী করে তুলবে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৬, ২০১০
Leave a Reply