রান্নার বিভিন্ন পদ্ধতি – সিদ্দিকা কবীর
সিদ্ধ : শাক-সবজি, ডাল, ভাত, মাছ, মাংস ইত্যাদি খাদ্য পানি বা অন্য তরল পদার্থে ফুটিয়ে সিদ্ধ করে রান্না করা হয়। এ্টাই রান্নার সহজ এবং সাধারণ পদ্ধতি। দৈনন্দিন রান্নায় এই পদ্ধতি ব্যবহার হয়।
ভাপে সিদ্ধ : ফুটানো পানি থেকে যে বাষ্প উঠে, সেই বাষ্পের উত্তাপে সিদ্ধ করাকে ভাপে সিদ্ধ করা বলে। ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, পুডিং, কাঁচা নুডলস এভাবে ভাপে সিদ্ধ করে নেয়া হয়।
ভাপে সিদ্ধ করার জন্য অর্ধেক হাঁড়ি পানি নিয়ে হাঁড়ির মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধতে হবে। হাঁড়ির পানি ফুটে বাষ্প উঠতে আরম্ভ করলে কাপড়ের উপর খাবার দিয়ে ঢাকনা দিতে হবে। খাবার সিদ্ধ হলে পরে ঢাকনা খুলে খাবার তুলে নিতে হবে। হাঁড়ির মুখে কাপড়ের পরিবর্তে ঝঁঝরি বসিয়ে ভাপে সিদ্ধ করা যায়। ভাপা পিঠার জন্য বিশেষ রকমের মাটির হাঁড়ি পাওয়া যায়। গ্রামাঞ্চলে বড় হাঁড়িতে অল্প পানি নিয়ে হাঁড়ি খড় দিয়ে ভরা হয়। পানি ফুটলে খড়ের ভিতর দিয়ে বাষ্প উঠে। পাতা পিঠা খড়ের উপর বিছিয়ে দিলে বাষ্পের ভাপে সিদ্ধ হয়্। ভাপে পুডিং তৈরি করার জন্য এ্যালিউমিনিয়ামের সসপ্যানে পানি ফুটিয়ে পুডিং-এর মোলড বসানো হয়। মোলডের এক চতুর্থাংশ পানির নীচে থাকে। সসপ্যান পানি বেশি হলে তা ফুটার সময় মোলডের ভিতরে ঢুকতে পারে। যে পাত্রে পুডিং দেয়া হয় সে পাত্রের মাপ মতো ঢাকনা দিয়ে ঢাকলে পুডিং ভাল হবে। পুডিং-এর পাত্র না ঢেকে সসপ্যান ঢাকনা দিলে পুডিং-এ পানি পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
ভাজা, ডুবো তেলে ভাজা : খাবার অল্প তেলে এবং ডুবো তেলে দু’ভাবেই ভাজা হয়। মাছ, সবজি, পরোটা ইত্যাদি অল্প তেলে ভাজা যায়। ডুবো তেলে ভাজার জন্য কড়াইয়ে একবারেই বেশি তেল দিতে হবে। ভাজা শেষ হলে তেল ছেঁকে রান্নার জন্য রাখা যায়। ডুবো তেলে ভাজার জন্য তেল গরম করে 180º সেঃ তাপে আনতে হবে। তেলের তাপ পরীক্ষা করার জন্য পাউরুটির কুচি বা শুকনা শাকপাতা তেলে ছাড়লে চারদিকে বুদবুদ উঠলে বুঝতে হবে ভাজার জন্য তাপ ঠিক আছে। তেলের তাপ সব্ সময় এক রকম রাখতে হবে। কম বা বেশি তাপ দুটোতেই ভাজা ভাল হয় না। লুচি ডুবো তেলে অল্প ভাজতে হয়। কিন্তু ডালপুরী, সিঙ্গারা, সমুসা, পটেটো চিপস গরম তেলে বেশ কিছুক্ষণ না ভাজলে পরে নেতিয়ে যায়। চপ, কাটলেট টোস্টের গুঁড়ায় গড়িয়ে নিয়ে ডুবো তেলে ভাজতে হয়। প্রন টেমপুরা, ফুলকো ইলিশ ইত্যাদি গোলানো ময়দায় ডুবিয়ে ভাজা হয়। ভাজার জন্য তেল খুব বেশি গরম করলে তেল থেকে ধোঁয়া বের হয়। এ-তেলে খাবার ভাজলে সে খাবার দেরিতে হজম হয়। তাই তেলেভাজা খাবারকে গুরুপাক খাবার বলে। তেল থেকে যাতে ধোঁয়া না উঠে সেজন্য ভাজার সময় তেল 180º সেঃ তাপে রাখা দরকার। এতে ভাজাও সুন্দর হয়।
সেকা, টালা : তেল, পানি এসব তরল উপকরণ ছাড়া শুধু তাওয়ায় এবং খোলায় খাবার সেকে বা টেলে নেয়া যায়। রুটি সেকা হয়। জিরা, ধনে, শুটকী খোলায় টালা হয়। কাঁচা মাছ টেলে ভর্তা করা যায়। আবার মাটির পাতিলে বালু গরম করে তাতে মুড়ি ও খই টেলে ভাজা হয়।
ঝলসান, পোড়ান : খাবার সরাসরি আগুনের কাছে এনে তাপ দেয়াকে ঝলসান বা পোড়ান বলে। আলু, বেগুন, মিষ্টি আলু আগুনে পুড়িয়ে নরম করা হয়। কাঁচা আম, কাঁচা তেঁতুল, জলপাই, বেল ইত্যাদি কাঠকয়লার আগুনে পোড়ান যায়। শিক কাবাব, বোটি কাবাব, চিকেন টেক্কা ইত্যাদি কাঠ কয়লা অথবা বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসের আগুনে ঝলসান পদ্ধতিতে রান্না হয়ে থাকে।
বেকিং : তন্দুর এবং ওভেনে খাবার বেক করা হয়। খাবার ওভেনে দেয়ার আগে ওভেন গরম করে নিতে হবে। তন্দুর বা ওভেনের মধ্যে খাবারের উপরে, নীচে এবং চারদিকে সমান তাপ পড়ে। পাউরুটি, কেক, বিস্কুট, পাই, পিজজা, পেস্ট্রি ওভেনে বেক করা হয়। মাছ, মাংস, সবজি পুডিং, কাচ্চি বিরিয়ানী ইত্যাদিও ওভেনে রান্না করা যায়। ওভেনে মৃদু তাপে পোলাও জর্দা রেজালা দমে দেয়া যায়। বেকিং পদ্ধতিতে রান্নায় পরিশ্রম কম হয়।
সিদ্ধ, ভাজা, বেকিং, ঝলসানো রান্নায় এসব মূল পদ্ধতিতে কতক কৌশল প্রয়োগ করে খাবারের ঘ্রাণ, স্বাদ, রঙ ও জমিনে বৈচিত্র আনা যায়। এই পদ্ধতিগুলো–
স্টুয়িং : মাছ, মাংস, সবজি অল্প কোন তরল দ্রব্য যেমন দুধ, পানি সস দিয়ে মৃদু আঁচে ঢেকে ধীরে ধীরে ফুটানো। বিফ স্টু (পৃষ্ঠা ২৩৬) এই পদ্ধতিতে রান্না হয়।
ব্রেইজিং : ঢাকনা দেয়া পাত্রে সামান্য তরল দ্রব্যের মধ্যে ধীরে ধীরে মৃদু আঁচে রান্না করা। মিটস্টক, পানি দুধ, ক্রিম, সস এসব তরল দ্রব্য ব্যবহার করা যায়। ব্রেইজিং পদ্ধতিতে সাধারণত মাংস, মাছ রান্না করা হয়। মাংস প্রথমে ময়দায় গড়িয়ে অল্প তেলে বাদামি রং করে ভেজে নিতে হবে। তারপর ঢেকে মৃদু আঁচে রাখতে হবে। মাঝে মাঝে কিছু তরল দ্রব্য দিয়ে উল্টে দিতে হবে।
প্যান ব্রয়লিং : তাওয়ায় বা ফ্রাইপ্যানে না ঢেকে রান্না করা। রান্নার সরম কোন তরল দ্রব্য দেওয়া হয় না। উদাহরণ বিফস্টেক, হ্যামবারগার স্টেক।
পোচিং : খাবারের আকার নষ্ট না করে অল্প পরিমাণ গরম পানি, দুধ কিংবা তেলের মধ্যে ভাজা বা রান্না করা। উদাহরণ ডিম পোচ।
গ্রীলিং : খাবারে সরাসরি তাপ দিয়ে রান্না করা। শুধুমাত্র উপর থেকে তাপ দিয়ে বা শুধু নীচ থেকে তাপ দিয়ে অথবা উপর নীচ দুদিক থেকে তাপ দিয়ে গ্রীল করা যায়। এই পদ্ধতিতে কম সময়ে রান্না হয়, পানি বা কোন তরল দ্রব্য দেয়া হয় না। গ্রীল করা খাবারের উপরিভাগ বাদামী রঙের ভাজা বা ঝলসানো মতো হলেও ভিতরে নরম থাকে। খাবারের উদাহরণ গ্রীল চীজ, গ্রীল চিকেন।
টোস্টিং : সরাসরি তাপ দিয়ে খাবারের বহিরাংশ বাদামী ও মচমচে করা। পাউরুটি টোস্ট করার পরে দু’পিঠ বাদামী ও মচমচে হয়।
স্ক্যালোপিং : টুকরা অথবা স্লাইস করা মাছ বা সবজির সঙ্গে দুধ কিংবা পানি বা সস মিশিয়ে স্তরে স্তরে বিস্কুটের গুঁড়া দিয়ে সাজিয়ে বেক করা। স্ক্যালোপড পটেটো এর উদাহরণ।
বারবিকিউয়িং : মাংস বা মাছে অল্প করে সস মাখিয়ে ধীরে ধীরে রোস্ট করা বা ঝলসান। খাবারের উপরিভাগ শুকিয়ে যাতে শক্ত হয়ে বা পুড়ে না যায় সেজন্য মাঝে মাঝে বিশেষভাবে তৈরি বারবাকিউ সস মাখিয়ে দিতে হবে। যেমন-বারবাকিউ চিকেন।
ক্যারামেলাইজিং : উনুনের উপরে বেশি তাপে সসপ্যান বা অন্য কোন পাত্রে চিনি গালিয়ে বাদামী রং করা। এভাবে গলানো বাদামী রঙের চিনিকে ক্যারামেল বলা হয়। সাধারণত পুডিং তৈরির আগে মোলডে চিনি ক্যারামেল করে নেয়া হয়। ক্যারামেল দিয়ে খাবারের রং গাঢ় করা যায়।
গ্ল্যাসিং : খাবার চিনির সিরার পাতলা আস্তরণ দিয়ে ঢেকে খাবারে চকচকে ভাব আনা। নানরুটি, ডিনার রোল, ডোনাটে গ্ল্যেইস করা হয়।
ডেমি গ্ল্যেইস : মাছ, মাংস রান্নার শেষে পানি শুকিয়ে গেলে বা গ্রেভি ঘন হলে তেল বের হয়ে চকচকে দেখায়। চকচকে গ্রেভীকে ডেমি গ্ল্যেইস বলা হয়।
Leave a Reply