শওকত আলী বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের লব্ধপ্রতিষ্ঠ শিল্পী। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছিলো ১৯৬৮ সালে সে বছরই তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। তার প্রথম উপন্যাসের নাম ‘পিঙ্গল আকাশ’। তরুণ বয়সের লেখা উপন্যাসটিতে যথার্থ মননশীলতা ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে একমাত্র শওকত আলী দু’ দুবার ‘ফিলিপস’ পুস্কার পেয়েছেন। একবার পেলেন ‘দক্ষিণায়নের দিন’ উপন্যাসের জন্য, আরেকবার পেলেন ‘উত্তরের খেপ’ উপন্যাসের জন্য। এরপর তিনি দেওয়ান মূর্তজা, অজিত গুহ, ২১ এর পদকসহ অগণিত পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মূলত শওকত আলী তার কৃতকর্মকে বাঙালি জাতির সামনে একটা উত্তুঙ্গ মাত্রায় তুলে এনেছেন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাস রচনা করে। তার সর্বোৎকৃষ্ট সৃজনক্ষমতা শোষণ করে নিয়েছে এই উপন্যাসটি। এখন শওকত আলী বললে এই উপন্যাসটির নামই সামনে চলে আসে। ১৯৮৩ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ১৯৮৪ সালে প্রকাশ করেছিলেন ‘দুষ্কালের দিবানিশি’। ১৯৮৪ সালেই সুবিখ্যাত প্রকাশনা ইউপিএল দুখন্ড একত্র প্রকাশ করে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ নাম দিয়ে। এ পর্যন্ত আটটি সংস্করণ বের হয়েছে উপন্যাসটির। এতে প্রমাণিত হয় যে, বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে শওকত আলীর এই সৃষ্টিশীল কাজটি সমাদৃত হয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীর বাংলাদেশের ইতিহাস প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর প্রেক্ষাপট। পাল আমলে চর্যাপদ রচিত হয়ে যাওয়ার পর, বাঙালি সংস্কৃতির একটা বহুমুখী ধারা বিকশিত হওয়ার পর বাংলায় সেন রাজত্ব শুরু হয়। সেনদের পক্ষপাত ছিল অভিজাত সংস্কৃত ভাষা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী, রক্ষণশীল সংস্কৃতির দিকে। কোনো শাসক যখন গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার আশ্রয় নেয়, তখন সে হয় জনবিচ্ছিন্ন, তার শাসনকালে দেখা দেয় অবক্ষয়। লক্ষণ সেনের রাজত্বেও তাই দেখা গিয়েছিল। প্রাকৃতজনেরা চাচ্ছিলো পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন হয় তুর্কী আগমনের পরে। তুর্কীদের আগমনের পূর্বক্ষণে সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচারের দরদমাখা উপাখ্যান চিত্রিত করেছেন শওকত আলী এই কালোত্তীর্ণ উপন্যাসে। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ সম্পর্কে প্রশ্নের আঙ্গিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখকের কাছে জানতে চেয়েছেন মাহমুদুল বাসার। তার নির্বাচিত অংশ ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকীর পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।
০ কথা প্রসঙ্গে আবদুল গাফফার চৌধুরী বললেন, শওকত পাওয়ারফুল রাইটার, কিন্তু তিনি তেমন মূল্যায়ন পাননি। যেমন পেয়েছেন হাসান আজিজুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
শওকত আলী: আমি বিষয়টা নিয়ে কখনো ভাবিনি। হাসান আজিজুল হক এবং অকাল প্রয়াত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস দুজনই অসাধারণ প্রতিভাবান এবং সৃজনশীল লেখক। বাংলা সাহিত্যে দুজনেরই অবদান অত্যন্ত প্রোজ্বল। তাদের লেখার মত আমার লেখার মূল্যায়ন যদি না হয়ে থাকে তো হয়নি, ব্যাস। এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করার কী আছে?
আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির মত কালজয়ী গানের রচয়িতা গাফফার চৌধুরীর মত সাংবাদিক-সাহিত্যিক যদি বিষয়টি নিয়ে কিছু বলে থাকেন, তাহলে সেটা তার নিজের অভিমত। এখানে আমার কিছু বলার নেই।
০ আপনাকে খ্যাতির একটা মাত্রায় নিয়ে গেছে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, এই উপন্যাসটি লেখার প্রেক্ষাপট একটু বলবেন?
শওকত আলী: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন একটি কালজয়ী ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এই ঘটনাটি একটি ভূখন্ডের জনগণকে একটি গভীর উপলব্ধি ও বিশ্বাসে পৌঁছে দিয়েছে। আর তা হলো এই যে, পুরুষানুক্রমে আমরা যে ভূখন্ডে জন্মলাভ করেছি ও বসবাস করে আসছি তার নাম বাংলা। যে ভাষায় আমরা কথা বলি সে ভাষার নাম বাংলা। যে ঐতিহ্য আমার চেতনা আর চিন্তায় ক্রিয়াশীল তার বিকাশ এই বাংলা ভূখণ্ডেই। এই রকমের একটি পরিণত ও বিকশিত উপলব্ধি থেকেই এই ভূখন্ডের মানুষ বহিঃশত্রু এবং বহিরাগত শাসক-শোষকদের শাসন-শোষণ এবং আধিপত্যের বিরুদ্ধে বহুবার রুখে দাঁড়িয়েছে। এই রুখে দাঁড়াবার ঘটনা অতীতেও বহুবার ঘটেছিলো এবং সে সব ঘটনা নিয়ে চিন্তাভাবনা আর বিচার-বিশ্লেষণ আধুনিককালেও অব্যাহত। বরেণ্য ইতিহাসবিদ এবং পণ্ডিতজন বহু রকমের তথ্য প্রমাণ অতীত বিস্মরণের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে বর্তমানের আলোকবৃত্তে নিয়ে এসেছেন।
আমি পণ্ডিত বা ইতিহাসবিদ নই। তবুও এই ভূখন্ডের জনগণের জাগরণের ব্যাপারটা নিয়ে কৌতূহলী ছিলাম এবং এখনো আছি। প্রদোষে প্রাকৃতজন অতীতের পুরো কাল বৃত্ত নিয়ে নয়, শুধু একটি পর্ব নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। এই উপন্যাসে মৃৎশিল্পের প্রসঙ্গ এসেছে, মানব মেলার প্রসঙ্গ এসেছে, আর মানব-মানবীর প্রেমের প্রসঙ্গতো রয়েছেই। চরম দুঃসময়ে যখন জীবনকে গ্রাস করতে উদ্যত, সেই সময়ও পলায়নপর নর-নারীর সম্পর্কের বিষয়টিও এসে গেছে। প্রথাসিদ্ধ সমাপ্তি উপন্যাসটির কাহিনীতে আসেনি, তবে মনে হয় ইতিহাসের একটি কালপর্বকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে।
০ দ্বাদশ শতাব্দীর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বঙ্কিমচন্দ্র ও ‘দুর্গেশ নন্দিনী’তে ব্যবহার করেছেন। আপনিও করেছেন। আপনার দৃষ্টিতে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যটা কি একটু বলবেন কি?
শওকত আলী: না, তেমন কিছু বলার নেই এ ব্যাপারে। কালপর্ব এক হলেও বিষয় ও মানব-মানবীর চরিত্র ভিন্ন। এবং নামেই তা প্রতিফলিত, ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ শব্দটির অর্থেই তা বোঝা যায়। শক্তি ও বলের অধিপতিরা হতেন দুর্গেশ বা দুর্গের অধিপতি।
দুর্গেশের এক কন্যা বা নন্দিনীকে নিয়ে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রথম লগ্নে লেখা হয়েছে দুর্গেশ নন্দিনী উপন্যাসটি। আর তা লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের প্রারম্ভকালীন স্মরণী লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর প্রদোষে প্রাকৃতজন লেখা হয় বিংশ শতাব্দীর প্রায় অন্তিম কালে। আর নামের মধ্যেইতো একটা প্রধান ভিন্নতা বর্তমান। প্রদোষকাল হলো আলো এবং অন্ধকারের মধ্যবর্তী সময়। অর্থাৎ প্রত্যুষকাল অথবা সন্ধ্যাকাল। যারা সেন রাজবংশের বিদায় কালকে অশুভ বলে বিবেচনা করেন, তাদের কাছে এই প্রদোষকাল সন্ধ্যাকাল, আর যারা সেন রাজাদের বিদায় এবং যবনদের আগমনকে শুভ বলে বিবেচনা করেন, তাদের কাছে এই প্রদোষকাল প্রভাত সমাগমের কাল। উপন্যাসটির কাহিনী ও চরিত্রে রাজকীয় ব্যাপার নেই, প্রাকৃতজনের কথাই বলা হয়েছে উপন্যাসটিতে। প্রাকৃতজন শব্দটির অর্থ প্রকৃতি সংলগ্ন মানুষ। সুতরাং দুটি রচনাই বিষয়ে, চরিত্র সৃজনে ভিন্ন। এবং ভাষাতেও মিল নেই। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এ সংস্কৃত শব্দ প্রচুর থাকলেও শব্দগঠনে বিশেষ করে এবং সর্বনাম পদে একেবারে প্রাকৃত বাংলাই ব্যবহার করা হয়েছে। তাই আমার মনে হয় কালজয়ী উপন্যাস দুর্গেশ নন্দিনীর সঙ্গে প্রদোষে প্রাকৃতজনের তুলনা করা ঠিক হবে না।
০ ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে গণমানুষের বিদ্রোহের যে সম্ভাবনার চিত্র একেছেন, তা নিছক শিল্পীর মশ্চক্ষুজাত নাকি ইতিহাসেও এর দৃষ্টান্ত আছে?
শওকত আলী: গণমানুষের বিদ্রোহের বিষয়টা প্রদোষে প্রাকৃতজনণ্ড এ আছে, না থাকলেতো দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের আর্থ-সামাজিক অবস্থাটা ধরা পড়তো না। তাছাড়া বাংলা অঞ্চলে যত বিদ্রোহ তার উৎসার গণমানুষের জীবন বোধ থেকেই ঘটেছে।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ফকির আর সন্ত্রাসীদের বিদ্রোহ তো তার উজ্জ্বল একটি উদাহরণ। আবার কৃষকরাও কম বিদ্রোহ করেনি। অতীতেতো কৃষক বিদ্রোহ হয়েছেই, এমনকি ৪০ এর দশকের তেভাগা আন্দোলন তার প্রমাণ। এমনকি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে চাষী-মজুরদের শামিল হওয়া ও সহযোগিতার প্রসঙ্গটি কি উপেক্ষা করা যাবে? তাদের সহযোগিতা ও সহায়তা ছাড়া কি মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় পথে অগ্রসর হতে পারতেন?
০ গণমানুষের চেতনার মধ্যে শোষণ বিরোধী, অত্যাচার বিরোধী, জাতিসত্তাদমনের সামন্তবিরোধী বিদ্রোহ সুপ্ত থাকেই, কিন্তু সংঘশক্তি একটা বড় ফ্যাক্টর। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ সংগঠিত, সম্মিলিত প্রতিরোধ দেখি না। আপনার মন্তব্য শুনতে চাই।
শওকত আলী: প্রদোষ কালতো পরিপূর্ণ কাল নয়। প্রকৃত দিবা কিংবা রাত্রিকালের তার প্রারম্ভিক সময়। যখন উদ্যোগের আরম্ভ। ঐ অবস্থায় সংগঠন কীভাবে গড়ে ওঠবে। তবে খন্ডিত আকারে হলেও কিছু প্রতিরোধের কথাতো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও প্রতিরোধের সংবাদ যে মানুষের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছিলো তার উল্লেখতো স্পষ্ট ভাবেই আছে।
০ এ উপন্যাস লেখার সময় আপনি কি বাঙালির নৃতাত্ত্বিক যুগপৎ সাংস্কৃতিক ইতিহাস অবলম্বন করেছিলেন?
শওকত আলী: ইতিহাসের বই সামনে রেখে উপন্যাস লেখা হয় কি? সৃজনকাল লেখার কাজ ওভাবে করা যায় বলে আমার মনে হয় না। তবে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময় যা কিছু পড়াশোনা করা হয়েছিলো, তা থেকেই প্রেরণা আসে এবং উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও অন্তরঙ্গতাও পেছনে কাজ করেছিলো বলে আমার বিশ্বাস।
০ দেশীয় ভাষা, কৃষ্টি, চিত্র, নৃত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার প্রতি বর্ণব্রাহ্মণরা যে বৈরি আচরণ করেছিলো, তাতো পাকিস্তানী শাসক তথা এলিটদের মধ্যেও লক্ষণীয়। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি ঐ উপন্যাসে ইঙ্গিতটা এভাবে করতে চাননি।
শওকত আলী: দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলা ভূখন্ডের জনগণের মধ্যে বর্ণভেদ যে প্রবল ছিল তা নিয়ে এখন আর তেমন বিতর্ক নেই। হলায়ুধ মিশ্রের সংস্কৃত গ্রন্থ ‘সেক শুভদয়ায় বিষয়টি সুস্পষ্ট’ উল্লেখ আছে। মহারাজ লক্ষণ সেনের মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্র খুব সুস্পষ্টভাবেই যবন সাধুদের কথা উল্লেখ করেছেন তার গ্রন্থে। উল্লেখ আছে যে, গৌড় দেশে একাধিক যবন কেন্দ্র গড়ে উঠেছিলো ঐ সময়। আর ঐ সব কেন্দ্রে যবন ভিক্ষুরা অবস্থান করতেন। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, কঠোর বাহ্মণ্যবাদী অনুশাসনের অবসানের সূচনা ঐ সময় থেকেই। নগর অঞ্চলে অভিজাত শ্রেণীর জীবন যাপনে অবশ্যই আধিপত্য ছিলো, কিন্তু সাধারণ জনগণের জীবনবৃত্তে তেমন আধিপত্য ছিলো বলে মনে হয় না। লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্য, লোকদেবী ও দেবতার পূজা ঐ পরিমন্ডলেই চলতো। এবং সাধারণ জনগণের জীবন যাপনও সেখানেই হতো।
ভারতীয় উপমহাদেশে এই বঙ্গ অঞ্চলটিতে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ বলে মনে হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধিপত্য যে সব অঞ্চলে প্রবল ছিলো, সে সব অঞ্চলের লোক সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য কম বলেই কোন কোন বিশেষজ্ঞ অনুমান করেন।
০ এই উপন্যাসের চরিত্র বসন্ত দাসকে কি আপনি সম্ভাবনাময় গণনায়কের প্রতিচ্ছায়ায় কল্পনা করেছেন?
শওকত আলী: শুধু বসন্তদাস নয়, অধিকাংশ চরিত্রই গড়ে ওঠা। বাস্তব জীবনে যেমন হয়ে থাকে। বসন্তদাশ গণনেতা হয়ে উঠেননি তখনো, তবে নেতৃত্বের পথ তাকে ধরতে হয়েছে। নিজের জন্য পরিকল্পনা করে নয়, জীবনের বাস্তবতা এবং সহগামী সুহৃদদের প্রেরণাই তাকে সেই পথে চালনা করেছে। এদেশে আধুনিক কালের রাজনীতিতেও এমন অনেক রাজনৈতিক কর্মী ও নেতার নাম উল্লেখ করতে পারে, যারা জনগণের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ০৯, ২০১০
Leave a Reply