একক নারীকে কেন্দ্র করে
নারী এবং ক্রমপরিবর্তিত সভ্যতা— উইনিফ্রেড হল্টবি \ অনুবাদ: মোবাশ্বেরা খানম \ ফেব্রুয়ারি ২০১০ \ সুবর্ণ, ঢাকা \ ১৮৩ পৃষ্ঠা \ ২৫০ টাকা।
বিশ শতকের প্রথমার্ধের একজন ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, শান্তিবাদী ও নারীবাদী লেখিকা উইনিফ্রেড হল্টবি। ১৯৩৪ সালে তাঁর উইমেন অ্যান্ড এ চেঞ্জিং সিভিলাইজেশন গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ বইটি নারী এবং ক্রমপরিবর্তিত সভ্যতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন মোবাশ্বেরা খানম। উইনিফ্রেড হল্টবির লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় যত্সামান্য। তাঁর একটি মাত্র বই আমি পড়েছি অনেক দিন আগে—ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার অঞ্চলের কাল্পনিক পটভূমিতে রচিত উপন্যাস সাউথ রাইডিং, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল লেখিকার মৃত্যুর পর, ১৯৩৬ সালে। অনেকের মতে, বইটি হল্টবির সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। মোবাশ্বেরা খানম অনূদিত নারী এবং ক্রমপরিবর্তিত সভ্যতা আমার হাতে আসার এবং এর কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর আমাদের স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি মূল ইংরেজি বইটি বেশ সময় নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছি। তারপর বাংলা সংস্করণটি মোটামুটি মন দিয়েই পড়ার পর আমার মনে হয়েছে মোবাশ্বেরার অনুবাদ অথবা ভাষান্তর, যাই বলা যাক—সার্থক।
মোবাশ্বেরার করা ভাষান্তর কয়েকটি পঙিক্ত উল্লেখ করা যাক—‘বিংশ শতাব্দী মানুষের যৌক্তিকতাবোধকে বৃত্তচ্যুত করে সেই স্থানে বসিয়েছে তার স্মৃতি ও স্নায়ুকে। ফ্রয়েডিয়ান মনস্তত্ব যৌনতার শীর্ষ ও চরম অবস্থানকে অনুমোদন দিয়েছে। ডিএইচ লরেন্সের অনুসারীরা আমাদের শিখিয়েছে সহজাত প্রবৃত্তি, আবেগ ও ইন্দ্রিয়ের অন্তর্জ্ঞানের প্রাণশক্তিকে শ্রদ্ধা করতে এবং সেই সঙ্গে শিখিয়েছে কুমারীকে করুণা করতে গভীর ও মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্জ্ঞানী ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার বলয়ের বাইরে থাকার জন্য। নারীকে শেখানো হয় নিজেদের করুণা করতে। শৈশব থেকে তারা “বয়স্ক কুমারীর ভাগ্যকে” ভয় করতে শেখে। আরও পরিশীলিত বলয়ে তারা পূর্বাভাস পায় “জটিলতর” নিয়তির।’ (১৩৪ পৃষ্ঠা) আক্ষরিক অনুবাদ অবশ্যই নয়, তবে মূল ইংরেজি ভাষ্যের তাত্পর্য আমার মতে মোবাশ্বেরার সাবলীল ভাষান্তরে যথাযথভাবে প্রতিফলিত। এমন দৃষ্টান্ত মোবাশ্বেরার বইয়ের প্রায় সমস্ত পৃষ্ঠা থেকেই উদ্ধৃত করা যায়। আমার বিশেষ করে এই অংশটি বেছে নেওয়ার কারণ হলো যে এখানে উইনিফ্রেড হল্টবি তাঁর সমসাময়িক সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থানকে যেভাবে দেখেছেন বা ব্যাখ্যা করেছেন, আজকের সমাজব্যবস্থায় সেই অবস্থান অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়ে থাকলেও একবিংশ শতকের তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তা নারীর অনেকেই ‘বয়স্ক কুমারীর ভাগ্যকে ভয় করার’ বদলে জয় করতে এখনো পুরোপুরি শেখেননি—কেবল আমাদের দেশে নয়, পশ্চিমের দেশগুলোতেও।
উইনিফ্রেড হল্টবির প্রথম উপন্যাস এন্ডারবাই ওয়ার্ল্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে। বলা যেতে পারে, এই বইটিই তাঁকে সেই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য লেখক হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়। এর কিছু আগে থেকে শুরু করে প্রায় দুই দশক ধরে হল্টবি উপন্যাস, ছোটগল্প ইত্যাদি যেমন লিখে গেছেন, তেমনি সাংবাদিক হিসেবেও তাঁর চাহিদা বাড়তে থাকে এবং নারীবাদী সাময়িক পত্রিকা টাইম অ্যান্ড টাইড, মূলধারার সংবাদপত্র দি ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান, ট্রেড ইউনিয়ন পত্রিকা দি স্কুল মিসট্রেসসহ প্রায় বিশটির বেশি পত্রপত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখে চলেন। ‘লিগ অব নেশনস ইউনিয়ান’-এর বিভিন্ন অধিবেশনেও তিনি নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন। তবে সবকিছুর ওপরে তিনি ছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের একজন পুরোধা, বিশ শতকের গোড়ার দিকের পুরুষ আধিপত্যপ্রধান সমাজব্যবস্থায় নারীর অধিকার, দৈনন্দিন জীবনে নারীর ভূমিকার গুরুত্বের যথাযোগ্য মর্যাদা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টায় তিনি আজীবন সক্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে, হল্টবি তাঁর সমস্ত উপন্যাস, ছোটগল্প ও রাজনৈতিক লেখায় চিরকুমারী বা একক নারীর ভাগ্য সম্পর্কে মনস্তাত্বিক ও যৌনসম্পর্ক-সংক্রান্ত তত্কালীন সংজ্ঞাগুলোকে খারিজ করে দিয়ে এর মূলকে চিহ্নিত করেছেন নারী জাগরণবিরোধিতার এবং যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী বছরগুলোতে একক নারীকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ইস্যু বা বিষয়ে অব্যাহত ব্যাপক ও সংগঠিত প্রচারকাজের অন্যতম প্রধান উপজীব্য ছিল এই জাতীয় যুক্তিতর্ক ও চিন্তাভাবনা। উইমেন অ্যান্ড এ চেঞ্জিং সিভিলাইজেশন বইটি বিভিন্ন অধ্যায়ে হল্টবির এই দর্শনেরই প্রতিফলন ঘটেছে।
তিনি বলেছেন, বাস্তবে বিবাহিত ও অবিবাহিত উভয় শ্রেণীর নারীর জীবনেই অর্থহীনতা ও হতাশার অনুপাত প্রায় সমান সমান। তাদের এই ‘ভাগ্যের’ বা ‘দুর্ভাগ্যের’ প্রতিকার হলো যৌনসম্পর্কের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং উপযুক্ত স্বাধীন বৃত্তির ও অর্থপূর্ণ জীবনের সন্ধান পাওয়ায় তাদের সক্ষম করা, এমন এক জীবন যেখানে বিবাহই একমাত্র পরিপূর্ণতা নয়, নানা সম্ভাবনার মধ্যে একটি মাত্র। আমাদের দেশে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রদের কিংবা সংস্কারপন্থী সক্রিয়তাবাদীদের বাইরে হল্টবির মূল গ্রন্থের পাঠক খুব বেশি না থাকাই স্বাভাবিক। তবে আশা করতে দোষ কী যে মোবাশ্বেরা খানমের ভাবান্তরকৃত নারী এবং ক্রমপরিবর্তিত সভ্যতা এই গণ্ডির বাইরেও সমাদৃত হবে।
আমি নিজে মাঝেমধ্যে অল্পবিস্তর ইংরেজি-বাংলা অনুবাদের কাজ করে থাকি। অন্য কারও করা অনুবাদ পড়তে গিয়ে অনেক সময়েই আমার মনে হয়েছে—আহা, এটার অনুবাদ আমি নিজে বোধহয় আরও ভালো করতে পারতাম। কিন্তু সম্পূর্ণ অকপটে স্বীকার করছি, মোবাশ্বেরা খানমের ভাষান্তরকৃত বইটি পড়ার সময়ে সে কথা আমার একবারও মনে হয়নি।
সাগর চৌধুরী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০২, ২০১০
Leave a Reply