বাংলা ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে, নাকি গবেষক হিসেবে ড. আবুল আহসান চৌধুরী খ্যাতিমান, তা নির্ণয় করা কিছুটা কঠিন। তার দু-একজন ছাত্রের জবানিতে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতা, টেলিভিশনের আলোচনা শুনে অনেকদিন ধরে তার গুণপনার সঙ্গে পরিচয়, পরিচয় খুব কম নয় তার ধ্যানী সাধকের মতো নিবিষ্ট গবেষণার সঙ্গেও। আবুল আহসান চৌধুরীর খ্যাতির পাল্লাটা ভারী মূলত উপমহাদেশের বাউলসাধনা এবং ফকির লালনের জীবন ও সঙ্গীত বিষয়ক বিস্তৃত গবেষণার কারণে। অন্তত দেড়-দু’দশক আগে মুগ্ধ হয়েছিলাম ভারতের ‘দেশ’ পত্রিকায় তার এ সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ রচনা পড়ে। পরবর্তীকালে আবুল আহসান চৌধুরীর অন্যান্য গবেষণাকর্মের খোঁজ-খবর নিতে প্রলুব্ধ হই তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রচনার প্রসাদগুণের কারণে। ব্যক্তিগত পরিচয়ের অনেক আগেই তার রকমারি গদ্যের সঙ্গে পরিচয় অনেকটা ঘটে যায়। বিবেচনা করি, এই গবেষককে যদি শুধু বাউলগবেষক কিংবা লালনগবেষকের পরিচয়ে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে তার বিস্তৃত মননশীলতার প্রতি মোটেও সুবিচার করা হয় না। কিন্তু সেটাই বেশি ঘটছে তার ক্ষেত্রে। বাংলা সাহিত্য সমাজ সংস্কৃতির নানা শাখায় তার নিবেদিত মনননিষ্ঠার স্বাক্ষর আমাকে মুগ্ধ করেছে দুটি কারণে। প্রথমত, যে বিষয়েই তিনি কাজ করেন, তার শিকড়ে যেতে অনুসন্ধিৎসু। তৃতীয়ত, টিকা-টিপ্পনীকবলিত কাঠখোট্টা ভাষার যে নিরস তথ্য আর তত্ত্বকথায় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে অধিকাংশ গবেষণাকর্ম, তা থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত। বরং তার গবেষণাও ফিকশনের আনন্দ দেয় প্রায়শ। কারণ, প্রাঞ্জল একটা গদ্যরীতি তার আয়ত্তে এবং সেইসঙ্গে রেফারেন্সগুলো আনেন তিনি অনেকটাই গল্পচ্ছলে। ‘অবিদ্যার অনন্তপুরে’ শিরোনামের প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার এই বইটি পড়তে গিয়েও সেই প্রাক্তন আনন্দ আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হইনি। বরং এই গবেষণাকর্মটি অধিকতর ফিকশনধর্মী হওয়ার অনিবার্য কারণ অলঙ্ঘনীয় বলে ড. চৌধুরী তার পাঠকদের এক অনাস্বাদিত আনন্দ-বেদনার রসে সিক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন অতীতের যে কোনো রচনার চেয়ে বেশি। এই বইটি ড. আবুল আহসান চৌধুরীর গবেষণামূলক গ্রন্থ হলেও এর তাৎপর্য ভিন্নতর। তা হলো, এ গ্রন্থে তিনি ‘নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা’ তুলে ধরতে গিয়ে এমন কিছু দুর্লভপ্রায় রচনা সংকলিত করেছেন, যা একইসঙ্গে একটি কালের সামাজিক-সাংস্কৃতিক এমনকি সাহিত্যিক ইতিহাসের উপকরণ উন্মোচিত করেছে একালের পাঠকের কাছে। ফলে এসব রচনা সংগ্রহ ও সংকলন করতে গিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ ভূমিকা তুলে ধরেছেন, যা রচনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিৎ বুঝতে পাঠকদের সহায়তা করবে।
‘অবিদ্যার অনন্তঃপুরে’ বইটি মোট সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত। অধ্যায়গুলোর শিরোনাম ভূমিকা, আমার কথা : বিনোদিনী দাসী, শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত : মানদা দেবী, ব্যভিচারী রমেশদা’র আত্মকথা : রমেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অপূর্ব্বসতী নাটক : সুকুমারী দত্ত এবং পরিশিষ্ট অংশে দুটি অধ্যায় কলিকাতা নিবাসিনী বেশ্যার পত্র ও বারবণিতার উইল। বইটির দীর্ঘ ভূমিকায় ড. চৌধুরী তার পাঠকদের এ-গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত বিনোদিনী দাসীর মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার যে আত্মজৈবনিক উপাখ্যান, তা যে কোনো উপন্যাসের চেয়ে কোনো অংশে কম আকর্ষণীয় নয়। একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে বিনোদিনীর জীবনযুদ্ধ যে কোনো মহৎ উপন্যাসের চরিত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার মতো। সবচেয়ে বিস্ময়ে জাগায় সমাজের এই উপেক্ষিত নারীর আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথায় সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস আর ভাষার প্রাঞ্জল গতি। তার বইটির শিরোনাম ‘বিনোদিনীর কথা’ বা (আমার কথা) প্রথম খণ্ড।
আবুল আহসান চৌধুরী সংকলিত ‘বিনোদিনীর কথা’র যে সংস্করণ এ-গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তার প্রকাশক ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী’, প্রকাশকাল ১৩২০ বঙ্গাব্দ। এটি নব সংস্করণ। তার অর্থ প্রায় শতবর্ষ আগে প্রকাশিত এই নব সংস্করণের আগেও সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিক বিবেচনা করলে সে যুগের এক বারবণিতার এ ধরনের আত্মজীবনী প্রকাশ দুঃসাহসী ঘটনা, মানতেই হবে। নৃত্যগীত এবং অভিনয়ে দক্ষ বিনোদিনী যে রূপে-গুণে সমান পারদর্শিণী তা তার ছবি দেখে যেমন এক পলকে জানা হয়ে যায়, তেমনি তার জীবনসংগ্রামের বর্ণনা পড়লে, তার অভিনয়ের অভিজ্ঞতার স্তরগুলো পেরিয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চকর বর্ণনায় উপলব্ধি শুধু নয়, বিস্ময়ে থ’ হয়ে যেতে হয়। ‘নাট্যসম্রাট’ বলে পরিচিত গিরিশচন্দ্র ঘোষ এ-বইটির একটি ভূমিকা লিখেছিলেন বিনোদিনীর অনুরোধে। কিন্তু অর্ধসত্য বলে সে ভূমিকা প্রথম সংস্করণে ব্যবহার করেননি বিনোদিনী। নব সংস্করণে তা সংকলিত করেন। কিন্তু বিনোদিনী তার ভূমিকায় তার গুরু গিরিশ ঘোষের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং এই ভূমিকা ছাপাণ্ড ছাপার ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এই ছোট্ট পরিসর আলোচনায় হয়তো শ্রীমতী বিনোদিনী, মানদা দেবী কিংবা রমেশচন্দ্রের সাহসী আত্মজৈবনিক রোমাঞ্চকর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা সম্ভব হবে না। কিন্তু যে কালপরিসরে তারা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের অম্লমধুর অভিজ্ঞতা লিখেছেন, তাতে বাংলা সাহিত্য-সংস্টক্ষৃতি অঙ্গনের এমন অনেক চরিত্রের উপস্থিতি ঘটেছে, এমন সামাজিক চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে, যার সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্য ইতিহাসের নিরিখে অন্তত তাৎপর্যপূর্ণ।
সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে, বিত্তের সঙ্গে পতিতা, উপপত্নী পোষণ বা বহু নারীগমন যে একটা সামাজিক স্ট্যাটাসে পরিণত হয়েছিল, একালে এ সত্য পড়ে বিস্ময় জাগবে। আজ উপমহাদেশে এমনকি বাংলাদেশেও লিভ টুগেদার কিংবা পশ্চিমা সংস্কৃতির ফ্রি মিক্সিংয়ের ধারণা কোনো বিস্ময়ে জাগায় না। কিন্তু উনিশ শতকের বাংলায় রক্ষণশীল ধর্মীয় সামাজিক প্রেক্ষাপটে তা কোথায় পৌঁছেছিল, ভেবে বিস্ময়ে জাগাই স্বাভাবিক। ড. আবুল আহসান চৌধুরী অবশ্য তার দীর্ঘ ভূমিকায় সেই বাস্তবতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা বিশেষভাবেই তুলে ধরেছেন। উনিশ এবং বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের স্বনামখ্যাত অনেকেরই গণিকাগমনের বিস্ময়কর ঘটনাও বেরিয়ে এসেছে এই গ্রন্থের মধ্য দিয়েই। ড. চৌধুরী গণিকাসংস্কৃতির বাংলার সামাজিক ইতিহাসের সম্পর্কসূত্র নির্ণয়ের পাশাপাশি ইতিহাসের আলোকেই প্রায় বোমা ফাটানোর মতো কিছু তথ্য দিয়েছেন। উনিশ শতকের পাশ্চাত্য শিক্ষার আনুকূল্যে বাঙালি সমাজের উত্থানের পাশাপাশি সমাজের গভীরে প্রোথিত নব্য ধনীগোষ্ঠীর ব্যভিচার, অনাচার, লাম্পট্য কীভাবে স্ট্যাটাস সিম্বলে পরিণত হয়েছিল, তারও বিশদ বিবরণ পাঠ। রক্ষিতা পোষণ যে সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল প্রায় এক-দেড়শ’ বছর আগে, তা একালে বিস্ময়ে জাগালেও এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের যুক্তি উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
আমরা বিক্ষিপ্তভাবে অবশ্য উনিশ শতকের সেই চিত্র কিছু কিছু পেয়েছি হুতোম পেঁচার নকশায়, নববাবু বিলাস-এ, একেই কি বলে সভ্যতা কিংবা বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ পড়ে। পেয়েছি বিক্ষিপ্তভাবে কলকাতায় বাবু শ্রেণীর উদ্ভবের ইতিহাসের পাঠে বিনয় ঘোষের বাংলার ইতিহাসের সমাজচিত্র থেকে। কিন্তু রাজা রামমোহন রায়, মীর মশাররফ হোসেন, ঠাকুর পরিবারের কীর্তিমান পুরুষ দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে পূর্ববাংলার হাছন রাজার জ্যেষ্ঠপুত্র বানিউর রাজা পর্যন্ত বহু স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্ব গণিকাসক্তির যে চিত্র আবুল আহসান চৌধুরী বইটির দীর্ঘ ভূমিকায় তুলে এনেছেন তা বোমা ফাটানোর মতো হলেও ঐতিহাসিক-সামাজিক সত্য বৈকি! বিস্ময় জাগবে না শরৎচন্দ্রের গণিকাসক্তির কথা জেনে। কিন্তু পাঠক কি চমকে উঠবেন না জগদীশ গুপ্তের মতো লাজুক কথাশিল্পীর জীবনে এমন আসক্তি ছিল জেনে? একালেও অবশ্য ভিন্ন আঙ্গিকে পতিতাবৃত্তি টিকে আছে সমাজের উঁচুতলায়। রক্ষিতাও আছে, আধুনিকতার ছদ্মাবরণে। কিন্তু মানদা দেবী কিংবা বিনোদিনী দাসীর মতো সাহসী কে আছেন যে, এমন নির্মম জীবনকাহিনী শোনাবেন? এখানেই এই বইটির বিশিষ্টতা। শোভা প্রকাশ ঢাকা থেকে প্রকাশিত এ বইটি বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পাবে সন্দেহ নেই। প্রখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ-অলঙ্করণও দৃষ্টিনন্দন। বইটির মূল্য ৪৫০ টাকা।
নাসির আহমেদ
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ০৯, ২০১০
Leave a Reply