আবু রুশদ একবিংশ শতাব্দীতে এসে কিংবা তার আগে লেখালেখি থেমে গিয়েছিল বলে হয়তো এ প্রজন্মের পাঠকরা আবু রুশদকে তেমনভাবে চেনেন না। তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস অথবা আত্মজৈবনিক রচনাগুলোও তেমন সুলভ নয়। ফলে তাঁর নাম ও রচনা প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে বলেই মনে হয়, যদিও আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য তা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। তাঁর অনুজ কথাসাহিত্যিক রশীদ করীম নিজের ১০ ভাইবোনের প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘সেজ আবু রুশদ (মতিনউদ্দিন), যাঁর পরিচয় দেওয়া বাহুল্য মাত্র।’ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অন্তত লেখক হিসেবে পাঠকদের একটি বড় অংশই হয়তো তাঁকে এখন চিনতে পারবেন না। অথচ তিনি আমাদের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিকের অন্যতম। বাকি দুজন—সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও শওকত ওসমানের উপন্যাস নিয়ে তিনি মূল্যায়নধর্মী একটি গ্রন্থ লিখেছেন। মনে পড়ছে, বাংলা একাডেমীর এক অনুষ্ঠানে আবু রুশদ শওকত ওসমানের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করছিলেন আর শওকত ওসমান চুপচাপ বসে না থেকে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
আত্মজীবনীতে আবু রুশদ নিজেই লিখেছেন, ‘প্রচণ্ড কোনো আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে আমি কখনও এমন কিছু করিনি, যাতে আমার মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে।’ কিন্তু তাহলেও তাঁর উপন্যাসের নামের মতোই তিনি জানতেন, ‘সামনে নতুন দিন।’ কিন্তু তিনি এও জানতেন, ‘সাহিত্যিক হিসেবে আমি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যেন তেমন আলোচিত বা সমাদৃত হতে না পারি’ সে চেষ্টা যাঁরা করতেন তাঁদের মধ্যে তাঁর ‘দু-একজন বন্ধু, স্থানীয় লোকও ছিলেন।’
হয়তো এসবই পরিপার্শ্বের দ্বান্দ্বিকতাই তাঁকে কথাসাহিত্যের উপাদান জুগিয়েছে এবং তিনি কথাসাহিত্যিক হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অধ্যাপনা জীবনে অথবা ডেপুটেশনে তাঁর পোস্টিং নিয়ে জটিলতা, বিদেশে দূতাবাসে চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় দু-একজন সহকর্মীর ঈর্ষা অথবা ইংরেজি দৈনিকে কলামের সম্মানী নিয়ে সমস্যার বাস্তবতা ভিন্নভাবে হলেও জীবনের প্রথম পর্বেও তিনি অনুভব করেছেন ও তার মুখোমুখি হয়েছেন। নোঙর উপন্যাসে এর নায়কের কলকাতা ত্যাগ নিয়ে যে টানাপোড়েন তা অন্যভাবে হয়তো প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সামনে নতুন দিন বা স্থগিত দ্বীপ-এ। প্রথম যৌবন ও শাড়ি বাড়ি গাড়ি গল্পগ্রহদ্বয়েও এক ধরনের দ্বৈততা অথবা বৈপরীত্য রয়েছে। সত্তর বা আশির দশকে তাঁর প্রকাশিত কোনো কোনো গল্পে যে দাহ্য বাস্তবতার সাক্ষাত্ পাই তা দ্বন্দ্বকে আত্মসাত্ করা ছাড়া সম্ভব হতো না।
এ অভিজ্ঞতা তিনি নিজের জীবন থেকেও পেয়েছেন। বিদেশি স্বামীর সঙ্গে নিজ কন্যার দৃশ্যত সুখী দাম্পত্য জীবন যে মাত্র দুই বছরের মাথায় ভেঙে যাবে, সে থেকেও তিনি জীবনকে বুঝতে চেয়েছেন। আগ্রার তাজমহল দেখতে যাওয়ার পথে ‘ঘিঞ্জি ময়লা’ থুথু ও ‘ঘামের গন্ধ’ তাঁকে হতাশ করলেও সে অপূর্ব সৌধ ও সৃষ্টি দেখে তিনি মুগ্ধ হন। কিন্তু তাজমহলের কাছাকাছি দুই সাধারণ রমণীর একজন যে তাঁর স্বামী যদি এ রকম কিছু করে, তাহলে সে কালই মরতে রাজি-র জবাবে অন্য রমণী যে বলে, আমরা মরলে ওরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে, পরের দিনই নতুন বউয়ের খোঁজে লেগে যাবে-র মধ্যে আবু রুশদের কথাসাহিত্যিক সত্তার পরিচয় পাই।
নিজের লেখালেখি সম্পর্কে আবু রুশদ লিখেছেন, ‘১৯৮৮ সালের পুরো বছর ও ১৩৯৫ বাঙলা বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত আমি লেখার ব্যাপারে বেশ ক্রিয়াশীল আছি। ১৯৮৮ সালে পাঁচটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি।’ এর আগের প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘কয়েকটি ছোট গল্প লেখা হলো আর অনুবাদের কাজও তরতরিয়ে এগিয়ে গেল।’ ‘…আমার বেশ কয়েকজন অনুরাগী পাঠক সমাজের বিভিন্ন স্তরে এখনো রয়ে গেছে।’
কথাসাহিত্যিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমালোচনার বোধও জাগ্রত ছিল। সত্যজিত্ রায়ের ছবি কাঞ্চনজঙ্ঘার একটি প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘ছবিতে দার্জিলিংকে বলা হয়েছিল হিমালয়ের ফুট-হিল। যার উচ্চতা সাড়ে সাত হাজার ফুট, তাকে ঠিক ‘ফুট-হিল’ বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহের এখনো নিরসন হয়নি।’
১৯৮১ সালে নিজের একুশে পদক পাওয়ার প্রসঙ্গে আবু রুশদ লিখেছেন, ‘…স্বাধীন বাংলাদেশে এই আমার প্রথম ও শেষ সাহিত্যিক পুরস্কার।’ মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
২.
রশীদ করীমের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, তাঁদের পিতৃ ও মাতৃভাষা ছিল উর্দু। তাঁদের পিতামহ তাঁদের এক অকালপ্রয়াত চাচাকে বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। কারণ তিনি দরিদ্র ঘরের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। এ রকম ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়াই হয়তো তাঁরা দুই ভাই, আবু রুশদ ও রশীদ করীম কথাসাহিত্যিক হয়েছেন।
৩.
অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজে বেড়াতে গিয়ে আবু রুশদ শান্তি ও স্বস্তি পেয়েছিলেন। রশীদ করীম জানিয়েছেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁকে বলেছিলেন, তিনি ও আবু রুশদ যুগ্মভাবে একটি উপন্যাস লিখবেন বলে পরিকল্পনা করেছিলেন। যদিও সে উপন্যাস আর লেখা হয়নি, তবু ঠিক হয়েছিল, এর বেডরুম সিনগুলো লিখবেন আবু রুশদ আর বাকি অংশ লিখবেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। কারণ আবু রুশদ তখন বিবাহিত এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তখনও বিয়ে করেননি।
আবু রুশদ দেখেছেন, শত অভাব ও দুর্দশার মধ্যেও এ দেশের মানুষ হাসতে পারে। আশির এক ভয়ংকর বন্যার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, গৃহচ্যুত এক কিশোরী পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে অমলিন হাসি হাসছে। আবার অন্যদিকে (যুবসমাজ সম্পর্কে) তাঁর এও মনে হয়েছে, ‘…আর্থিকভাবে যে বিড়ম্বিত বা অন্যভাবে দুর্দশাগ্রস্ত তাঁর পক্ষে সামান্য আত্মত্যাগ করাও কঠিন।’
বিদেশে গিয়ে প্রান্তর ও খামারের সবুজ শ্রী দেখে ‘সহসা তীক্ষ ব্যথার মতো’ তাঁর ‘দেশের কথা মনে পড়ে যেত।’ ‘মাটি সব জায়গাতেই সমান, সর্বংসহা ও মমতাময়ী।’ লেখক নিজেও এখন মৃত্তিকার অংশ হয়ে গেছেন, কিন্তু মমতার সেই স্পর্শ কি আমরা পাচ্ছি?
৪.
২৫ ফেব্রুয়ারির দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ২৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাতে কথাসাহিত্যিক আবু রুশদ ৯০ বছর বয়সে মারা গেছেন।
শান্তনু কায়সার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৯, ২০১০
Leave a Reply