সলিমুল্লাহ খান ছফা নিয়ে তাঁর ভাবগতিক চার-ভাগা করে সাজিয়েছেন, নাম রেখেছেন—ভাজক, ভাজ্য, ভাগফল, ভাগশেষ। একটা ভাঙাচোরা কাঠামোর ওপর নানা রং উড়তে উড়তে এসে একটা সুন্দর প্রতিমা জাগিয়ে দিলে যেমন হয়, আহমদ ছফা সঞ্জীবনী কেতাবের আলুথালু প্রবন্ধগুলো সেইভাবে চারিয়ে দিল আহমদ ছফার প্রতিমা।
ছফার একটা আদ্যোপান্ত বিগ্রহ-প্রতিষ্ঠার গোড়ার নকশা বোধ করি এই—ইনি চণ্ডাল মুসলমান। জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নে ছফার এমনধারা নিদানে ব্যথা পাওয়ার আগেই চণ্ডাল পদে চোখ রাখা ভালো। ‘যে জনগোষ্ঠীকে আহমদ ছফা নিজ জাতি, নিজ জ্ঞাতি জ্ঞান করেন তাদের নাম বাঙালি মুসলমান’—খুবই খাঁটি কথা, কিন্তু নোকতা দিয়ে রাখতে হবে যে তারা ভদ্দরনোক মুসলিম নয়, তারা মূলে চণ্ডাল।
সলিমুল্লাহ খান শুদ্ধ বুদ্ধিজীবী ভড়ঙে এই বই ফাঁদেননি, ছফার অন্তরের জ্যোতি তাঁর মর্ম ছুঁয়েছে, এই মর্ম ছোঁয়ার ব্যক্তিগত কাহিনি, আর তার জেবে লুকানো ভক্তি তিনি অকুণ্ঠে প্রকাশ করেছেন, যদিও এমন উপসর্গ সলিমুল্লাহ খানের মধ্যে বিরল।
এ দেশে গুরুচর্চা প্রায় সর্বজনীন ব্যাপার, বই-পুস্তকের আড়তেও গুরুমশাইরা নিত্য হানা দিয়ে চাল-কলা পেয়ে থাকেন—যার নজির পাওয়া যায় স্মারকগ্রন্থের বহর দেখলে। খান ভক্তির নৈবেদ্য সাজিয়েছেন, কিন্তু তার মধ্যে কোনো অন্ধত্ব নেই। ভক্তি ও ভালোবাসার স্রোতের মধ্যে খান কীভাবে বুদ্ধির নাক জাগিয়ে রাখেন তার একটা দৃষ্টান্ত দিই, ‘শেষ কয়েক বৎসর তাঁর অন্নকষ্ট আমি নিজ চোখে দেখেছি। …যখনই তাঁকে দেখেছি কোনো শয়তানের সঙ্গে পাঁয়তারা করছেন, তাঁদের কারও কারও পয়গম্বর নামে কাতর হচ্ছেন তখনো আমরা কিছু করার উপায় দেখি নাই। দুঃখ পেয়েছি।’
খুব সতর্ক একটা খাঁড়ির মধ্যে এই বই ভক্তির নতুন মার্গ আশ্রয় করেছে। এইভাবে তার ফল ফলল যে, ছফার মতো গুরুতর ব্যক্তির ছুরির মতো ধারালো পাঠ এই কেতাবে মিলছে। আলাপ একটু সবিস্তার করতে হচ্ছে। বইয়ের প্রথম ভাগ—ভাজক। এই পেটিকায় লেখক রাখছেন ছফার স্মরণ। স্মৃতির কোনাকানছির মধ্যে উনি রেখে যাচ্ছেন ছফার ‘ব্যাকরণ-অশুদ্ধ’ নামের রাজনীতি, ছফার বঙ্কিম-বিচারে নিজের অমতের যুক্তি। ছফা চাষি-মুসলমানের ছেলে, ছফার মধ্যে তিনি চাঁড়াল মুসলমান কৃষকের প্রতিকৃতি খুঁজে পেয়েছেন, খানের বিচার—‘আমাদের দেশে কৃষকই আমাদের সত্য নায়ক।’ স্মৃতি চিপড়ে নিলে অনেক শুদ্ধ আবেগ মিলবে—খেদ-অভিমান-ক্রোধ—এ রকম ক্রিটিক্যাল বইতে এসব বৃত্তির ওজন কম, কিন্তু লেখকের সঙ্গে ছফার রিশতা শুদ্ধ টেক্সুয়াল না, এই রিশতা ‘শারীরিক ও মাটিবর্তী’। এসব নিরিখ ইয়াদ না থাকলে পাঠে গড়মিল হওয়ার আশঙ্কা।
ভাজ্য এই কেতাবের নাভি। ‘যে ভাগ পাঠ করিলে ছফার রাজনীতি বুঝিতে পারা যায় তাহার নাম ভাজ্য’। ছফার ধারণা বুঝতে তিনি মহৎ তরিকা নিয়েছেন, ছফার মনের ভাবটা বলেছেন, যেখানে ভাবটা খাটো ঠেকেছে সেখানে উনি নিজের মত জুড়ে দিয়ে লম্বা করেছেন, কোথাও কোথাও বাহাস করেছেন, অর্থাৎ যেখানে খাদ পড়েছে সেখানে সংশোধন করে ছফার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বইকে বিরাট করে নিয়েছেন। শহীদে কারবালার ভূত মীর মশাররফ হোসেনের কান্ধে চড়েছে—তার প্রথম সাক্ষ্য দিলেন ছফা, আর খান এই ভূত বওয়ার অন্তঃস্থ স্রোত হিসেবে আমল করছেন ‘বাঙালি মুসলমানের অজ্ঞান’। এই ভাগে ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’ নামের বড় প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত ক্ষুদ্র পটে এত বিরাট ছবি আমি কখনো দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাবালক লেখা অল্প, চৌদ্দ আনাই রেটোরিকসে গদগদ; এই ভিড়ের মধ্যে ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’ খড়ের গাদায় সুই পাওয়ার মতো।
ছফার বরাতে লেখক জানাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধ দুটি প্রশ্ন সামনে আনে—জাতিগত আত্মপরিচয় আর রাষ্ট্রাদর্শ। জাতিগত আত্মপরিচয় মানে জাতীয় মুক্তি। জাতীয় পরিচয়ের সওয়ালে ছফার বিচার—‘জাতীয় পরিচয় বা সংজ্ঞা আর জাতীয়তাবাদ এক কথা নহে। জাতীয় মর্যাদা দরকার। তাহা আমাদের সারা দুনিয়ার নিপীড়িত জাতির সহিত এক কাতারে দাঁড় করাইবে। এই পথ মিলনের। আর তথাকথিত জাতীয়তাবাদ আমাদের আলাদা করিবে।’ এই ঠেকনার জোরেই ‘বাঙালি মুসলমান’ প্রপঞ্চ সাম্প্রদায়িক লাঠালাঠি আর জাতীয়তাবাদী কোঁদাকুঁদি থেকে রেহাই পাবে। কিন্তু ল্যাঠা বাঁধছে ছফার এই জবানিতে যে, ‘বাংলাদেশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই বাঙালি; হিন্দুত্ব মুসলমানিত্ব এবং উপজাতিত্ব এখানে প্রধান নয়।’
ছফার বঙ্গবন্ধু-প্রীতি বাতেনি কিছু না, তিনি নিজেই যথাসাধ্য জাহির করেছেন। তাতে দোষ ছিল না, কারণ একটেরেভাবে মুজিব-বিচার তিনি করেননি। কিন্তু এই বয়ান ছফা মুজিব থেকে ফটোকপি করেছেন। এইভাবে ‘তালগাছ’ দাবি করে বসলে আগের ঠেকনার বিচার আর জারি থাকে না। সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রশ্নে ‘জাতীয় পরিচয়’ কথাটা দ্বিধার দায়ে কাটা পড়ে, বাঙালির ব্যাটাগিরি ফলানো আস্ফাালনের মুখে ‘জাতীয় পরিচয়’ তড়িঘড়ি জাতীয়তাবাদী টোপর পরে নেয়। তখন বঙ্কিম, নেহরু বা রবীন্দ্রনাথের মতো জাতি-গরবিনীদের থেকে তাঁকে যুদা করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
আহমদ ছফা এই বাংলার বুদ্ধিজীবী ছিলেন, জীবনের প্রত্যেক ঘাটে তিনি এই সাবুদ থুয়ে গিয়েছেন। তাঁর জীবনে তোলা প্রত্যেক প্রশ্ন কেবলা হিসেবে বাংলাদেশের শরণ নিয়েছে। আদিবাসী প্রশ্নে তাঁর অমন কট্টর মনোভাবে সন্দেহ জাগে, দড়িতে পা দিয়ে হাঁটার মতো সতর্কতায় ‘জাতীয় পরিচয়’-এর পথে হাঁটলেও শেষমেশ তার মক্কা হয়ত গিয়ে ঠেকে জাতীয়তাবাদী ঘাটে।
ভাগফল ছফার সাহিত্য-বিচারের ভাগ। লেখক মূলত লাকাঁনীয় মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের আলোয় ছফার উপন্যাস পড়তে চেয়েছেন। সাহিত্য-সমালোচনায় এটি বাংলাদেশে নতুন দৃষ্টান্ত। ওঙ্কার নিয়ে একগাদা লেখা ছাপা হয়েছে—আসলে সবটা মিলে একটাই লেখা, তাই পুনরুক্তির ভারে নুইয়ে গেছে কিছুটা।
এই ভাগের দ্বিতীয় ভাব ছফাস্তুতি। ছফার লেখার শ্রেষ্ঠত্ব, গৌরব, মাহাত্ম্য বয়ানে লেখক অনেক সময় ব্যয় করেছেন। যেমন, ‘…যে কাঠিতেই মাপা হোক, আহমদ ছফা দুনিয়ার যেকোনো দশজন সেরা কাহিনী লেখকের সমান মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য।’ বা, ‘আমি সত্য সত্যই আহমদ ছফার সাথে তুলনা করবার মতন লেখক আজকের বাংলাদেশে খুঁজে পাই না।’ কিন্তু এসব বাহাসের ময়দানে না তোলায় সিদ্ধান্ত ভারি এতিম হয়ে গেছে।
সলিমুল্লাহ খানের এই বই বাংলা সাহিত্যের ওজন বৃদ্ধি করেছে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৬, ২০১০
Leave a Reply