তখন সুনামগঞ্জে বহু গান গেয়েছি।
মানুষের ভালোবাসা আনন্দ পেয়েছি ॥
সুনামগঞ্জবাসী গানকে ভালোবাসতেন।
নানা স্থানের বাউলগণ তখন আসতেন ॥
দুর্বিন শাহ-কামাল উদ্দিন-আবদুস সাত্তার।
বারেক মিয়া-অমিয় ঠাকুর-আসকর আলী মাস্টার ॥
আসর হলে নিমন্ত্রণ আমিও পাইতাম।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গান তখন গাইতাম ॥
ছোটো একটি বই ছাপার উদ্যোগ নিলাম।
সুনামগঞ্জের রায় প্রেসে বই ছাপতে দিলাম ॥
‘আফতাব সঙ্গীত ছিল বইখানার নাম।
আবদুল করিমের গান বারো আনা দাম ॥
বই ছাপা করে গেলাম মুর্শিদের কাছে।
মুর্শিদ বললেন, তোমার সঙ্গে আলোচনা আছে ॥
মনে যে দুর্বলতা বিবাহ করবে না।
বিয়ে করে সংসারের ফাঁদে পড়বে না ॥
তুমি তোমার পিতামাতার একমাত্র ছেলে।
সর্বদা ভ্রমণে থাক তাহাদের ফেলে ॥
এই অবস্থায় বল তুমি কতদিন রবে।
পিতামাতার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে হবে ॥
এখন এক অন্য পরিবেশে পড়িবে।
কিছুদিনের মধ্যেই তুমি বিবাহ করিবে ॥
নিয়তির বিধানে তোমাকে যাহা দিবে।
মনানন্দে তুমি তাহা গ্রহণ করে নিবে ॥
মুর্শিদের কথা শুনে নীরব রইলাম।
পরের দিন বাড়ির পথে রওয়ানা হইলাম ॥
রাস্তার পাশে বাড়ি এক ধর্ম-মেয়ে ছিল।
দেখা পেয়ে প্রায় জোর করে তার বাড়িতে নিল ॥
কী করা যায় সেই দিন সেখানে রইলাম।
ধর্ম-মেয়ের বাড়িতে মুসাফির হইলাম ॥
ধর্ম-মেয়ের পড়শি এক গরিব কৃষক ছিল।
এই ভদ্রলোক আমাকে দাওয়াত করে নিল ॥
পরে জানিলাম তত্ত্ব বহুদিন ধরে।
আমার মুর্শিদকে তারা শ্রদ্ধা ভক্তি করে ॥
এদের ব্যবহারে মন আকৃষ্ট করিল।
তাদের এক মেয়ে আমার চোখে পড়িল ॥
দেখা মাত্র কী যেন এক অবস্থায় পড়লাম।
আপন মনে অনেক বিচার করলাম ॥
স্বামী স্ত্রী দুইজন তারা ছেলে মেয়ে আছে।
সম্পদ বলতে কিছুই নাই দুঃখে কষ্টে বাঁচে ॥
এক মেয়ে উপযুক্ত প্রায় বিবাহের সময়।
অর্থ সম্পদ না থাকাতে মনে বড় ভয় ॥
সুস্থির মতিগতি সরল শান্ত মন।
গরিবের কুঁড়েঘরে রয়েছে এই ধন ॥
মুর্শিদ আমায় হুকুম করলেন বিবাহ করিতে।
দায়িত্ব মোর অচেনা এক পাখি ধরিতে ॥
সিদ্ধান্ত নিলাম অনেক চিন্তা ভাবনার পরে।
এই মানুষকে নিব চিরসঙ্গিনী করে ॥
পরের দিন বাড়ির পথে যখন চললাম।
ধর্ম-মেয়েকে ডেকে তখন বললাম :
আমার মনের কথা গো মা তোমাকে জানাই।
এই গরিব কৃষকের মেয়েকে আমি চাই ॥
এই কথাটি গো মা তোমাকে যাই বলে।
আমি কিছু জানি না কী হইবে ফলে ॥
ধর্ম-মেয়ে আমার কথায় গুরুত্ব দিল ।
সূক্ষ্ম মনে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিল ॥
মেয়ের পিতার সঙ্গে আলোচনা করে।
একমত হইল যে বহু চেষ্টার পরে ॥
মেয়ের পিতামাতা কথা যখন দিল।
ধর্ম-মেয়ে পরে অন্য ব্যবস্থা নিল ॥
মুর্শিদ সাহেবকে মেয়ে দাওয়াত করিল।
শক্ত করে মুর্শিদের চরণে ধরিল ॥
মেয়ে বলল সেবা করার ক্ষমতা মোর নাই।
তবুও যে আপনার চরণধুলা চাই ॥
অদ্য না হয় বলেন কবে যাইতে পারেন।
কথা দেন নইলে আমাকে প্রাণে মারেন ॥
কবে আসিবেন মুর্শিদ এই কথা যখন পাইল।
তখন আমার পিতাকেও আনিতে চাইল ॥
পিতা এবং মুর্শিদ সাহেব কথা দিলেন।
তারিখ অনুযায়ী তারা উপস্থিত ছিলেন ॥
গ্রামের মুরব্বি খানাপিনার পরে।
মেয়ে তখন তার কথা তুলে ধরে ॥
শাহ আবদুল করিম ধর্ম-পিতা আমার ।
এই দেখেন এক গরিব লোক নাই খেতখামার ॥
ওনার এক মেয়ে আছে শান্ত-শিষ্ট অতি।
দেখিতে সুশ্রী এবং অতি বুদ্ধিমতী ॥
তখন মেয়েকে এনে সামনে ধরিল।
মেয়ে মুরুব্বিদের সালাম করিল ॥
ধর্ম-মেয়ে বলল, আমার আবেদন জানাই।
এই মেয়েকে আমার পিতার জন্য চাই ॥
এই হলো আমার আশা অন্য কিছু নয়।
পির সাহেব বলিলেই আমার আশা পূর্ণ হয় ॥
মুর্শিদ বললেন, সৎকর্ম উদ্দেশ্য যখন সৎ।
এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমি একমত ॥
পিতা বললেন, পির সাহেব বলিলেন যাহা।
আমিও শ্রদ্ধাভরে মেনে নিলাম তাহা ॥
এখন সম্পূর্ণ কথা শেষ হয়ে রবে।
সময় সাপেক্ষে কাজ সম্পন্ন হবে ॥
ধর্ম-মেয়ে বলল, আমার অন্য কথা নাই।
আমি শুধু আপনাদের আশীর্বাদ চাই ॥
আমি আপনাদের কোনো দাযিত না দিয়া।
আমি আমার পিতাকে করাইব বিয়া ॥
পারি যদি দশ টাকায় কর্ম সারিব।
পারি যদি দশ হাজার খরচ করিব ॥
এরপরে বিবাহের দিন ধার্য হলো।
মুর্শিদ বললেন, সবে এখন আলহামদু বলো ॥
মনানন্দে সবাই তখন আলহামদু বললেন।
শুভ মিলনের জন্য মুনাজাত করলেন ॥
মুর্শিদ যে দিন ধার্য করেছিলেন।
সময়ে কাজ সম্পন্ন করে দিলেন ॥
গরিব কৃষকের মেয়ে কুঁড়েঘরে ছিল।
জীবন সঙ্গিনী রূপে এসে যোগ দিল ॥
সরল শান্ত শুদ্ধমতি সে হলো সুজন।
অশান্ত চঞ্চল আমি হলেম অভাজন ॥
সৎচরিত্র মন পবিত্র ছিল তার গুণ।
সরল বলেই নাম হলো তার সরলা খাতুন ॥
সরলা হতে যে সাহায্য পেয়েছি।
সরলার কাছে আমি ঋণী রয়েছি ॥
খাঁটি মা হবার গুণ সরলার ছিল।
মা বলে কত ছেলে চরণধুলা নিল ॥
সৎসঙ্গ স্বর্গবাস শুনি লোকে বলে।
মাতৃমঙ্গল পরশমণি ভাগ্যে যদি মিলে ॥
গরিব কৃষক হলেন আবদুর রহমান নাম ।
সুনামগঞ্জের অন্তর্গত আসামমুড়া গ্রাম ॥
পিতামাতা আছেন আর বিবাহ করলাম ।
তখন এক অসহায় অবস্থায় পড়লাম ॥
দায়িত্বভার পূর্ব থেকেই মাথায় নিয়েছি।
বোন ছিলেন পাঁচজন বিবাহ দিয়েছি ॥
সম্পদ বলতে কিছুই নাই আমি শুধু আছি ।
প্রধান ভাবনা হলো কী করে যে বাঁচি ॥
বেঁচে থাকতে হলে যে খাওয়ার দরকার।
রোগ হলে প্রয়োজন সুচিকিৎসার ॥
বাসস্থান প্রয়োজন থাকতে যখন হবে।
শিক্ষা বিনে মানুষ কি পশু হয়ে রবে? ॥
বাঁচতে হলে যে নিরাপত্তা দরকার।
মনে ভাবি আমি এখন কী করিব আর ॥
অন্য কোনো উপায় নাই গাই শুধু গান।
জীবন নদীতে নৌকা বাইতে হয় উজান ॥
ভ্রমণে থাকি সদা আমি নহি স্থির।
মনোকষ্টে সরলার চোখে ঝরে নীর ॥
সরলা বলেন একদিন, কী অবস্থায় চলি।
অন্তরে ব্যথা হয় কার কাছে কী বলি ॥
বৎসরে এগারো মাস তোমায় ছাড়া থাকি।
নিরাশার আঁধারে পড়ে কাঁদে প্রাণ পাখি ॥
অনাহারে থাকি যেদিন অন্য উপায় নাই।
তখন শুধু তোমার আশায় পন্থপানে চাই ॥
সরলা শান্তিতে ছিলেন পিতামাতার ধারে।
আশা দিয়ে এনে আমি দুঃখ দিলাম তারে ॥
পিতামাতা আমার আশায় চেয়ে থাকেন।
আমার মঙ্গল কামনায় খোদাকে ডাকেন ॥
কে সরলা কে করিম কেন যে কী করি।
অষ্টপাশে বাধা আছি কখন জানি মরি ॥
এই সমস্ত দুঃখের ছবি মনে যখন ভাসে।
অন্তরে অনুতাপ হয় চোখে জল আসে ॥
পূর্ববর্তী:
« ঢেউয়ের তালে নদীর জলে ছোটেছ উজানে
« ঢেউয়ের তালে নদীর জলে ছোটেছ উজানে
পরবর্তী:
তনু কী আর রবে চিরকাল নাঈম ভেবে দেখলে »
তনু কী আর রবে চিরকাল নাঈম ভেবে দেখলে »
Leave a Reply