মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে (ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে লিখিত) বাংলায় কড়ির ব্যবসায়ীদের এবং হাটবাজারে কড়ি দিয়ে কেনাকাটার একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা রয়েছে। এই বর্ণনায় সোনা ও রুপার টাকার সঙ্গে দৈনন্দিন খুচরা বেচাকেনার জন্য হাটবাজারে কড়ির ব্যাপক প্রচলনের উল্লেখ রয়েছে। খুচরা বিক্রিবাটার জন্য কড়ি যে রুপার টাকার সহযোগী মুদ্রা হিসেবে ব্যবহূত হতো সে কথা দুই-এক জায়গায় ফুটে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে ধনপতি সওদাগরের আদেশে দাসী দুর্বলার পঞ্চাশ কাহন কড়ি নিয়ে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বাজারে যাওয়ার দিকে তাকানো যাক—‘পান দিয়া দুর্বলারে সাধু (ধনপতি) দিলভার/কাহন পঞ্চাশ লয়ে চলহ বাজার/কিনিতে তোমার যদি নাইি আঁটে কড়ি।/টাকা দুই চারি লবে বণিকের বাড়ি \’
চণ্ডীমঙ্গলে তামার পয়সার উল্লেখ নেই। তবে কড়ির সঙ্গে কখনো কখনো খাদ্যশস্য দিয়ে মূল্য পরিশোধের ইঙ্গিত রয়েছে। ‘চাল ক্ষুদ কিছু লহ কিছু লহ কড়ি’। কড়ি গোনার চারটি এককের খোঁজ পাওয়া গেছে। গন্ডা, বুড়ি, পন ও কাহন।
কড়ি গোনার পদ্ধতি: ‘এক গন্ডা-৪টি কড়ি/এক বুড়ি-২৮টি/এক পণ-৮০টি/এক কাহন-১২৮০টি’।আরও একটি গণনার খোঁজ পাওয়া গেছে: ‘এক গন্ডা-চারটি কড়ি/কুড়ি গন্ডা-এক পণ/চার পনে-এক আনা/চার আনায় এক কাহন/চার কাহনে এক টাকা/অর্থাত্ ৫১২০টি/কড়িতে এক টাকা।’
মুকুন্দরামের লেখায় কড়ির হিসাবে সমসময়ের বিভিন্ন পণ্যের বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তুর দামের বিবরণ রয়েছে। দুর্বলা দাসীর জবানিতে কড়ির ক্রয়ক্ষমতা সম্পর্কেও একটা মোটামুটি ধারণা করা সম্ভব। অবশ্য এক টাকায় কত কড়ি-পয়সা যেত সে সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত না থাকায় এই মূল্যমান অসম্পূর্ণ এবং একপেশে। স্মরণ করা যেতে পারে কোম্পানির আমলের প্রথম দিকে ৫১২০ কড়িতে একটি রুপার সিক্কা টাকা কেনা যেত।
সওদাগরের দাসীটি নিরক্ষর কিন্তু ‘হাটের কড়ির লেখা’ অর্থাত্ বাজারের হিসাবটি তারা কড়ায়গন্ডায় নির্ভুল। তার ভাষায়: ‘হাটের কড়ির লেখা/একে একে দিব বাপা/চোর নহে দুর্ব্বলার প্রাণ।/লেখাপড়া নাহি জানি/কহিব হূদয় গনি/এক দণ্ড করহ বিশ্রাম।’ হিসাব দেওয়ার পর দাসীর দম্ভোক্তি: ‘যদি মিথ্যা হয় আমার ভাষা/কাটিও আমার নাসা।’ দুর্বলার উক্তির মধ্যে ‘হিসেবের কড়ি বাঘে খায় না’ প্রবচনটি যেন উঁকি দিয়ে হাসছে।
ধনপতি সওদাগর তাঁর নাক কেটেছিলেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। তবে আমাদের একটি বড় প্রাপ্তি হয়েছে দুর্বলার কেনাকাটার ফিরিস্তি থেকে। কত কড়ি ফেলে কী পরিমাণ তেল মাখা যায় সে হিসাবটি জুটে গেছে। চণ্ডীমঙ্গলের এমনি পয়ারে চতুর সাধুর দাসী কেনে ‘আট কাহনতে খাসী’ ‘তৈল সের দরে দশ বুড়ি’ (২৮১০ = ২৮০টি কড়ি) অর্থাত্ মুকুন্দরামের কালে দশ বুড়ি ‘কড়ি’ ফেলে এক সের তেল মাখা যেত। আরেক জায়গায় দাসী জানাচ্ছে, ‘তৈল ঘি লবণ ছেনা’ ‘পাচকাহন’-এ কেনা। এ ছাড়া দাসি হাটের ফকিরকে কড়ি-খয়রাত দিয়েছিল ধনপতির মঙ্গল কামনায়। মুরন্দরামের পয়ারে জানা গেল ‘হাটে ভ্রমে অনুদিন সেখ ফকির উদাসীন/ব্যয় হৈল সপ্তদশ বুড়ি’ দাসীর নিজের খাবারের জন্য চার পন আর দশজন ভারীর জন্য দশ পন কড়ি খরচ হলো। কড়ির ক্রয়ক্ষমতা সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা হলেও কড়ির সঙ্গে রুপার টাকার বিনিময় মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে এসব দ্রব্যের কড়ির হিসেবে মূল্যের তারতম্য ঘটত তা বলাই সঙ্গত হবে।
বাংলাদেশ মোগলদের আওতায় আসার পর তাদের দখল করা সব অঞ্চলের মতো বাংলায়ও সোনা, রুপা, তামা—তিন ধাতুর মুদ্রা চালু করার উদ্যোগ তারা নিয়েছিল। —মা. আ.
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০২, ২০১০
Leave a Reply