নারী-পুরুষ বৈষম্যের স্বরূপ সন্ধান
যতীন সরকার
নারী-পুরুষ বৈষম্য: জীবতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট—মনিরুল ইসলাম \ সংহতি প্রকাশন, ঢাকা \ ফেব্রুয়ারি ২০১০ \ প্রচ্ছদ: অমল আকাশ \ ১১২ পৃষ্ঠা \ ১৮০ টাকা
নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা এখন প্রায় সবাই সোচ্চার। এ বৈষম্য বজায় থাকুক এমনটি যারা চায়, তারাও সোজাসুজি সে কথা বলতে পারে না, নানা ধানাইপানাইয়ের আশ্রয় নেয়।
কিন্তু আমরা যারা উচ্চকণ্ঠে এই বৈষম্যের বিরোধিতা করি, তারাও কি তা মনেপ্রাণে বা বুঝেশুনে করি? বৈষম্যের মুখ্য ও গৌণ কারণ সম্পর্কে কি আমরা অবহিত? বৈষম্য-অবসানের বিজ্ঞানসম্মত পথের সন্ধান কি আমাদের জানা আছে?
এসব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিব্রত হওয়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর থাকে না। কারণ আমাদের জ্ঞানের পরিধি একান্তই সীমিত ও একপেশে। সামাজিক বিজ্ঞানের ছিটেফোঁটা জ্ঞান যাদের আছে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের অধিকাংশেরই জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। আবার এর উল্টোটাও সত্য। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যারা পড়াশোনা করে, সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কে তেমন কোনো কৌতূহলই তাদের নেই। প্রাকৃতিক ও সামাজিক উভয় প্রকার বিজ্ঞানেরই বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে যাদের অবহিতি আছে, তারাও সেসব তথ্যের তত্ত্ব সম্পর্কে তেমন সচেতন নয়। সঠিক তত্ত্বজ্ঞান ছাড়া কারও ভেতর বিজ্ঞানমনস্কতার সঞ্চার ঘটে না। বিজ্ঞানমনস্ক যে নয়, বিজ্ঞানের শুষ্ক তথ্য দিয়ে কোনো বিষয়েরই প্রকৃত সত্য উদ্ধারে সে সক্ষম হয় না। বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই যে বিজ্ঞানমনস্ক নয়—এমনটি তো আমরা হরহামেশাই দেখি। এমন মানুষদের পক্ষে, অন্য অনেক বিষয়ের মতো, নারী-পুরুষ বৈষম্যের হেতু নির্ণয় বা নিদান সন্ধান করাও একেবারেই অসম্ভব।
সুখের বিষয়, নারী-পুরুষ বৈষম্য: জীবতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট বইটির লেখক মনিরুল ইসলাম আমাদের জন্য আশার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে এসেছেন। বইটির নামে যদিও প্রকাশ পায় যে জীবতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটেই নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিষয়টি লেখক অবলোকন করেছেন, তবু বইটি পাঠের মধ্য দিয়ে যেকোনো পাঠকই অনুভব করবেন, জীবতত্ত্বের সীমার মধ্যেই লেখক তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ রাখেননি। জীবতত্ত্বের পরিধি অতিক্রম করে সমাজতত্ত্বের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ মনিরুলের জ্ঞানচর্চা সামগ্রিকতাকে স্পর্শ করেছে। শুধু তাই নয়, তাঁর তত্ত্বজ্ঞান ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের ভিত্তির ওপর স্থাপিত। ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের আলোকে অবলোকন করেছেন বলেই নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ে প্রচলিত ধারণাসমূহের ভ্রান্তি নির্দেশে তিনি যেমন নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, তেমনই বুর্জোয়া নারীবাদ থেকে তাঁর ভাবনার স্বাতন্ত্র্যকে স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছেন।
অনেক পড়াশোনার মধ্য দিয়ে মনিরুলের নিজস্ব ভাবনার বৃত্তটি গড়ে উঠেছে। ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে লিঙ্গবৈষম্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন এমন বিদেশি গুণিজনের চিন্তাধারার সঙ্গেও তিনি পরিচিত। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ব্রিটিশ মার্কসবাদী নারীবাদী মিশেল ব্যারেটের উইমেনস ওপ্রেশন টুডে এবং জারমেইন গ্রিয়ারের ফিমেইল ইউনাচ বই দুটোতে বিধৃত লিঙ্গবৈষম্যের উৎস, এর অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তাঁর চিন্তায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সে আলোড়নই ছায়া ফেলেছে মনিরুল ইসলামের বইটির পাতায় পাতায়। ‘নারী-পুরুষের জৈবিক গঠনের তারতম্য’কে যে ‘নারীর অধস্তনতার পক্ষে প্রাকৃতিক যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে’, সেসব যুক্তি যে নিতান্তই অপযুক্তি ও কুযুক্তি—মনিরুল ইসলামের লেখায় সে বিষয়টিই অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে উদ্ঘাটিত হয়েছে।
মনিরুল ইসলামের বইয়ের মাত্র প্রথম খণ্ডটি আমাদের হাতে এসেছে। এতে—
‘নারী-পুরুষের শারীরিক পার্থক্যের মৌলিক তিনটি দিক মস্তিষ্ক, কাঠামো ও মাংসপেশি এবং প্রজনন ও যৌনতা সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা এবং পক্ষপাত রয়েছে সেগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করা হয়েছে।’
ওই সব ভুল ধারণা ও পক্ষপাতকে ভিত্তি করেই পুরুষতন্ত্র নারীকে হেয় করে রেখেছে। প্রাকৃতিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই যে নারী কোনোমতেই পুরুষের সমান অধিকার পেতে পারে না, সেই পূর্বনির্ধারিত ধারণা প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম ইংরেজ ঔপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উলেফর কথা স্মরণ করেছেন। উল্ফ বলেছেন, ‘যে পাখির পাখা বাঁধা আছে তাকে বলা হচ্ছে উড়তে পারে না। উড়তে পারে না কথাটি ঠিক কিন্তু তার উড়ার ক্ষমতা নেই সে কথা তো ঠিক নয়।’
অথচ এই বেঠিক কথাটিই যে ‘জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতির এ যুগেও’ অধিকাংশ মানুষের চৈতন্যে দৃঢ়মূল হয়ে আছে, মনিরুল ইসলাম তারই বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন। প্রথম খণ্ডে যেসব বিষয় বিশ্লেষণ করতে পারেননি, বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে যে সেসব বিষয়ই বিশ্লেষিত হয়েছে, সাগ্রহে সেই দ্বিতীয় খণ্ডটির জন্য অপেক্ষা করছি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৯, ২০১০
Leave a Reply