পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস আমাদের জাতীয় সম্পদ। এগুলোর একটি ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন অচল হয়ে পড়ে। আধুনিক জীবন যাপনের জন্য পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভূমিকা যে কতখানি তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এসব সম্পদই আবার আমরা নানাভাবে অপচয় করে থাকি। অজ্ঞতা ও অসচেতনতাই এর মূল কারণ। ছোট ছোট অপচয় থেকেই আমরা প্রতিদিন নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অভাবে হরহামেশা সমস্যায় পড়তে হয়। মিরপুরের বাসিন্দা জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস ছাড়া আমি তো একটি দিনও কল্পনা করতে পারি না। অথচ বাড়ি বা বাড়ির বাইরে আমরা নানাভাবে এসবের অপচয় করে থাকি। যেমন-অনেক সময় পানির কল ছেড়ে দিয়েই গোসল করি, কাপড়-চোপড় ধুতে থাকি, থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল মাজি। এ ছাড়া দাঁত ব্রাশ করা, মুখ ধোয়াসহ নানা কাজে অপ্রয়োজনে পানি অপচয় করে থাকি। যদি বালতি বা পানি রাখার পাত্রে যতটুকু পানি দরকার ততটুকু রেখে দিই, তাহলে অযথা পানির অপচয় হয় না। তেমনিভাবে বিদ্যুতের অপচয় রোধেও সচেতন হতে হবে। ঘরের কাজ শেষ হলে বাতি, পাখার সুইচ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অনেক সময় অফিস বা বাসায় অযথাই কম্পিউটার চালু থাকে। এতেও বিদ্যুতের অপচয় হয়। কাজ শেষ হলে তা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। গ্যাসের অপচয় রোধের ক্ষেত্রে অতিদ্রুত রান্না হয়-এমন সব সামগ্রী ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন-প্রেশার কুকার ও রাইস কুকার। রান্নার আগে সবজি হালকা সিদ্ধ করে নিয়ে রান্না করলে গ্যাস কম খরচ হয়। এতে খাবারের পুষ্টিগুণও ঠিক থাকে। ওয়াশিং মেশিনেও পানি বেশি খরচ হয়। একটু সচেতন ও খেয়াল করলেই এসব অপচয় রোধ করা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মতো গৃহিণীরাই যারা বাসায় থাকেন তাদের বেশি সচেতন হওয়া উচিত।’
পানি
দৈনন্দিন জীবনে পানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু দেখা যায় নিরাপদ পানির সংকট লেগেই আছে। ছোট ছোট অবহেলায় প্রতিদিন অনেক পানির অপচয় হয়। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘অনেক সময় আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি না যে আমাদের দৈনন্দিন কাজে পানির অনেক অপচয় হচ্ছে। এ অপচয় আমরা একটু সচেতন হলে নিজেরাই রোধ করতে পারি।’
–দাঁত ব্রাশ করা বা মুখ ধোয়ার সময় পানির কল ছেড়ে করলে পানির অনেক অপচয় হয়। মগ বা পানির পাত্রে পানি জমিয়ে তা করলে ২০ ভাগের এক ভাগ পানি অপচয় হয়।
–গোসল করার সময় শাওয়ার ছেড়ে গোসল করলে পানির অপচয় হয়। বালতিতে পানি নিয়ে গোসল করলে এ অপচয় রোধ করা যায়।
–শাকসবজি, হাঁড়ি-পাতিল, থানা-বাসন ধোয়াসহ নানা কাজের জন্য বালতিতে পানি নিয়ে কাজ করলে পানির অপচয় অনেকাংশে রোধ করা যায়।
–গাড়ি ধোয়ায় হোস পাইপ ব্যবহার করলে পানির অনেক বেশি অপচয় হয়। সে ক্ষেত্রে বালতি বা যেকোনো পানি রাখার পাত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
–বাড়ির ছাদে পানির ট্যাংকে পানির তোলার সময় সুইচ দিয়ে রাখলে অনেক সময় বন্ধ করার কথা মনে থাকে না। তখন ট্যাংক ভরে প্রচুর পরিমাণ পানি উপচে পড়ে যায়। এটি রোধ করতে বল কক ব্যবহার করা উচিত। এর দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুইচ বন্ধ হয়ে যাবে।
এ ছাড়া নষ্ট পানির কল দ্বারাও প্রচুর পানির অপচয় হয়। প্রতিদিন এসব কল যতদ্রুত সম্ভব ঠিক করা উচিত। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা। এর মাধ্যমেই এসব অপচয় রোধ করা যাবে।’
বিদ্যুৎ
লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ বিভ্রাট আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বিদ্যুতের অপচয়ের ফলেই এসবের সৃষ্টি হয়। বিদ্যুতের অপচয় রোধ সম্পর্কে ঢাকা পাওয়ার সাপ্লাই অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজার মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘স্বাধীন দেশের সবাই সবকিছু স্বাধীনভাবে ব্যবহার করেন। তবে দেশটা যেহেতু নিজেদের, সে ক্ষেত্রে দেশের সম্পদের ব্যবহার সঠিকভাবেই করা উচিত। বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের জীবন স্থবির হয়ে পড়বে। আমরা যদি সচেতন হই, তাহলে এর অপচয় রোধ করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন। বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো রকম রাজনীতি করা উচিত নয়। বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের অর্থনীতি একদিন মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে।’ তিনি বিদ্যুতের অপচয় রোধের কিছু উপায় জানান।
–প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাতি ও পাখা ছেড়ে রাখা উচিত নয়। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় খেয়াল করুন, তা ছাড়া আছে কি না।
–এনার্জি সেভিং বাল্ব ব্যবহার করা যেতে পারে।
–যাদের বিল বকেয়া থাকে, তাদের ব্যাপারে কতৃêপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে তারা সচেতন হবে না।
–বিনা প্রয়োজনে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ব্যবহার করা উচিত নয়।
–শিল্প-কারখানাগুলো রাতের বেলা চালু রাখলে বিদ্যুৎ কম খরচ হয়।
–শপিং মলগুলোয় আলোকসজ্জার ব্যবহার কমাতে হবে। কারণ, এসব আলোকসজ্জায় অনেক বিদ্যুৎ অপচয় হয়।
–বৈদ্যুতিক বিল সঠিক সময়ে দিতে হবে। এ ছাড়া রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো অনেক সময় দিনের বেলাও জ্বলে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গ্যাস
গ্যাস আমাদের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। আমরা নানাভাবে এর অপচয় করে থাকি। গ্যাসের অপচয় রোধ না করা গেলে একসময় হয়তো এটি ফুরিয়ে যাবে। তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপারেশন্স) প্রকৌলশী মো· আমিনুর রহমান জানান, গ্যাসের ব্যবহারকারী যদি এ ব্যাপারে সচেতন হয়, তাহলেই এর অপচয় রোধ করা যাবে। কর্তৃপক্ষকেই এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শাস্তির বিধান থাকলে জনগণের নীতি ঠিক থাকবে। তারা সঠিকভাবে গ্যাস ব্যবহার করবে।
গ্যাসের অপচয় রোধে তিনি বেশ কিছু পরামর্শ দেন। তাঁর মতে-
–বাড়িতে মিটার বসানো যেতে পারে। প্রিপেইড মিটারও হতে পারে। তবে এসব কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মধ্যে যেন দুর্নীতি ঢুকে না পড়ে, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে সচেতন থাকতে হবে।
–অনুমোদন ছাড়া চুলা ব্যবহার করা যাবে না। অনুমোদন নিলেও জানতে হবে গ্রাহক কতটি চুলা ব্যবহার করছে।
–অপ্রয়োজনে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখা ঠিক নয়।
–অবৈধভাবে চুলা ব্যবহারকারীকে শাস্তি প্রদান করা উচিত।
–গ্যাসের চুলায় কাপড় শুকানো ঠিক নয়, এতে যেমন গ্যাসের অপচয় হয়, তেমনি দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
সচেতনতাই আমাদের সম্পদের অপচয় রোধ করতে পারে। সবারই এ ব্যাপারে লক্ষ রাখা উচিত। সবার আন্তরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপচয় রোধ করা সম্ভব।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২১, ২০০৮
Leave a Reply