আত্মস্মৃতি
সুর তাল ছন্দে যখন গান গেয়ে যাই।
আমার জীবন কাহিনী ছন্দে লেখতে চাই ॥
আমার নাম আবদুল করিম উজান ধল ঠিকানা।
পোস্ট আফিস ধল বাজার দিরাই হলো থানা ॥
মহকুমা সুনামগঞ্জ সিলেট জেলা।
জন্ম আমার হাওরমাতৃক ভাটি এলাকায় ॥
মাতার নাম নাইওরজান বিবি লই পদধূলি ।
পিতার নাম মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী ॥
তেরোশো বাইশ বাংলায় জন্ম আমার ।
মা বলেছেন ফায়ুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার ॥
গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম নিলাম ।
পিতা-মাতার প্রথম সন্তান আমি ছিলাম ॥
পিতা-মাতা রেখেছিলেন আবদুল করিম নাম ।
জানি না কেন যে বিধি হলো বাম ॥
এই দুঃখ কার কাছে কী বলি বলো না ।
স্কুলে লেখাপড়া করা মোর হলো না ॥
সমাজ ব্যবস্থা আমার পক্ষে ছিল না ।
তাই তো আমার খবর কেউ যে নিল না ॥
এই ভাবে লক্ষ লক্ষ করিম জন্ম নিল ।
এই ব্যবস্থা তাদেরও নিঃস্ব করে দিল ॥
জন্ম নিয়ে একজনের সান্নিধ্য পাইলাম ।
পিতামহের ছোটো ভাই নসিব উল্লা নাম ॥
ফকির ছিলেন করতেন সদা আল্লার জিকির ।
ফকিরি বিনে ছিল না অন্য ফিকির ॥
সংসারে ছিল না কোনো মায়ার বাঁধন ।
জীবনে উদ্দেশ্য ছিল আত্মসাধন ॥
শান্তমতি ঊর্ধ্বগতি জ্ঞানী স্থির ধীর ।
অবিবাহিত ছিলেন ত্যাগী ফকির ॥
যৌবন শেষে বার্ধক্য আসিলে পরে ।
মুসাফিরি ছেড়ে তখন বসে পড়েন ঘরে ॥
এই সময় আমি জন্ম নিলাম ।
জন্ম নিয়ে দাদার কোলে স্থান পেয়েছিলাম ॥
সংসারের কাজে মা ব্যস্ত থাকতেন ।
দাদা আমায় আদর করে কোলে রাখতেন ॥
আসতেন তখন ফকির সাধু হিন্দু-মুসলমান ।
লাউ বাজিয়ে গাইতেন তারা ভক্তিমূলক গান ॥
তখন যে গানটি আমার মন আকৃষ্ট করে ।
ভুলি না সে গানটির কথা আজো মনে পড়ে ॥
গানের প্রথম কলি ছিল–’ভাবিয়া দেখ মনে ।
মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে’॥
আমার ছোটো বোন তারা হলো পাঁচজন।
সংসারে আসিল তখন অভাব অনটন ॥
সম্পদ বলতে অল্প কিছু বোরো জমি ছিল।
ঋণের দায়ে তাহা মহাজনে নিল ॥
গরিব হলে আপনজনে বাসে তখন ভিন।
ভরণ-পোষণে দুঃখ বাড়ে দিন দিন ॥
ভরণ-পোষণে তখন অক্ষম ছিলেন।
পিতা-মাতা আমাকে চাকরিতে দিলেন ॥
শিক্ষা নয় চাকরি করি পেটে নাই ভাত।
কী করে বেঁচে থাকা যায় ভাবি দিনরাত ॥
বাঁচার তাগিদে যখন চাকরিতে ছিলাম।
গরু মহিষ রাখালির দায়িত্ব নিলাম ॥
মালিকের চাকরি করি কাজে ব্যস্ত থাকি।
সারাদিন বন জঙ্গলে গরু মহিষ রাখি ॥
সতত পালন করি মালিকের কথা।
খেলাধুলার সময় নাই, নাই স্বাধীনতা ॥
রাখালির দায়িত্বভার সহজ বিষয় নয়।
ভোরবেলা গরু নিয়ে মাঠে যেতে হয় ॥
গরু নিয়ে বাড়ি ফিরি সূর্য অস্তের পরে।
যত্ন করে বেঁধে রাখি নিয়ে গোয়ালঘরে ॥
সকাল-বিকাল গাভি দোহনে সাহায্য তখন করি ।
একজনে গাভি দোহায় আমি বাছুর ধরি ॥
গরু নিয়ে প্রতিদিন হাওরে যাই।
ঈদের শুভদিনে ও আমার ছুটি নাই ॥
চাকরি করি গলে মোর দায়িত্বের ফাঁসি ।
রাত্র হলে পির দাদাকে দেখিতে আসি ॥
বার্ধক্যজনিত রোগে হলেন দুর্বল।
দাদার অবস্থা দেখে চোখে এল জল ॥
নিয়তির বিধানে তিনি ইন্তেকাল করলেন।
যাবার পূর্বে কাছে এনে মাকে বললেন ॥
ছেলে মেয়ে আপনজন কেউ ছিল না আর।
তুমি অনেক সেবা মাগো করেছো আমার ॥
মাত্র একটি ছেলে তোমার আর তো কিছু নাই।
যাবার কালে তার জন্য দোয়া করে যাই।
আল্লার রহমতে সে ভালো পথে যাবে।
সময়ে সৎ মানুষের ভালোবাসা পাবে ॥
আমি তখন গরু নিয়ে হাওরে ছিলাম।
মা যাহা বলিলেন তাহা শুনিয়া নিলাম ॥
দাদার সঙ্গে শেষ দেখার সময় ছিল না।
মনে ভাবি কী করিব বিধি তা দিল না ॥
জন্ম নিয়ে নিরাশার আঁধারে পড়েছি।
অর্ধাহার আনাহার কত করেছি ॥
দেখেছি এই বিপন্ন অবস্থায় পড়ে।
মানুষ মানুষকে কত অবহেলা করে ॥
বঞ্চিত লাঞ্চিত অবহেলিত যারা।
কী ভাবে যে জীবন ধারণ করিতেছে তারা ॥
আজো ভাবি এমন দিন কবে আসিবে?
মানুষ যে-দিন মানুষকে ভালোবাসিবে ॥
পূর্ববর্তী:
« সুবল সখা পাইনা রে দেখা, কইও রাধারে
« সুবল সখা পাইনা রে দেখা, কইও রাধারে
পরবর্তী:
সুরধনীর কিনারায় কি হেরিলাম নাগরী গো »
সুরধনীর কিনারায় কি হেরিলাম নাগরী গো »
Leave a Reply