বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ছয় ঋতুর বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর বহু কবিতা ও গানে। এসব কবিতা গানে ফুটে উঠেছে বাংলার প্রকৃতি, জনগণের এবং জনমনের আকুলতা, ব্যাকুলতা, মনন, চিন্তা-চেতনা। এসো হে বৈশাখ এসো এসো গানে রবীন্দ্রনাথ হালকাভাবে এনেছেন বৈশাখী ঝড়ের প্রসঙ্গ। কিন্তু প্রবলভাবে এ গানে এসেছে বাংলার আবহমান হালখাতার চেতনা। হালখানা শুধু ব্যবসায়ীদের জন্য নয়ণ্ডহালখাতা সকলের জন্য। যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরা সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি, জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক। পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাকণ্ডআমাদের নতুন বছরে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব, পৌষ মেলা থেকে শুরু করে বহু উৎসব পালন করেছিলেন কিন্তু নববর্ষের উৎসবকে উৎসাহিত করেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। হালখাতার কাব্যিক ভাষ্যণ্ডআমাদের জীবনে ছড়িয়ে পড়তে পারত। শান্তিনিকেতনের ছাত্রী সঙ্গীতশিল্পী অধ্যাপিকা সনজিদা খাতুন আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অত্যন্ত সফলভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন হালখাতার রবীন্দ্রভাষ্যকে। রমনার বটতলা থেকে নববর্ষের এ চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সকল বটতলায়ণ্ডবাংলাদেশের সর্বত্র।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম চৈত্র-বৈশাখ থেকে বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর গান রচনা করেছেন। বৈশাখী পংক্তিমালায় তিনি রবীন্দ্র বলয়ে আবদ্ধ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের হালখাতার চেতনা নজরুল পংক্তিমালায় নেই বললে চলে। নতুন ইমেজের মধ্যে নজরুল বিপ্লবের ইমেজ এনেছেন। ঝড়ের মতো বিপ্লব এসে আমাদের পুরানো ধ্যান-ধারণা ভেঙ্গে দেবে। ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চিরসুন্দরণ্ড তোরা সব জয়ধ্বনি কর। বৈশাখী গানে নজরুল রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেশি অনুসরণ করেছেন। ‘দারুণ অগ্নিবাণেরে’ গানের সঙ্গে তৃষিত আকাশ কাঁপেরে গান, প্রখর তপন তাপে, কপোত ইত্যাদির ব্যবহার এবং মিল আমাদের বিস্মিত করে। সারং রাগ এবং বৈচিত্র্যের সচেতন ব্যবহার হয়তো নজরুলকে কিছুটা আলাদা করেছে।
নজরুল অত্যন্ত বড় প্রতিভা ছিলেন। ফলে বৈশাখী গান অথবা বৈশাখের আগমনী গানেও তিনি চমৎকারিত্ব আনতে সক্ষম হয়েছেন, ‘সরজে গম্ভীর গগনে কম্বু/ নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভূ।’ এ গানটি উন্নত মানসম্পন্ন এবং সমকালে গানটি দিলীপ রায় এবং অতুল প্রসাদ সেনের প্রশংসা ধন্য হয়েছিল। ‘মেঘবিহীন খরবৈশাখে’, ‘কে দূরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশরী।’ ওগো বৈশাখী ঝড় লয়ে যাও অবেলায় ঝরা এ মুকুল/ লয়ে যাও বিফল এ জীবনণ্ডএই পায়ে দলা ফুলণ্ডএ গানগুলোর কল্পনা, কথা ও সুরের গাঁথুনী অত্যন্ত চমৎকার।
এক সময় বাংলার লোকজীবনে বারমাস্যার প্রচলন ছিল, বারমাস্যায় লোককবিরা প্রোষিতভর্তৃকা নারীদের বারো মাসের বিরহ বেদনা তুলে ধরতেন। যেমন, চৈত্র গেল বৈশাখ গেল, গাছে ধরল আম/ স্বামী আমার কাছেতে নাই কারে খাওয়াইতাম। নজরুল ইসলাম বাংলার এই আঙ্গিকটি গ্রহণ করে চমৎকার কয়েকটি গান রচনা করেছিলেন। আমরা প্রথমে বলতে পারি, একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী গানটির কাথ। এ গানে ছয় ঋতুতে অথবা বিভিন্ন মাসে লোক বাংলার যে রূপ-বৈচিত্র্য আসে সেটি তুলে ধরেছেন। যেমন, ‘রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল/আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল/ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি।’ নতুন বছরকে বরণ করতে গিয়ে আমরা প্রাকৃতিক রূপের বর্ণনা করব। নজরুল এ গানে বারমাসীর আঙ্গিকে বৈশাখ, বর্ষা, শরতে, অঘ্রাণে, শীতে, ফাল্গুনে বাংলার রূপবৈচিত্র্য তুলে ধরেছেন। বার মাস্যার আঙ্গিকে রচিত নজরুলের আরেকটি বিখ্যাত গান: তোরা চলিসলো সখী মাধবে মথুরায়/ কেমনে রাধার কাঁদিয়া বরষ যায়।’ মথুরায় চলে গেছেন কৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে। রাধা বিভিন্ন ঋতুতে তার মনের অবস্থা বর্ণনা করছেন, অবিকল বারমাস্যার নারীদের মতো। বরষায় অবিরল/ঝর ঝর ঝরে জল/ জুড়াইল জগতের নারী/ রাধার গলার মালা/ সখিরে হইল জ্বালা/তৃষ্ণা মিটিল না তারি।/ঃ জ্বালা তার জুড়াই না জলে গো/ শাওনের জলে তার মনের আগুন যেন দ্বিগুণ জ্বলেগো/ জ্বালা তার জুড়াইনা জলেগো। কৃষ্ণমেঘ গেছে চলে সখি, অকরুণ অশনি হানিয়া হিয়ায়। এখানে নজরুল রাধা কৃষ্ণ, বারমাস্যার ঐতিহ্য, কীর্তনের আঙ্গিক-ঐতিহ্য সবই ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সফলভাবে।
ঐতিহ্য সচেতন নজরুল বর্ষা ও বসন্তের গানে আরো অনেক কৌশল ব্যবহার করেছেন। বর্ষা-কেন্দ্রিক গানে নজরুল কালিদাসের মেঘদূত কেন্দ্রিক বিভিন্ন ইমেজ এবং রাধা-কৃষ্ণ কেন্দ্রিক কাজরী ও জুলনের আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন। যেমন, মেঘদূত-কেন্দ্রিক ইমেজসমূহ ১. যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে আমার বিরহলিপি লেখা কেয়া-পাতে। ২. পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে বলিও আমার পরদেশীরে। ৩. আজ শ্রাবণের লঘু মেঘের সাথে/ মন চলে মোর ভেসে/ রেবা নদীর বিজন তীরে মালবিকার দেশের। ৪. স্নিগ্ধশ্যাম বেনীবর্ণ এসো মালবিকা/ অর্জুন মঞ্জুরী কর্ণে গলে নীপ মালিকা। অন্যদিকে উত্তর ভারতের কাজুরী ও ঝুলনের ঐতিহ্যকে বাংলায় এনে রাধা কৃষ্ণকে নতুনরূপে উপস্থাপন করেছেন নজরুল। নজরুলের জনপ্রিয় কাজরী: শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলনা/কাজরীর কাজল মেঘ পথ পেল খুজিয়া/ সেকি ফেরার পথ পেল না মা পেল না। রাধা-কৃষ্ণ আসবেন এ বর্ষায়। তারা দোল খাবেন। তাদের জন্য ঝুলন বাঁধতে হবে। রাধাভাবে ভাবিত সখীরা তাই গাচ্ছেনণ্ডবাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া।/নামিল মেঘলা মোর বাদিরয়া/ চল তমাল তলে গাহি কাজরিয়া/ চললো গৌরী শ্যামলিয়া।
বসন্ত কেন্দ্রিক অনেক গান লিখেছেন নজরুল। বর্ষার গানের মতো বসন্তের গানেও প্রকৃতির সঙ্গে নর-নারীর মনের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এবং সে সঙ্গে মিশিয়েছেন বাংলা তথা ভারতীয় ঐতিহ্যকে। আসে বসন্ত ফুলবনে/ সাজে বনভূমি সুন্দরীণ্ডএ গানে মূলত প্রকৃতির বর্ণনা করেছেনণ্ডতবে পারসনিফিকেশনও করেছেন যথেষ্ট। কিন্তু ঐতিহ্য সচেতন কবি-ঐতিহ্যের ব্যবহার করবেনই-প্রকৃতির রূপ-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনের অবস্থার যে পরিবর্তন হয়-তাও তুলে ধরবেন। যেমন, ব্রজগোপী খেলে হোরী সানো নজরুল কি যেন কিছু করেছেন। এ গানে প্রকৃতির বর্ণনা আছেণ্ড বলেছেন, হরিত্র কুঞ্জ, পুঞ্জে পুঞ্জে হোরি অশোক ফোটার কথা। অন্যদিকে বলেছেন, ব্রঞ্জের গোপীবৃন্দের খেলার কথা। হোলী উপলক্ষে হোরি খেলছে সবেণ্ডরাধাভাবে ভাবিত সখীবৃন্দ এবং কল্পনার রাধা-কৃষ্ণ। তাদের মনের অবস্থা/ গোপিনীরা হানে সপাঙ্গ খরসার ভ্রুকুটি ভঙ্গ/ অনঙ্গ আবেসে জর জর থর থর শ্যামের অঙ্গ।
নববর্ষ এলে আমরা আমাদের দেশ, দেশের প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হবো, বর্ষবরণ করব। প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে নর-নারীর মানসিক পরিবর্তনের কথা জানবো। সবার ওপরে আমাদের বুষতে হবে ‘হালখাতার’ প্রতীকী ব্যাখ্যাণ্ডযেটা রবীন্দ্রনাথ এসো হে বৈশাখ, এসো এসো গানে চমৎকারভাবে বুঝিয়েছেন। নতুন বছরে নতুনভাবে জীবন শুরু করব। জীবনের নতুন খাতা হালখাতা অর্থাৎ বর্তমানের খাতা খুলব। নববর্ষে এখন সাংস্কৃতিক হালখাতা সম্পর্কে সচেতন হয়েছি। প্রত্যেক নববর্ষে যদি আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির হালখাতা খুলতে পারি, তাহলে সেটি দেশের জন্য আরো মঙ্গল বয়ে আনবে।
রাজীব হুমায়ূন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ০৯, ২০১০
Leave a Reply