ক্লিনটন বুথ সিলি সেই ১৯৬৩ সালে প্রথম এসেছিলেন আমাদের এই বাংলায়। দুটো বছর পার করে ফিরে গেছেন নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু তাঁকে ছেড়ে যায়নি বাংলা আর বাংলা ভাষার টান। সেই ভালোবাসার টানেই গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সুদীর্ঘ ৩৫ বছর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন বাংলার শিক্ষক। অধ্যাপক ক্লিনটন বুথ সিলি এখন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনে কাটাচ্ছেন অবসর জীবন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা সম্প্রতি তাঁকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদানের আবেদন জানিয়েছেন। ই-মেইলে সাক্ষাত্কারটি দিয়েছেন উইসকনসিনে বসেই। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন: ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় কীভাবে?
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময় জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। আইওয়া শহরে লেখালেখিবিষয়ক একটি কর্মশালায় এসেছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত। এই কর্মশালায় অতিথি হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ এবং বাংলাদেশের মোহাম্মদ রফিকও ছিলেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে কর্মশালা শেষ হওয়ার পর জ্যোতি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে এসেছিলেন। জ্যোতিই আমাকে প্রথম পড়তে দিয়েছিলেন জীবনানন্দের কবিতা। আমার পিএইচডির বিষয় হিসেবে জীবনানন্দের কবিতা বেছে নেওয়ার পরামর্শ তিনিই দিয়েছিলেন। আমি তাঁর কথামতোই কাজ করেছিলাম।
জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী লাবণ্য দাশের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল।
কলকাতার বালিগঞ্জের ট্রায়াঙ্গুলার পার্কে জীবনানন্দ দাশের ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশের বাসায় শ্রীমতী লাবণ্য দাশের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তত দিনে তিনি আমার স্বামী জীবনানন্দ দাশসহ বেশ কয়েকটি লেখা লিখে ফেলেছেন। আমরা তাঁর লেখা নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ গল্পগুজব করেছি। তিনি ঢাকার ইডেন কলেজের স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। আর বলছিলেন জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হওয়াটা কত অবাক করা একটা ব্যাপার ছিল। আমি তাঁর সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী ছিলাম। এখনও আমার জীবনানন্দ দাশের ভ্রাতুষ্পুত্র অমিতানন্দ দাশের সঙ্গে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হয়।
আপনি বরিশালে ছিলেন দীর্ঘদিন। বরিশালের দিনগুলো কেমন ছিল? কোনো বিশেষ ঘটনা কি এখনো খুব মনে পড়ে?
আমি বরিশালে পিস কোরের একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পুরো দুই বছর সময় কাটিয়েছি (১৯৬৩-১৯৬৫)। বরিশাল জিলা স্কুলের নতুন ভবনের দোতলায় একটা ক্লাসরুমে আমার থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। আমি যে বছর বরিশালে যাই সে বছর প্রচণ্ড একটা ঝড় হয়। ঝড়টা হয়েছিল আমি সেখানে যাওয়ার ঠিক পরের মাসে। মানে নভেম্বরে। রাতে প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছিল। আমার মনে আছে, সারা রাত জেগে ছিলাম। বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে আমার এক কামরার বাসাটি রীতিমতো পানিতে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। আমি স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষকদের ব্যবহারিক ক্লাসে সহায়তা করতাম। আমার বেশির ভাগ সময় কাটত টিচার্স রুমে। সেখানে আমি প্রথম ক্যারম খেলতে শিখেছিলাম। বরিশালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল এর নদীগুলো। প্রথম দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে আমি স্টিমারে চেপে বরিশাল ঘাটে নেমেছিলাম। সেই ভ্রমণের আনন্দের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুরই তুলনা চলে না।
আপনার শৈশব কোথায় কেটেছে ?
আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় বড় হয়েছি। ১১ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম সানফ্রান্সিসকো। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর আমি পিস কোরে যোগ দিই।
এ সময়ের কোনো বাংলাদেশি কবির কবিতা কি আপনি পড়েছেন?
জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে গবেষণার সময় অনেক কবিতাই আমার পড়তে হয়েছে। সে তালিকা অনেক দীর্ঘ। আইওয়া শহরে মোহাম্মদ রফিক যখন এসেছিলেন, সে সময় তাঁর কয়েকটি কবিতা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি। এগুলোর কোনোটাই প্রকাশিত হয়নি। আমার প্রবন্ধ সংকলন ব্যাক টু বরিশাল-এর ‘ভিউয়িং বাংলা লিটারেচার’ প্রবন্ধটিতে আমি শামসুর রাহমানের একটি কবিতা অনুবাদ করে ব্যবহার করেছি। ওই একই অধ্যায়ে আমার অনূদিত শহীদ কাদরীর একটি কবিতাও ছিল।
বাংলা ভাষা শিখতে আপনার কত সময় লেগেছে?
আমাদের পিস কোরের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আমার পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার আগেই আমাদের তিন মাস ভাষা শিখতে হয়েছে। কোনো ভাষা শেখার জন্য তিন মাস খুব অল্প সময়। তবে যে উপকারটা হয়েছে, আমরা বাংলা সম্পর্কে মৌলিক ধারণাটা এর মাধ্যমে পেয়েছিলাম। ড. মোজাফ্ফর আহমদ সে সময় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পিএইচডি করছিলেন। তিনি আমাদের ভাষাশিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী রওশন জাহানও আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। শেখার মূল কাজটা হয়েছে বরিশালে গিয়েই। আমি বরিশালের টানে মোটামুটি ভালোই বাংলা বলি। ভাষা শেখাটা একটি সীমাহীন প্রক্রিয়া। বলতে পারেন, আমি এখনো বাংলা শিখছি।
আপনার দেখায় তখনকার আর এখনকার বাংলাদেশের মধ্যে কোনো তফাত অনুভব করেন?
সবচেয়ে বড় পার্থক্য, এখনকার দেখা বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি যখন প্রথমবার গিয়েছিলাম তখন মনে করেছি, আমি পাকিস্তানেই যাচ্ছি। তখনো আমি জানি না, এ ভূখণ্ডে ১৯৫২ সালে কী ঘটেছিল বা ১৯৭১ সালে কী ঘটতে চলেছে। অতএব, তফাত তো থাকবেই।
কবি হিসেবে জীবনানন্দ দাশের কোন দিকগুলো আপনাকে আকর্ষণ করে?
শুরুতেই জীবনানন্দ দাশের চিত্রকল্পের যে নতুনত্ব, যে অবাক করা ব্যাপার সেটাই আমাকে আকর্ষণ করেছিল বেশি। তাঁর প্রকৃতির বর্ণনা প্রায়ই রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। যেমন: ‘…কোনো এক শীতের রাতে/একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে’ অথবা ‘চাঁদ ডুবে চলে গেলে—অদ্ভুত আঁধারে/যেন তার জানালার ধারে/উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।’
প্রকৃতির এমন কিছু দিকের ওপর তিনি আলো ফেলেছেন, যাঁর কথা আপনি-আমি হয়তো আগে চিন্তাই করিনি।
আর যদি চিন্তা করেও থাকি, তাঁর মতো এত বিশদভাবে কেউ দেখিনি: ‘নদীর তীক্ষ শীতল ঢেউয়ে সে নামল—/ঘুমহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটু আবেগ দেওয়ার জন্য/অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য…’
এখন তাঁর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণগুলোও আমাকে সমানভাবে নাড়া দেয়। সব মিলিয়েই আসলে জীবনানন্দ দাশ অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর।
যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কি আপনার সাক্ষাত্ বা যোগাযোগ হয়? তাঁদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
এখানে মোটামুটি বেশ বড়সড় দুটো বাঙালি সংগঠন আছে। দুটো সংগঠনের সঙ্গেই আমার বেশ ভালো সম্পর্ক। দুই সংগঠনেরই বেশ কিছু উৎসব-অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিয়েছি।
১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে আমাকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল। এ সম্মেলনের আয়োজক ছিলেন মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরাই। বাংলা সম্মেলনেও আমি কয়েকবার যোগ দিয়েছি। মুক্তধারা নিউইয়র্কে যে সম্মেলন আয়োজন করে সেখানেও আমি গেছি। বলতে পারেন, উত্তর আমেরিকার বাঙালিদের সঙ্গে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক।
সম্প্রতি আপনাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা, এ বিষয়ে কিছু বলবেন।
আমি এতে ভীষণ গৌরব বোধ করছি। এটা আমার জন্য একটা বড় সম্মান। বরিশাল জিলা স্কুলের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক প্রাক্তন ছাত্র সাঈদ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী বরাবর লেখা তাঁর একটি আবেদনপত্র আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। এটি ছিল আমার জন্য পুরোপুরি অভাবনীয় একটি ঘটনা। চিঠি পড়ে আমি যাকে বলে আকাশ থেকে পড়েছি। এখন সাঈদের সঙ্গে আমার প্রায়ই যোগাযোগ হয়। আমি জানি, সাঈদ একা নন। তবে সম্ভবত তিনিই এই কাজটা শুরু করেছেন। অনেক বাঙালিই এই আবেদনকে সমর্থন করেছেন। যাঁদের কেউ কেউ আমার পরিচিত। অন্যরা একদমই অচেনা। ওঁদের সবার প্রতিই আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বাংলা একাডেমী ২০০৯ সালে আমাকে ফেলোশিপ দিয়েছে। এটাও আমার জন্য বিশাল একটি সম্মান।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কোনো অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা?
আমি ৩৫ বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষা দিয়েছি। মনে রাখার মতো ঘটনা বলতে আমার একটা কথাই মনে হয়, সেটি এই বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের ধরনে পরিবর্তন। এ পরিবর্তন হয়েছে একদম আস্তে-ধীরে। একটা সময় ছিল, এ বিভাগে একদম অবাঙালি বা ভিনদেশি শিক্ষার্থীরাই বেশি ভর্তি হতেন। যাঁদের কারোরই বাংলা ভাষা বা ঐতিহ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এখন কিন্তু আগের চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক বাঙালি-আমেরিকান শিক্ষার্থী বা দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালিরা এই বিভাগে ভর্তি হচ্ছেন। ভিনদেশিদের চেয়ে এঁদের সংখ্যাই এখন বেশি। ওঁরা কেউ হয়তো বাংলা একটু বলতে পারেন বা একটু বোঝেন, কিন্তু লিখতে পারেন না। অনেকেই আবার আছেন খুব ভালো বাংলা বলেন, এমনকি রবীন্দ্রসংগীতও গাইতে পারেন। কিন্তু বাংলা বর্ণমালা ওঁরা লিখতে পারেন না। আমার দেখাতেই এ পরিবর্তনটা আমি উপলব্ধি করেছি। এটাই সবচেয়ে স্মরণীয় ব্যাপার বলে মনে হয়।
উইসকনসিনে আপনার দিনকাল এখন কেমন কাটছে?
আমি ২০০৬ সালের গ্রীষ্মে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয়ভাবে শিক্ষকতার কাজ থেকে অবসর নিয়েছি। এরপর আমি আমার স্ত্রীসহ চলে আসি উইসকনসিনে আমার নিজের বাড়িতে। জায়গাটা মিশিগান হ্রদ আর গ্রিন বের মাঝামাঝি। গত বছরের জুন মাসে আমার এক ছাত্র পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটকের ওপর একটি গবেষণা করেছে। তাঁর ডিসার্টেশন ডিফেন্সের দিনে আমি শিকাগোয় উপস্থিত ছিলাম। এখন ইমেইল ও ইন্টারনেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ হয়। এখন উইসকনসিনের বাড়িতে বইপত্র পড়ে, মৌমাছির পরিচর্যা করে আর বাগানে কাজকর্ম করে বেশির ভাগ সময় কাটাই।
সামনে বাংলাদেশে আসার পরিকল্পনা কি আছে?
নিশ্চিত করে বলা খুব মুশকিল। এ মুহূর্তে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা আগেভাগে কে-ই বা আর বলতে পারে?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২০, ২০১০
Leave a Reply