জগন্নাথ কলেজের স্মৃতি
স্মৃতি-বিস্মৃতির জগন্নাথ কলেজ—মির্জা হারুণ-অর-রশিদ \ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ \ মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ৩৮০ পৃষ্ঠা \ ৪৫০ টাকা।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে জগন্নাথ কলেজ, ব্যক্তি হিসেবে অসংখ্য মানুষ এবং ওই সব চরিত্র অথবা কুশীলবের সংবেদনশীলতা মির্জা হারুণ-অর-রশিদের বই স্মৃতি-বিস্মৃতির জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থের মূল বিবেচ্য। এই গ্রন্থের অন্যতম মূল ও প্রধান চরিত্র অজিত গুহ সম্পর্কে সুধা সেন বলেছেন, ‘জগন্নাথ কলেজের ছাত্রছাত্রীই নয় শুধু, তার প্রতিটি ইটের প্রতিও বুঝি ছিল তাঁর অপরিসীম মমতা আর ছিল বিদ্যাতীর্থে আত্মদানের স্পৃহা’ (অজিত গুহ স্মারকগ্রন্থ, ১৯৯০), তা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জগন্নাথ কলেজকে যেমন, তেমনি এর সঙ্গে আন্তরিক ও প্রকৃত অর্থে সংশ্লিষ্ট কুশীলবদের মনোভাবকেও প্রকাশ করেছে। ‘কীর্তিমান অধ্যাপকদের কেউ কেউ’ যে জগন্নাথকে ‘শিক্ষাদীক্ষাবর্জিত গ্রাম্য একটি কলেজ’ বলে বিবেচনা কিংবা ছাত্রাধিক্যের জন্য একে ‘জগুবাবুর পাঠশালা’ বলে কটাক্ষ করতেন, তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে এই প্রতিষ্ঠান যে অসাধারণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে, বইটি তার সাক্ষ্য হয়ে থাকবে।
জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগের যে তিন শিক্ষক তাঁদের কর্মজীবনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তাঁদের একজন মির্জা হারুণ-অর-রশিদ। বাকি দুজন—শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। শওকত আলী অনুরোধ করেন, ‘আমরা তো কেউ কিছু করলাম না, আপনি জগন্নাথ কলেজের একটি স্মৃতিচারণা করুন।’ তারই ফল এই গ্রন্থ।
স্মৃতিচারণার অধিকার ছিল তাঁরই। কারণ স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তিন শিক্ষকের বাকি দুজন অবসর গ্রহণ বা মৃত্যুর আগে অন্যত্র বদলি হয়ে যান। কিন্তু মির্জা হারুণ-অর-রশিদ নানা টানাপোড়েন ও শঙ্কা সত্ত্বেও ১৯৬৩তে যোগ দিয়ে ১৯৯৬-এ অবসরপূর্ব ছুটিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে একটানা তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত করেন।
মির্জা হারুণ-অর-রশিদ একটি প্রসঙ্গে জগন্নাথকে বলেছেন, তাঁর ‘প্যারেন্ট কলেজ’। দীর্ঘদিন জগন্নাথে অবস্থান করে শওকত আলী উপলব্ধি করেন, ‘ভালোমন্দ মিলিয়ে’ জীবন ও মানুষ এবং ‘মানুষই প্রতিষ্ঠান গড়ে এবং তার পরিচিতির বিস্তার ঘটায়’। তিনি আরও মনে করেন, ‘এই সব নাম, এই সব ব্যক্তি আলাদা আলাদাভাবে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির সঞ্চয়—কিন্তু একসঙ্গে এঁরা প্রতিষ্ঠান, যার নাম জগন্নাথ কলেজ। এখানেই তিনি বুঝতে পারেন, কাকে বলে ‘সৃজনশীল শিক্ষকতা’। এ কথাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে বলেছিলেন অজিত গুহ। ‘কলেজের কাজকে চাকরি বলে গণ্য কোরো না। শিক্ষকতা… চাকরি নয়। ক্রিয়েটিভ কাজ।’ তিনি হাসান হাফিজুর রহমানকেও বলেছিলেন, শিক্ষকের দাঁড়ানোর মধ্যে তাঁর বৈশিষ্ট্যকে খুঁজে পাওয়া যায়। এ কারণে নির্ধারিত ক্লাসের বাইরেও শওকত আলী উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব, স্ট্রিম অব কনশাসনেস অথবা অস্তিত্ববাদী দর্শন পড়িয়েছেন। সে জন্য তিনি জগন্নাথে আনন্দে অবস্থান ও তাতেই প্রস্থান করেন।
১৯৭১-এর একটি তিক্ত স্মৃতির মধ্যে এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও কবি-লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র জগন্নাথের উল্লেখে কীভাবে বদলে যান তার যে উল্লেখ আনিসুজ্জামান করেছেন, তাতে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বই প্রধান হয়ে ওঠে। ‘হঠাত্ বিরক্তভাব অদৃশ্য হয়ে মুখে প্রসন্নতার আলো ফুটে উঠল। তাঁর সময়কার জগন্নাথ কলেজের কথা বললেন, ঘরবাড়ি-গাছপালার খবর নিলেন।… চলে গেলেন ভালোলাগার কোনো অতীতে।’
এই প্রতিষ্ঠান লেখকদেরও প্রাশ্রয় দিয়েছে। শওকত আলীর স্মৃতিচারণা, ‘যখন সুমসাম হয়ে যেত কলেজের চারদিক, তখন ওই সময় আমি বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের কক্ষে একাকী বসে লিখতাম।… শুধু আমি নই, ওই ঘরে দিনের পর দিন টাইপ করতে দেখা যেত অধ্যাপক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে।’ ভাবতে কি ভালো লাগে না এইখানে রচিত হয়েছে লেলিহান সাধ অথবা শুন হে লখিন্দর-এর কোনো গল্প বা প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর কোনো অংশ কিংবা চিলেকোটার সেপাই অথবা গল্পের কোনো খসড়া?
মির্জা হারুণ-অর-রশিদের বর্ণনা থেকে বুঝতে পারি, হাসান হাফিজুর রহমানের ভুলও কীভাবে পরিণতিতে যৌক্তিক ও মানবিক হয়ে ওঠে। তাঁর এ গ্রন্থে রয়েছে বহু শিক্ষকের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ও অসাধারণত্বের কথা। একটি উদাহরণ: ইতিহাসের অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র সাহা। একদিন হারুণ-অর-রশিদ দেরি করে ক্লাসে যাওয়ার সময় তাঁর সামনে পড়েন। গম্ভীর হয়ে তিনি বলেন, ‘হারুণ, শোন, তুমি প্রায়ই দেরি করে ক্লাসে আসো বলে তোমার ছেলেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হইচই করে আমার ক্লাস নষ্ট করে ফেলে। আমি ঠিকমতো আমার ক্লাস নিতে পারি না। এজন্য…।’ এতে মির্জা হারুণ দুঃখ প্রকাশ করে আর কখনো এ রকম হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। তার পরের আরেক দিনের ঘটনায় নারায়ণবাবু বলেন, ‘হারুণ, আমি দুঃখিত, তুমি আজ আমাকে হারিয়ে দিয়েছ, আজ আমার আসতে দেরি হয়ে গিয়েছে।’ মির্জা হারুণ এঁদেরই বলেছেন ‘জাতশিক্ষক’।
এ কারণে আমরা দেখব, শান্ত ও স্নিগ্ধ রুচির অধ্যাপক অজিত গুহ জগন্নাথ কলেজ গেটে পুলিশি হামলা শুরু হলে ছাত্রদের রক্ষা করার জন্য যেমন এগিয়ে এসেছেন, তেমনি আবার বন্ধু সায়ীদুল হাসানের সঙ্গে দাঙ্গা-উপদ্রুত এলাকায় প্রাণের তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অজিত গুহ তখনকার এক ছাত্রনেতাকে তাই যথার্থ বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতি করি না ঠিক, কিন্তু অরাজনৈতিক নই।’
অতএব সরকারীকরণের পর মির্জা হারুণ তাঁর বইয়ে অজিত গুহর পদত্যাগকে যে ‘অভিমানসুলভ আবেগপ্রবণতা’ বলেছেন, তা যথার্থ নয় এ কারণে যে মোনেম খানের শেষ পর্বের এই মরণকামড়কে তিনি পূর্বাহ্নেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। এর জন্য অন্য কোনো সাক্ষ্যের প্রয়োজন নেই, কারণ স্মৃতি-বিস্মৃতির জগন্নাথ কলেজ-এর অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে। মির্জা হারুণই তাঁর বইতে সরকারীকরণের পর শিক্ষকদের কেরানি, কর্মকর্তা ও আমলা হওয়ার যেসব উদাহরণ দিয়েছেন, তাতে অজিত গুহর মতো সুরুচিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে অরাজক সেই পরিস্থিতিতে শ্বাস নেওয়াও সম্ভব ছিল না। সত্য বটে, তিনি তার পর এবং হয়তো এরই প্রতিক্রিয়ায় আর বেশি দিন বাঁচেননি, কিন্তু অভব্য আচরণ ও মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের অতীতের বিশ্বস্ত সাক্ষ্য হিসেবে এই বই সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা দরকার। বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্টরা এই বই পড়ে যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাধারণ পাঠকের কাছে তা যথেষ্ট কৌতুহলোদ্দীপক বলে বিবেচিত হবে।
শান্তনু কায়সার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০২, ২০১০
Leave a Reply