জীবনে কত আশার স্বপ্ন দেখলাম।
আশায় নেশায় পড়ে কত গান লেখলাম ॥
গানের আসরে যখন গান গাইতে যাই।
মধ্যে মধ্যে গরিবের দুঃখের গান গাই ॥
কার কাছে কী বলিব মনে এল ভয়।
তখন ছিল মুসলিম লীগের লুটপাটের সময় ॥
মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিলাম।
শোষক বিরোধী গানে সুর তখন দিলাম ॥
বিশ্বাস করে রাজনীতিতে মিশে পড়লাম ।
আওয়ামী লীগে তখন যোগদান করলাম ॥
সংগঠনে সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলাম।
সুনামগঞ্জে কর্মীদের সঙ্গে নাম দিলাম ॥
স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব করে বিশ্বের ঘরে ঘরে।
রোজই খবরে শুনি কত মানুষ মরে ॥
কেহ শোষক আর কেহ বা শোষিত।
এই নিয়ে পরিবেশ হয়েছে দূষিত ॥
মেহনতি সবাই তারা করে উৎপাদন।
শোষক চায় শোষণ করে উন্নতি সাধন ॥
শোষকের মনে কোনো দয়া মায়া নাই।
শোষিতগণ করে তাদের বাঁচার লড়াই ॥
ব্রিটিশ শাসনে দেশ ছিল যখন।
স্বদেশী আন্দোলন দেশে আসিল তখন ॥
কৃষক মজুর মেহনতি মানুষ ছিল যারা।
শান্তির আশায় আন্দোলনে যোগ দিল তারা ॥
দুঃখে গড়া জীবন আমার দুঃখে কষ্টে চলে ।
একদিন শুনি ছাত্রগণ বন্দে মাতরম বলে ॥
একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম তখন।
কী বলে কী করতে চায় এই ছাত্রগণ ॥
বুঝাইয়া বললেন তিনি জিজ্ঞাস করার পরে।
আমাদের দেশে বিদেশীরা শাসন শোষণ করে ॥
পরাধীন হয়ে দেশে বেঁচে থাকা দায়।
দেশের জনগণ এখন স্বাধীনতা চায় ॥
স্বাধীন হলে অন্যায় অবিচার হবে না।
দুঃখী মানুষের কোনো দুঃখ রবে না ॥
দুঃখীর দুঃখ রবে না যখন শুনলাম ।
তখন মনে এক আশার জাল বুনলাম ॥
বিশ্বাস নিলাম স্বাধীন হলে দুঃখ রবে না।
আমরারও দুঃখ কষ্ট সইতে হবে না ॥
স্বাধীনতা পাব মনে আশা নিলাম।
পরে কী ঘটিল তাহা অজ্ঞাত ছিলাম ॥
অন্য কিছু নয় বুঝি আমি মুসলমান।
উঠিল এক অগ্নিবাণী লড়কে লেংগে পাকিস্তান ॥
কাটাকাটি লুটালুটির খবর পেয়েছি।
এই সমস্ত ভিত্তি করে কত গান গেয়েছি।
শোষকগণ মানুষকে কুমন্ত্রণা দিল ।
হিন্দু-মুসলমানে তখন দাঙ্গা বেঁধেছিল ॥
জানি না কে যে কার মন্ত্রণা লইল।
যার ফলে দেশ তখন বিভক্ত হইল ॥
মারা গেলেন অনেক হিন্দু-মুসলমান।
শোষিতের মুক্তি এল না এল পাকিস্তান ॥
সাধারণ মানুয়ের মনে কত আশা ছিল।
সুকৌশলে পাকিস্তান জন্ম তখন নিল ॥
পাকিস্তানে স্বৈরাচার লভিল আসন।
ইচ্ছা মতো চালাইল শোষণ শাসন ॥
সাধারণ মানুষের মনে ছিল কত আশা।
স্বাধীন হবে সুখে রবে বাধবে সুখের বাসা ॥
কৃষক মজুর মেহনতিদের আশায় ছাই দিল ।
পরে ভাবি শোষক তার শোষণের সুযোগ নিল ॥
নিরাশা দুরাশায় মানুষ অসহায় হলো।
স্বার্থপরগণ বলে শুধু জিন্দাবাদ বলো ॥
.
শান্তির পরিবর্তে দুর্নীতি বাড়িল ।
জনগণ মুসলিম লীগের সমর্থন ছাড়িল ॥
পরে নির্বাচনের ডাক যখন পড়িল।
বিরোধীগণ মিলে সবাই যুক্তফ্রন্ট গড়িল ॥
বিরোধী বলিতে তারা বহু দল ছিল।
আওয়ামী লীগ প্রধান ভূমিকা তখন নিল ॥
গানের আসরে যখন গান গাইতে যাই।
মধ্যে মধ্যে গরিবের দুঃখের গান গাই ॥
গান গাই-আসলে অর্থ সম্পদ নাই।
যেখানে লোকে চায় সেখানেই যাই ॥
জগন্নাথপুর আসর করার দায়িত্ব নিলাম।
আমি এবং কামাল উদ্দিন দুইজন ছিলাম ॥
বাজারে আসর করা হলো চমৎকার।
আসরে লোক ছিল হাজার হাজার ॥
সিলেটের কৃতী সন্তান আবদুস সামাদ।
জনসেবা করবেন বলে মনে নিয়ে সাধ ॥
পার্লামেন্টে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন।
যুক্ত ফ্রন্টের নৌকাতে বাদাম দিলেন ॥
অশান্তির আঁধারে আসলেন শান্তির বাণী মুখে।
গ্রহণ করে নিল তাকে এই এলাকার লোকে ॥
এলকাবাসীর সঙ্গে পিরিত বাড়ালেন ।
দিরাই-জগন্নাথপুর থেকে তখন দাঁড়ালেন ॥
নির্বাচনের কাজে এই এলাকায় ছিলেন।
আসরে গান শোনার সুযোগ নিলেন ॥
সামাদ মিয়া গান শুনিলেন বসে এই আসরে।
গানের পরে আমাকে নিলেন খবর করে ॥
গণ্যমান্য লোক নিয়ে বসেছিলেন।
যাওয়ার পর হাত ধরে টেনে নিলেন ॥
আলোচনায় দিগ্বিদিক তুলে ধরলেন।
পরে আমাকে এক অনুরোধ করলেন ॥
দেখেন দেশে ন্যায়নীতি সমবণ্টন নাই।
আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চাই ॥
রচনা করে যখন গান গাইতে পারেন।
শোষিত মানুষের কথা তুলে ধরেন ॥
আপনার এই গানগুলোর এখন দরকার।
উৎখাত করিতে এই মুসলিম লীগ সরকার ॥
আপনি আমার সব নির্বাচনী সভায়।
গান গাইবেন আপনাকে জনগণ চায় ॥
সভাতে মাইক তখন প্রথম পেয়েছি।
মানুষের সুখ দুঃখের কত গান গেয়েছি ॥
বক্তব্যের আসল কথা সহজ ভাষায় গাই।
সাধু কি চলিত ভাষা সেই বিচার নাই ॥
জনসভাতে গান যখন গেয়েছি।
সভাতে উপযুক্ত সমর্থন পেয়েছি ॥
শোষিত শ্রেণীতে যখন জন্ম নিলাম ।
জন্মগত প্রতিবাদী আমি ছিলাম ॥
যুক্তফ্রন্ট জিন্দাবাদ ধ্বনি উঠিল ।
স্বৈরশাসক মুসলিম লীগের সমাপ্তি ঘঠিল ॥
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করলেন।
আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার গড়লেন ॥
সব সময় গনতন্ত্রের কথা বলেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধান মন্ত্রী হলেন ॥
রাজনীতি-সমাজনীতিতে ছিলেন সজীব।
দুর্নীতিদমনের মন্ত্রী হলেন শেখ মুজিব ॥
সুনামগঞ্জে সফরে আসলেন যখন।
সামাদ মিয়া সঙ্গে ছিলেন তখন ॥
এই দুইজনের প্রতি মানুষ আশাবাদী ছিল।
দূরের লোক কষ্ট করে দেখার সুযোগ নিল ॥
আমিও সমাবেশে অংশ নিলাম।
জনসভায় তখন গান গেয়েছিলাম :
পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা
চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা
জনগণের নয়নতারা
শেখ মুজিবুর রহমান
জাগ রে জাগ রে মজুর-কৃষাণ ॥
গণসঙ্গীত পরিবেশন করলাম যখন।
একশত টাকা উপহার দিলেন তখন ॥
শেখ মুজিব বলেছিলেন সৎ-আনন্দমনে ॥
‘আমরা আছি করিম ভাই আছেন যেখানে’ ॥
শহীদ সোহরাওয়ার্দী দেশকে ভালোবাসলেন।
সরকারি সফরে তখন সিলেট আসলেন ॥
শহীদ সাহেবের প্রতি আস্থাশীল ছিল।
অসংখ্য মানুষ এই সভায় যোগ দিল ॥
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হলে পরে।
শুনি তখন মাইকে ঘোষণা করে ॥
বাউল কবি আবদুল করিম গান এখন ধরবেন।
তিনি একটি পল্লীর গান পরিবেশন করবেন ॥
জনসভায় গান গাওয়ার সুযোগ পাইলাম।
মানুষের সুখ-দুঃখের গান একটি গাইলাম ॥
জনগণ আরেকটা শুনতে চাইলে পরে।
গাইলাম একটি গ্রামগঞ্জের অবস্থা তুলে ধরে ॥
আমি যখন গান গাই জনতার আসরে।
তখন এই দেশে দুর্ভিক্ষ বিরাজ করে ॥
এই সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল।
গ্রাম গঞ্জে লঙ্গরখানা খুলে তখন দিল ॥
বর্তমান অবস্থা বলতে ইচ্ছা করলাম।
ক্ষুধার্ত মানুয়ের কথা তুলে ধরলাম ॥
এই দেশের দুর্দশার কথা কী বলব সভায়।
পেটের ক্ষুধায় কত লোক লতাপাতা খায় ॥
জনাব মৌলানা ভাসানী গরিবের বন্ধু তিনি।
চিন্তা করেন দিনরজনী গরিব দুঃখীর দায় ॥
মৌলানা ভাসানীর শুনি নামের ধ্বনি।
কৃষক মজুর মেহনতিদের জন্য পরশমনি ॥
লক্ষ করলাম মনোযোগে গান শুনে নিলেন।
জেব উজার করে আমাকে উপহার দিলেন ॥
বুঝিলাম আমার প্রতি সদয় হলেন।
আরেক আশ্বাস বাণী পরে বলেন ॥
বলব আতাউর রহমানের সাথে ।
তোমার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা হয় যাতে ॥
একদিন ডিসি সাহেবের খবর পাইলাম।
দেখা করে বিষয় কী জানতে চাইলাম ॥
ডিসি বললেন, আপনাকে ডাকছেন সরকার।
কাগমারী সম্মেলনে যাওয়া দরকার ॥
আমি বললাম, আমি যে কাউন্সিলার নই।
আমি কেন যাব আর খরচ পাব কই ॥
ডিসি সাহেব বললেন, আমি ব্যবস্থা নিতেছি।
আপনার যা প্রয়োজন আমি দিতেছি ॥
একশন টাকা আর কম্বল একখান।
দিয়ে বললেন সবাই যাচ্ছে আপনিও যান ॥
সিলেট থেকে যাত্রী সেদিন অনেকেই ছিলেন।
আদর করে আমাকেও সঙ্গে নিলেন ॥
মহা এক আনন্দে কাগমারী গেলাম।
সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের দেখা পাইলাম ॥
ক্যাম্পে আছেন বন্ধুবান্ধব, কাছে বসেছে।
দেখেই বললেন, হে আমার করিমভাই এসেছে ॥
সবাইকে পরিচয় দিলেন, আমার করিম ভাই।
গণসঙ্গীত শিল্পী সে আমি ভালো পাই ॥
প্রথমে বললেন, আপনার শরীর ভালো আছে?
পরে বললেন, ডিসি আপনার খরচ দিয়াছে ॥
স্নেহভরে কাছে নিয়ে হাত চেপে ধরলেন।
পরে একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন ॥
বললেন, দেখি তোর কাছে টাকা আছে কত?
থাকে যদি তা হলে আমাকে দে তো ॥
সে বুকের পকেট থেকে বাহির করে দিল।
ভদ্রলোকের পকেটে দেড়শো টাকা ছিল ॥
টাকাগুলো তখন নিজ হাতে নিলেন।
পরে তাহা আমাকে দিয়ে দিলেন ॥
দিয়ে বললেন, এগিয়ে চল, নাই কোনো ভয়।
গণসঙ্গীতগুলো যেন জোরদার হয় ॥
একটি কথা আমায় অন্তরে গাঁথা।
আজো ভুলি নাই আমি রমেশ শীলের কথা ॥
শুনেছি রমেশ শীল জেলে ছিলেন।
মুক্ত হয়ে সম্মেলনে অংশ নিলেন ॥
গণসঙ্গীতের আসরে গান তখন গেয়েছি।
বিভিন্ন শিল্পীদের সাক্ষাৎ পেয়েছি ॥
নেতাকর্মী সবাই তখন উপস্থিত ছিলেন।
মৌলানা ভাসানী আমাকে আশীর্বাদ দিলেন ॥
পূর্ববর্তী:
« জীবনপ্রদীপ করে নিমিঝিমি
« জীবনপ্রদীপ করে নিমিঝিমি
পরবর্তী:
জীবনে বাসনা ছিল কৃষ্ণ সঙ্গে মিলিতে »
জীবনে বাসনা ছিল কৃষ্ণ সঙ্গে মিলিতে »
Leave a Reply