ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি হিউ পোপ মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর ৩০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ডাইনিং উইথ আল-কায়েদা: থ্রি ডিকেডস এক্সপ্লোরিং দ্য মেনি ওয়ার্ল্ডস অব দ্য মিডল ইস্ট। বইটির একটি আলোচনা দ্য ইকনোমিস্ট-এর ৪ মার্চ ২০১০ সংখ্যা থেকে অনূদিত হলো।
ফিলিস্তিন এখন বাসি খবর—বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকালেন সম্পাদক। সম্পাদকের এ রকম প্রতিক্রিয়া অবশ্য নতুন কিছু ছিল না হিউ পোপের জন্য। একাগ্র ও চিন্তাশীল এই সাংবাদিক ৩০ বছর হন্যে হয়ে ঘুরেছেন মধ্যপ্রাচ্যের মরু-প্রান্তরে; বিবিক্ত, নিরবলম্ব এক অন্বেষণে। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যে রহস্য কিংবা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে পশ্চিমা পাঠককুলে (যেমন, ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব আরব-ইসরায়েল শান্তিপ্রক্রিয়াকে বানচাল করে দিচ্ছে, ইসলামি ইরান পশ্চিমা সভ্যতার আমৃত্যু শত্রু), তিনি তার পাঠোদ্ধার করতে চেয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘ, ক্লান্তিকর ও কঠিন এই পথচলা শেষে তাঁর উপলব্ধি খুব বেদনাদায়ক। ব্যথিত চিত্তে তিনি খেয়াল করেছেন, যা কিছু তিনি লিখেছেন, যেসব ঝুঁকি তিনি নিয়েছেন তা পশ্চিমাদের মনে কোনো রেখাপাত করতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে তারা এখনো অবিবেচক, এখনো তারা অনধিকার চর্চা করে চলেছে সেখানে।
কিন্তু তাঁর এই সফর দারুণ একটি বইয়ের জন্ম দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু গল্প আর নিবন্ধের সংকলন ডাইনিং উইথ আল-কায়েদা। সিরিয়ায় একজন ফ্রি-ল্যান্সার হিসেবে শুরু করে ২০০০ সালে তিনি হয়েছেন ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি। তাঁর কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে উত্তর আফ্রিকা থেকে আফগানিস্তান অবধি। কখনো তাঁকে ঘাঁটি গাড়তে হয়েছে ইস্তাম্বুলে, বছরে দু-একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়েছে সৌদি আরব কিংবা উপসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে, আর চোখ রাখতে হয়েছে প্রায় সবখানেই। বিরাট দায়িত্ব সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘটনাবহুল।
উপাত্ত সংগ্রহে তিনি এত বিনয়ী ও সচেতন ছিলেন যে এ ক্ষেত্রে কোনো রূঢ়তার আশ্রয় তিনি নেননি। তাঁর তিনটি গুণ এ কাজে তাঁকে খুব সাহায্য করেছে। এগুলো হলো—তিনি একজন বহুভাষাবিদ (আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন), মনোযোগী শ্রোতা ও নিবিড় পর্যবেক্ষক। ‘ইরানে আপনি যা দেখবেন,’ পোপ বলছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে সেখানে তা নেই।’ ইরান যখন বলে, ‘আমেরিকা নিপাত যাক’, মাঝেমধ্যে এর অন্তর্নিহিত অর্থ দাঁড়ায়, তিনি ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, ‘আমেরিকা, আমাদের দিকে একটু মুখ তুলে তাকাও।’ অন্তর্নিহিত সত্যগুলোর এই দ্ব্যর্থবোধকতা, কথার এই কূটাভাস পারসিয়ানরা শিখেছে তাদের চতুর্দশ শতকের কবি মোহাম্মদ হাফিজের কাছে, এ রকমটিই তিনি মনে করেন। মক্কায় ধর্ম বিষয়ে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করার সময় তিনি উদ্ধৃত করেছেন চতুর এক ভিন্নমতাবলম্বীকে, ‘ওয়াহাবিরা বলে, “আল-কায়েদা আমাদের অংশ না” এবং এটা বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু আমার কাছে এ দুয়ের পার্থক্য হচ্ছে মার্লবোরো ও মার্লবোরো লাইটের মধ্যে যে পার্থক্য, সেটুকুই।’
যে পরিচ্ছেদটির নামে বইটির নামকরণ তা একটু হাস্যকর শোনালেও ঘটনাটা কিন্তু সত্য। ঘটেছিল রিয়াদে, ৯/১১-এর কয়েক মাস পরে। তিনি কথা বলছিলেন এক তরুণ মোল্লার সঙ্গে, তাঁর ওয়াহাবি বিশ্বাস নিয়ে। তাঁর প্রতি ছেলেটির প্রথম কথা ছিল, ‘তোমাকে তো আমার খুন করা উচিত।’ তাঁকে তিনি নিরস্ত করেন মহানবীর এক হাদিস বলে, ‘যারা বিশ্বাসীদের আশ্রয়ে আছে তারা নিরাপদে থাকুক।’ এই তরুণ জেহাদি আফগানিস্তানে আল-কায়েদার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি যুদ্ধের ট্রেনিং নেননি, কিন্তু তাঁর মৌলবাদী বিশ্বাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার শিক্ষা পেয়েছেন। তরুণটি দাবি করছিলেন, ৯/১১-এর নায়কদের অনেককেই তিনি চেনেন এবং তাদের প্রতি তাঁর ভক্তি-শ্রদ্ধাও দেখার মতো। তরুণটির সঙ্গে তাঁর আরেকবার দেখা হয় একটি চীনা রেস্তোরাঁয়; মুখে না দিয়ে ওই তরুণ একটা স্প্রিংরোল গুঁড়ো করছিলেন। তাঁর আচার-আচরণ একটু অদ্ভুত। কিন্তু পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার যৌক্তিকতা নিয়ে তাঁর মনে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর এই অবস্থান বা বিশ্বাস নিশ্চয়ই এখন আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।
যেহেতু তরুণটির পরিচয় অনিশ্চিত এবং আল-কায়েদার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও পরিষ্কার নয়, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল তাঁকে নিয়ে তাঁর প্রতিবেদন ছাপাতে অস্বীকৃতি জানায়। সত্ সংবাদপত্র হিসেবে ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু এর সম্পাদকীয় নীতি নিয়ে তাঁর আপত্তি আছে, বিশেষত প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হিসেবে যেগুলো নির্বাচন করা হয় সেগুলো নিয়ে। দেখা যায়, সম্পাদক বিবর্জন, পরিমার্জন কিংবা শিরোনাম তৈরির মধ্য দিয়ে যেকোনো প্রতিবেদনকেই যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলপন্থী কিংবা ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তোলেন।
হিউ পোপ সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়ে পড়েন ইরাক আক্রমণের ঠিক আগ মুহূর্তে। তিনি একেবারে নিশ্চিত ছিলেন, গণতন্ত্রটনতন্ত্র কিছু না, সাদ্দাম হোসেনকে উত্খাতের এটি একটি বাহানা মাত্র। কিন্তু কোনো পত্রিকাই এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন ছাপতে আগ্রহী ছিল না। শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধের সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালকে (অন্যান্য পত্রিকা, যেমন দি ইকনোমিস্ট-এর মতো তাদের সম্পাদকীয় নীতিও ছিল যুদ্ধের পক্ষে) তিনি রাজি করাতে পেরেছিলেন। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরের দিনই প্রথম আক্রমণটি হয়। যুদ্ধের সময় ইরাকি কুর্দিস্তান থেকে তিনি প্রতিবেদন পাঠাতেন, নিজের মতগুলো বিসর্জন দিয়েই। তিনি স্বীকার করেছেন, অনেক সময়ই তাঁর কাজ তিনি ঠিকমতো করতে পারেননি। কিন্তু আমরা জানি, বেশির ভাগ সময়ই তিনি তা করতে পেরেছেন।
অনুবাদ: তামিম ইয়ামিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০২, ২০১০
Leave a Reply