বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে ভাতের পরে এককভাবে যে খাবারটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয় সেটি পিঠা। শীতের পিঠা নিয়ে এ লেখা।
শীতকালে শীতের পিঠা নিয়ে লোকসংস্কৃতি–বিষয়ক গবেষক অনার্য তাপস-এর লেখা শীতের পিঠা।
আখ্যান কাব্যে, গানে, লোকগল্পে, ছড়ায়, কবিতায়—কোথায় নেই পিঠা? দাসী কাঁকনমালার দুষ্টুবুদ্ধিতে পরাজিত রানি কাঞ্চনমালা পাটরানির আসন ফিরে পেয়েছিলেন চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা—এসব পিঠা বানিয়ে। আর দাসী কাঁকনমালা আস্কে, চাস্কে আর ঘাস্কে পিঠা বানিয়ে বেঘোরে নিজের পৈতৃক প্রাণটা খুইয়েছিলেন জল্লাদের হাতে।
এদিকে টোনাটুনির হাতে ধেড়ে বাঘকে নাজেহাল হতে হয়েছিল সেই পিঠা খাবার লোভেই। পিঠা নিয়ে এত সব গল্পগাছা যে দেশের মানুষের জীবনে ভেসে বেড়ায় জনপদ থেকে জনপদে, এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে, সে দেশের মানুষ গণ্ডা গুনে থালা থালা পিঠা খাবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
সংস্কৃত সাহিত্যের বরাতে বলা চলে, ভারতীয় উপমহাদেশে পিঠা খাওয়ার চল অনেক প্রাচীন। বাংলা ভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং মৈমনসিংহ গীতিকার কাজল রেখা আখ্যানে জনপ্রিয় খাদ্য হিসেবে পিঠার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই বইপত্রগুলো অনধিক ৫০০ বছরের পুরোনো। তবে প্রাচীন বইপুস্তকে যেহেতু পিঠা বানানো ও খাওয়ার কথা এসেছে, তাই ধরে নেওয়া যায় পিঠা খাবার ঐতিহ্য বাঙালি সমাজেও অনেক প্রাচীন।
পিঠা হলো চালগুঁড়া, ডালবাটা, গুড়, নারকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষ। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান। ধান থেকে চাল এবং সেই চালের গুঁড়া পিঠা তৈরির মূল উপাদান। চালের গুঁড়ার সঙ্গে প্রয়োজনমাফিক বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরিতে বিভিন্ন উপকরণ যোগ করা হয়।
বছরজুড়ে ঢাকা শহরে পিঠা পাওয়া গেলেও জমিয়ে পিঠা খাওয়ার আসল সময় শীতকাল। কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকা গ্রামীণ মানুষ পুরো বছর পিঠা খায় না। হেমন্তে নতুন ধান উঠে যাওয়ার পর আসে নবান্ন। তার পরেই আসে পৌষসংক্রান্তি। অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষ দিন। পৌষের হিম হিম ঠান্ডায় খোলা আকাশের নিচে পাতা উনুনের পাশে বসে গরমাগরম বাহারি পিঠা খাওয়া হচ্ছে—সুখী বাঙালি গার্হস্থ্য জীবনের আদর্শ দৃশ্য এটি। যদিও যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার পর এ দৃশ্য এখন বিরল!
বসন্তের আগমন পর্যন্ত চলে পিঠা খাওয়া। আদি নিয়মে মূলত মাঘ মাসে পিঠা খাওয়া শুরু, ফাল্গুনে শেষ। চৈত্রে পিঠা খাওয়া হয়, কিন্তু সেটা আর জমে না স্বাদে-স্বস্তিতে। সম্ভবত নতুন ধান থেকে তৈরি চালে যে সুঘ্রাণ আর আর্দ্রতা থাকে, পিঠা বানানোর আটা তৈরিতে সেই চাল আদর্শ। ধান যত পুরোনো হতে থাকে, ততই সে আর্দ্রতা হারাতে থাকে। ফলে সেই চালের আটায় তৈরি পিঠা আর সুস্বাদু থাকে না আগের মতো। হেমন্তে নতুন ধান উঠে গেলে নারীরা ঢেঁকিতে পিঠার জন্য চালের গুঁড়া বানাত। ‘বানাত’ বলছি, কারণ এখন আর ঢেঁকির প্রচলন খুব একটা নেই। এখন ‘কল’ থেকে গুঁড়া তৈরি করে আনা হয়।
বাংলাদেশে তৈরি পিঠা রন্ধনপ্রণালি অনুযায়ী দুই রকমের—ভাজা ও ভাপা। এই ভাজা ও ভাপা দুই ধরনের পিঠা কখনো দুধে চুবিয়ে দুধপিঠা আবার কখনো চিনি অথবা গুড়ের শিরায় বা খেজুরের রসে ভিজিয়ে রসের পিঠা তৈরি করা হয়। নকশি পিঠা আদতে নকশা করা ভাজা পিঠা। এটিকে দুধ, খেজুরের রস, চিনি বা গুড়ের শিরায় ভিজিয়ে অথবা না ভিজিয়েও খাওয়া যায়।
ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি, পোয়া পিঠা, ভাপা পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিটকা পিঠা, আস্কে পিঠা, চাঁদ পাকন পিঠা, সুন্দরী পাকন, সর ভাজা, পুলি পিঠা, পাতা পিঠা, পাটিসাপটা, মুঠি পিঠা, আন্দশা, লবঙ্গ লতিকা, নকশি পিঠা ইত্যাদি কত যে পিঠা খাওয়া হয় বাংলাদেশে, তার সঠিক কোনো হিসাব নেই কারও কাছে। তবে কিছু কিছু পিঠা পুরো বাংলাদেশেই খাওয়া হয়, আবার কিছু পিঠা নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে খুব কম খাওয়া হয়। যেমন: সিলেট অঞ্চলের চুঙ্গি পিঠা, বিক্রমপুর অঞ্চলের বিবিখান পিঠা ইতাদি।
মিষ্টিমণ্ডার চেয়ে সম্ভবত প্রাচীন বাংলায় মিষ্টান্ন হিসেবে পিঠার জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। চৈতন্যচরিতামৃতে দেখা যায়, পঞ্চাশ ব্যঞ্জনের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে ‘ক্ষীর পুলি নারকেল পুলি আর পিষ্ট’। বরিশালের বিজয় গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গলে বলছেন,
‘মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস।
দুই তিন প্রকারের পিষ্টক পায়স।।
দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ।
রন্ধন করিয়া হৈল হরসিত মন।।’
পিঠার রন্ধনপ্রণালি দেখলেই বুঝবেন এগুলো মিষ্টিজাতীয় পিঠা। এদিকে ভাটির দেশের যুবতী কন্যা কাজল রেখা চন্দ্রপুলি, ক্ষীরপুলির মতো ‘সুরস রসাল’ মিষ্টি পিঠা দিয়ে থালা সাজাচ্ছে।
‘চই চপরি পোয়া সুরস রসাল।
তা দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল।।
ক্ষীর পুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া।
রসাল করিল তায় চিনির ভাজ দিয়া।।’
কাজল রেখার পিঠার রন্ধনপ্রণালি খেয়াল করলেও দেখা যাবে পিঠাগুলো মিষ্টিজাতীয় এবং এগুলোর কোনো কোনোটা চিনির শিরায় চুবানো। উজান থেকে ভাটি সব জায়গার কন্যারাই দেখা যাচ্ছে পিঠা তৈরি করছেন মিষ্টি খাদ্য হিসেবে। এখনো বাংলাদেশের বেশির ভাগ পিঠা মিষ্টিজাতীয় এবং গুড়সহযোগে খাওয়া হয়। তবে কখনো কখনো ঝাল পিঠা খাওয়ারও প্রচলন রয়েছে। যেমন: চিতই পিঠা সরিষাবাটা কিংবা মরিচের ভর্তা বা শুঁটকির ঝাল ঝাল ভর্তা দিয়েও খাওয়া হয়। আবার ছিটা পিঠার আটায় মরিচ বাটা মিশিয়ে ঝাল করে ভাজা হয়। ছিটা পিঠা আবার হাঁসের মাংস দিয়েও খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে। তবে চিতই পিঠা খাবার আদি পদ্ধতি হলো ঝোলা গুড়সহযোগে খাওয়া।
পুলি পিঠার মূল উপাদান নারকেলের পুর। নারকেলের সঙ্গে আখ বা খেজুরের গুড়, তিল ইতাদিও দেওয়া হয়। আবার কখনো কখনো পুলি পিঠা বানানো হয় ঝাল তরকারি দিয়ে। মোটকথা, মিষ্টান্ন হিসেবে পিঠা খাবার আদি ব্যাপারটা ঠিক থাকলেও এখন স্বাদমতো পিঠা খাবার প্রচলন হয়েছে, যেখানে মিষ্টির পাশাপাশি থাকছে ঝাল, গুড়ের পাশে থাকছে ধনেপাতার ভর্তা, মরিচ–পেঁয়াজের ভর্তা, শুঁটকির ভর্তা, বেগুন ভর্তা, বিভিন্ন ডালের ভর্তা, হাঁস বা মুরগির ঝোল ইতাদি।
শীতের সকালে বা সন্ধ্যায় পাড়ার মোড়ে মোড়ে পিঠাওয়ালা বসে। তেলের পিঠা বা পুয়া পিঠা, চিতই পিঠা আর ভাপা পিঠাই মূলত বিক্রি করে তারা। আর সারা বছর কিনতে পাওয়া যায় পাটিসাপটা পিঠা। গ্রামবাংলায় এখনো ধানের বিনিময়ে ভাপা পিঠা কিনতে পাওয়া যায়। চিতই পিঠা খাওয়ার অনুষঙ্গ সবচেয়ে বিচিত্র—গলির মোড়ের বা কোনো জনবহুল জায়গার চিতই পিঠা বিক্রেতাকে দেখলেই সেটা বোঝা যায়। কোন এলাকার চিতই পিঠা বিক্রেতা কত পদের ভর্তা দিচ্ছে, তার ওপর তাদের খ্যাতি নির্ভর করে আজকাল। দুই–চার পদ ভর্তা তো বটেই, সতের পদের ভর্তাসহযোগে চিতই পিঠা খাবার অভিজ্ঞতা আছে কারও কারও। কী নেই সেখানে? সরিষাবাটা, ধনেপাতার ভর্তা, মরিচ–পেঁয়াজের ভর্তা, শুঁটকির ভর্তা, বেগুন ভর্তা, মসুর ডালের ভর্তা, ছোলা-কাবলির চাট, মাছের ভর্তা, কলা ভর্তা, কাঁচা মরিচের ভর্তা ইত্যাদি।
শত বছর ধরে চলে আসা এই জনপ্রিয় খাবারের সেকাল আর একালে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পিঠাকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত রাখার পুরো কৃতিত্ব নারীদের। সে কারণে পিঠার স্বাদের গুপ্ত বিদ্যার সন্ধান পাওয়া যায় গৃহিণীদের অভিধানেই।
অনার্য তাপস / শীতের পিঠা
লেখক: লোকসংস্কৃতি–বিষয়ক গবেষক
তথ্যঋণ:
মিলন দত্ত, বাঙালির খাদ্যকোষ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৫।
সোর্স – প্রথম আলো, ০৮ জানুয়ারি ২০১৯
Tanvir Ahmed
very nice post