রান্না শুধু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশই নয়, একটি শিল্পও বটে। খাবারে একটু নতুনত্ব আর ভিন্ন স্বাদ আনার জন্য গৃহিণীদের সে কী চেষ্টা, সঙ্গে প্রিয়জনদের স্বাস্থ্যের ব্যাপার তো আছেই। আর প্রতিদিনের এই কর্মযজ্ঞের ঠিকানা রসুইঘর বা রান্নাঘর। গৃহিণীরা তাঁদের জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দেন রান্নাঘরেই। রান্নাঘরের পরিবেশটা তাই হওয়া উচিত সে রকম, যাতে দীর্ঘক্ষণ কাজের পরও একঘেয়েমি চলে না আসে। বাড়ির সবার স্বাস্থ্যের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে রান্নাঘরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মডেল ও উপস্থাপক শারমিন লাকী তাঁর রান্নাঘরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিজেই পরিচালনা করেন। কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি কীভাবে রান্নাঘর সামলান, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূল কথা হলো সুব্যবস্থাপনা ও সুসজ্জা। রান্নাঘরের আয়তন যেমনই হোক না কেন, ছোট-বড় সব জিনিস সাজানো থাকলে দেখতে ভালো লাগে। কাজ করেও আরাম পাওয়া যায়। সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তো আছেই।
‘প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো, যেমন-চিনি, লবণ, চা পাতা সব সময় চুলার পাশে রাখি। কারণ, এগুলো সব সময় কেবিনেট থেকে বের করা ঝামেলা। তেল ও চিনি পুরো বোতলে না রেখে অর্ধেক করে নিয়ে চুলার পাশে রাখা যেতে পারে। হাঁড়ি-পাতিলসহ আনুষঙ্গিক জিনিস নিচে রাখাই সুবিধাজনক।
‘মসলার কৌটাগুলো কেবিনেটের ওপরের তাকে রাখা যেতে পারে। তবে প্রতিটি কৌটার গায়ে অবশ্যই লেবেল দেওয়া উচিত; এতে বিড়ম্বনা এড়ানো যায়।’
গৃহিণী মোতাহেরা মাহমুদ বলেন, ‘গৃহিণীর ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতাই পারে রান্নাঘরের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে। রান্নাঘরের সামগ্রী ধোয়ার জন্য বেশি ক্ষারযুক্ত বা লিকুইড সাবান ব্যবহার করা ঠিক নয়। এতে উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়। রান্নাঘরে ব্যবহৃত তোয়ালে, ন্যাপকিন প্রতি সপ্তাহে ধোয়া উচিত। চুলার ডান পাশে মসলাপাতি আর বাঁ পাশে ফ্রাইপ্যান, কাটার, চাকু, চ্যাপিংবোর্ড রাখা ভালো। প্রতিদিন যা প্রয়োজন হয়, তা চোখের সামনে ও হাতের নাগালের মধ্যেই রাখা উচিত।’
গৃহিণীদের মতো কর্মব্যস্ত নারীরা রান্নাঘরের দেখভাল করতে পারেন না। সারাদিন অফিস করে রান্নাঘর সামলানো তাঁদের কাছে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে সুসজ্জিতভাবে সবকিছু চোখের সামনে রাখলে কাজ করা সহজ হয়।
আয়েশা বেগম সরকারি চাকরিজীবী। সময় পেলেই রান্নাটা নিজেই সারেন। তিনি সবকিছু এমনভাবে রাখেন, যাতে প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘সহজে কিছু পেলে সময়ও বাঁচে, মেজাজও খারাপ হয় না। সে জন্য আমি স্বয়ংক্রিয় গ্যাসের চুলা ব্যবহার করি। এতে ম্যাচ বা লাইটার খোঁজার ঝামেলা নেই।’
রন্ধনশিল্পী সিতারা ফেরদৌসী বলেন, ‘রান্নাঘর সব সময় সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিষ্কার রাখা উচিত। এতে মন ভালো থাকবে। মন ভালো থাকলে যেকোনো কাজ ভালোভাবে পরিচালনা করা যায়। আর আজকাল বাজারে প্রতিটি জিনিস রাখার জন্য আলাদা আলাদা হোল্ডার পাওয়া যায়। এসবে রান্নাঘরের তৈজসপত্র রাখলে তা সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যাবে। তবে অপ্রয়োজনীয় জিনিস যেন কখনোই রান্নাঘরে না থাকে। অপ্রয়োজনীয় জিনিসের ভিড়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটিই খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।’
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহীন আহমেদ বলেন, ‘একজন গৃহিণীর রুচি ও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর রান্নাঘর দেখে। এ জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পরিচালনা। আধুনিক রান্নাঘরে কিচেন কেবিনেট থাকে, ফলে সহজেই সবকিছু হাতের কাছে পাওয়া যায়।
যাদের রান্নাঘরে কেবিনেট নেই, তাঁরা দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া তাক বানিয়ে নিতে পারেন। প্রয়োজনে র্যাক বা মিটসেফও রাখা যেতে পারে। দাঁড়িয়ে রান্না করা স্বাস্থ্যসম্মত। সে ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, চুলার উচ্চতা যেন কোমর অবধি থাকে। অনেকে দাঁড়িয়ে রান্না করতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন না। তাঁরা চুলার নিচে ইট বা কাঠ দিয়ে উঁচু করে নিতে পারেন। এতে মোড়ায় বসেও রান্না করতে পারবেন।
‘চার থেকে ছয় সদস্যবিশিষ্ট পরিবারে দুই বার্নারের চুলা ব্যবহার করা উচিত। চুলার বিপরীত পাশে সবসময় বাসনপত্র ধোয়ার বেসিন বা সিংক করা উচিত। ন্যাপকিন, তোয়ালে চুলার পাশেই রাখা উচিত, যাতে গরম কিছু সহজেই ধরা যায়। রান্নাঘরের ভারী সরঞ্জামাদি, শুকনো বাজার, কম ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিচের তাকেই রাখা উচিত।’
হাতের মুঠোয় রান্নাঘর
–নিত্যদিনের অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস, যেমন-চা, চিনি, লবণ, তেল, গুঁড়ো দুধ প্রভৃতি চুলার পাশেই রাখা উচিত।
–চুলার পাশের তেলচিটচিটে ভাব দূর করতে লেবু-সাবান-পানি দিয়ে ধুতে হবে।
–সিংকের পাশে দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী রাখতে র্যাক রাখা যেতে পারে। র্যাকের এক পাশে নানা আকারের বাটি, ছোট প্লেট এবং অন্য পাশে খাবার প্লেট রাখা যেতে পারে।
–র্যাকের নিচে প্রতিদিনের ব্যবহার্য হাঁড়িপাতিল, গামলা রাখা যেতে পারে। মগও র্যাকে ঝুলিয়ে রাখা যেতে পারে।
–ধুলোবালি থেকে রক্ষা করতে র্যাকের ওপর কাপড়ের পর্দা ব্যবহার করা যেতে পারে।
–সিংকের পাশে ট্রেতে কাপ-পিরিচ, চামচ রাখা যেতে পারে।
–চুলার পাশে কাটার, চ্যাপিংবোর্ড, ছাঁকনি, ছুরি, চামচ রাখা যেতে পারে, যাতে রান্নার সময় সহজেই পাওয়া যায়।
–কম ব্যবহার্য চামচ পলিথিনের ব্যাগে মুড়িয়ে হাতের কাছের ড্রয়ারে রাখা যেতে পারে। পোকামাকড় বিশেষ করে তেলাপোকার উপদ্রব ঠেকাতে ড্রয়ারগুলো সপ্তাহে দুই দিন পরিষ্কার করা উচিত।
–সিংকের নিচে ময়লা ফেলার ঝুড়ি রাখা উচিত।
–রান্নাঘরের পাশে ছোট বারান্দা থাকলে এবং পানির ব্যবস্থা থাকলে মাছ-মাংস সেখানেই কেটে নেওয়া উচিত।
–রান্না করা খাবার সব সময়ই ঢেকে রাখা উচিত।
–বেকিংয়ের উপাদানসামগ্রী আলাদা বাক্সে রাখা উচিত।
–ওপরের তাকে ছোট জিনিস রাখা যায়। উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওপরের তাক তৈরি করা উচিত, যাতে হাত বাড়ালেই সব নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়।
–রান্নাঘরের সরঞ্জামাদি অ্যালুমিনিয়াম বা প্লাস্টিকের হলে ভালো হয়। কারণ, এগুলো পরিষ্কার করা সহজ।
–সামর্থ্য থাকলে রান্নাঘরে এগজস্ট ফ্যান লাগানো উচিত। এতে রান্নাঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
–ছোট রান্নাঘরে ভাপসা ভাব থাকে। মসলার গন্ধ রাঁধুনির শরীরেও লেগে থাকে। ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকলে এ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
–রান্নাঘরের কাজকর্ম যেন সহজে এবং পরিমিত চলাফেরার মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায়, তার ব্যবস্থা থাকা উচিত। অবশ্যই সপ্তাহে একদিন রান্নাঘরের সবকিছু পরিষ্কার করা উচিত।
রন্ধনশিল্পকে সমাদৃত করতে রসুইঘরের সঠিক পরিচালনার বিকল্প নেই। রান্নাঘরের সামগ্রী যেমনই থাকুক না কেন, তা সুন্দর করে সাজিয়েগুছিয়ে পরিষ্কার রাখলে মনে প্রশান্তি আসে। আপনার রান্নাঘরকে মনের মতো সাজিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিন।
সতর্কতা
–গ্যাসের চুলা দুই মাস পরপর পরীক্ষা করা উচিত।
–দুর্ঘটনা এড়াতে রান্নাঘরে পর্যাপ্ত পানি ও বালি রাখা উচিত।
–রান্নাঘরে অবশ্যই পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকা উচিত।
তৌহিদা শিরোপা
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২১, ২০০৮
ভূলু'স রেসিপি
রান্নাঘর নিয়ে খুবই ঘুছানো একটা লেখা, রান্নাঘরটাও এইরকম করে ঘুছিয়ে রাখতে হয়, পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। পরিবারের সবার স্বাস্থ্য বলে কথা। এমন আরো কিছু ভাল লেখা আশা করি।
ধন্যবাদ
ভূলু, ভুলুস রেসিপি
http://vulusrecipe.blogspot.com