মাইদুলের মা ছিলেন পলকা শরীরের, যেন একটু জোরে হাওয়া দিলে উড়ে যাবেন। তাঁর ফ্যাকাশে মুখের আশেপাশে উড়ত হাল্কা তেলহীন চুল। এ রকম একটা ছবির ফ্রেমে মা এখন জীবন্ত মাইদুলের কাছে। মাকে কখনো প্রাণ খুলে হাসতে দেখেনি সে; কাঁদতেই বরং দেখেছে কখনো-সখনো, বিশেষ করে বাবা যখন হাতের সুখ মিটিয়ে তাঁকে মারতেন। মার কান্না ছিল শব্দহীন, শুধু খুব কাছে গেলে হালকা, ভেজা কিছু আওয়াজ শোনা যেত, ভেজা মেঘের মধ্য দিয়ে চলা ফিসফাস বাতাসের মতো। মাকে সান্ত্বনা দিতে ভয় পেত মাইদুল, একবার মেরে তার কান ফাটিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। তর পরও সে মার একটা হাত ধরে বসে থাকত, এবং সেই পলকা হাতে বেমানান বেঢপ রুপার বালাটি নাড়াচাড়া করত। মা হাতটা সরাতেন না; অন্য হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে চোখ মুছতেন দু-একবার, অথবা মাইদুলের মাথায় হাত বুলাতেন। মাইদুলের চুলেও তেল পড়ত না, চিরুনি চলত না। মাঝে মাঝে মাইদুলের মনে হতো, বাবা যখন মাকে মারতেন, যেন সে সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধরে তাঁকে থামায়, ধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে ফেলে আসে, নয়তো পুকুরে। মাঝে মঝে সে রাগে গরগর করত, কিন্তু মা তাকে কিছু বলতেন না। মা বলবেন কীভাবে? মা যে ছিলেন বোবা। বোবা, তবে কথা শুনতে অসুবিধা হতো না, মাইদুলের সকল কথাই তিনি শুনতেন, আর চোখ দিয়ে সেগুলোর উত্তরও দিতেন। তাঁর চোখ দুটি পড়তে কোনো সমস্যা হতো না মাইদুলের।
এক দুপুরে যখন সে খেতে বসবে, এক ঘোমটা টানা মহিলাকে নিয়ে বাড়িতে হাজির হলেন বাবা; আর তাঁর ঘণ্টা দুয়েক পর মাইদুলের হাত ধরে তাঁর নানা বাড়ির পথে বেরিয়ে পড়লেন মা। বৈশাখের দিন। গরমে ফাটছে মাঠ, মাটি থেকে উঠছে ভাপ। আকাশটা যেন একটা ওল্টানো কড়াই, পুড়ছে কোনো চুলার গনগনে আগুনে। মার শরীরটা ভালো ছিল না; একটা হাত মচকে ফুলে গিয়েছিল কলসি ভরে পানি আনতে গিয়ে। দোষটা কলসির ছিল না, দোষটা মার দুটি পায়ের। কাদায় পিচ্ছিল ছিল পুকুরের পাড়। মা খেয়াল করেননি। কোনো কিছুতে মার খেয়াল ছিল এমনিতেই কম। শুধু মাইদুল ছাড়া। সেই মাইদুলকে সঙ্গে নিয়ে মা রওনা দিলেন, কাঁধে ফেলা একটা পোঁটলায় তাঁর এক জীবনের সকল সঞ্চয় বেঁধে। মাইদুলের অবাক লাগে, ওই একটা পোঁটলায় তার নিজের সাত বছরের সব সঞ্চয়ের একটা ভাগও যে জুটে গিয়েছিল, তা ভেবে।
নানাবাড়ি মাইল চারেক দূরে। যেতে হবে গ্রাম শেষের মাঠটা পেরিয়ে, রত্না নদীর পাড় ঘেঁষে। একটুখানি যেতেই বাতাস উঠল। আকাশটা গোমড়া ছিল দুপুর থেকেই, মাইদুলের মুখের মতো। এখন সেখানে হঠাত্ উত্তেজনা শুরু হলো। একটা দিক কুচকুচে কালো হয়ে গেল, যেন আকাশটা মার রান্নার সেই পাতিলটার তলা, যে পাতিলটাতে আজ তরকারি রেঁধেছিলেন, আলু আর মিষ্টি কুমড়া, আর জানি কিসব। সে পাতিলটা এখন স্তব্ধ পড়ে আছে রান্নাঘরের সেই কোনায়, যেখানে অনেক দিন দু হাতে মাথাটা ধরে অনেকক্ষণ মা বসে থাকতেন। সেই তরকারি অথবা আরেকটা হাঁড়িতে ফুটানো ভাত আজ খাওয়া হয়নি। বাবা খাচ্ছেন কি না, ঘোমটা টানা সেই মহিলা বাবাকে খাওয়াচ্ছেন কি না, মাইদুল জানে না, এ নিয়ে ভাবতেও চায় না।
মাইদুলের হাত ধরে মা টানলেন, মাইদুল তাকাল। মার চোখ বলছে, ঝড় আসছে, পা চালা। সে পা চালাল। এবং মাঠের মাঝখানের একটা প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছের নিচে এসে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে শুরু হলো ভয়ংকর ঝড়। খ্যাপা বাতাস, ধুলির ঝাপটা। চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের ফলা। কান ফাটানো আওয়াজ। মা তাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলেন গাছটার নিচে। কিন্তু বসে থাকাও কি সম্ভব? মাইদুলের মনে হচ্ছিল, এখনি উড়ে যাবে তারা, উড়ে গিয়ে পড়বে দূর কোনো গ্রামে, যেখানে একটা একচালা ঘর, একটুখানি উঠান আর পুকুর তাদের ডেকে নেবে, আর মা আবার চুলা জ্বালিয়ে রাঁধবেন—একটা পাতিলে আলু আর মিষ্টি কুমড়া, আরেকটা পাতিলে ভাত—আর মা খুব হাল্কা হেসে, প্রায় না হাসার মতো চোখ মেলে বলবেন, খুব খিধে লেগেছে লক্ষ্মীটি? নে, খেয়ে নে।
মাইদুলের ভয়ানক খিধা লেগেছে, ঘুমও পাচ্ছে। কিন্তু মা যে ঝড়ে উড়ে যেতে পারেন, সেই ভয়ে তাকে সে জড়িয়ে ধরেছে, এখন ঘুমানো যাবে না। তার চোখ ঘুরছে চারদিকে, বিশাল গর্জনে ধেয়ে আসা বাতাসের পাকগুলো অনুসরণ করে। সে দেখতে পেল, কোথা থেকে এক ঝাঁক ফটিকজল উড়ে এসেছে—না, ফটিকজল না, ফটিকজল তো ছোট, এগুলো হলদে বউ, অনেকটা শালিকের মতো—এবং আশ্রয় নিতে চেষ্টা করছে গাছটাতে। তারা যে এখনো বেঁচে আছে, উড়ছে এই অসম্ভব ঝড়ের মধ্য দিয়ে, তা অবাক করল মাইদুলকে। সে দেখল, মাও তাকিয়ে দেখছেন পাখিগুলোকে। কিন্তু দেখতে দেখতেই মাইদুল আবিষ্কার করল, ঝড় ডানা ভেঙে দিয়েছে কিছু হলদে বউয়ের। তারা ছিটকে পড়েছে এদিক-সেদিক। একটি পাখি পড়ল ঠিক সামনে। মা দ্রুত তুলে নিলেন পাখিটাকে, আঁচলে ঢেকে দিলেন। কী সুন্দর হলুদ পাখিটা, কী সুন্দর ফুটে আছে মার শাড়ির সবুজ আঁচলে। কিন্তু পাখিটা বাঁচল না। মা চোখ দিয়ে বললেন, মাইদুল, চোখ ফেরাও। মাইদুল চোখ ফেরাল। মা গাছের আড়ালে ফেলে দিলেন পাখিটাকে। ফেলে, আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। চোখে নিশ্চয় ধুলি পড়েছে।
ঝড় বাড়ছে, বৃষ্টি উড়ছে বর্ষার ফলার মতো। চারদিকে ক্রুদ্ধ গর্জন। সেই গর্জনের সঙ্গে এবার যোগ হলো গাছের মাথার কাছ থেকে ওঠা একটা মটমট শব্দ। শব্দটা তিন ভুবন কাঁপিয়ে জাগল। তারপর নেমে আসতে থাকল নিচের দিকে। মা সেই শব্দের দিকে তাকালেন। তারপর দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। টানলেন মাইদুলকে এবং তার সেই পলকা হাত দিয়ে একটা ধাক্কা দিলেন। কী যে জোর ছিল সেই ধাক্কায়! অনেক খানি দূরে ছিটকে পড়ল মাইদুল।
অবাক। একটা মচকে ফুলে যাওয়া পলকা হাতের এমন জোর। কে কবে শুনেছে এমন কথা?
মাইদুলের এখনো মনে আছে, এবং এই মনে থাকাটা তার চিরদিনের প্রতিদিনের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, সবুজ পাতার নিচে কালো, মোটা একটা ডাল, একটা সবুজ শাড়ির একটুখানি আঁচল, অল্পখানি মা, তার হালকা চুল জড়ানো মুখ, অল্পখানি রক্তে রাঙানো তাঁর কপাল, অল্পখানি বুঁজে যাওয়া চোখ যেন ঘুমাতে গিয়েও ঘুম ঠিক আসেনি, যদিও খুব ক্লান্তি সারা মুখে। মার বাকিটুকু ঢাকা সেই ডালের আর পাতার নিচে। আর দু-তিনটি হলদে বউ আটকে আছে মার আঁচলে। যেন হলুদের সবুজের লালের ছোটখাটো, কিন্তু বিষণ্ন একটা উত্সব।
২.
মাইদুল ফাইভে পড়ে, রোজ কাঁধে বইখাতা ফেলে স্কুলে যায়, স্কুলের পাশে সাবদার মিয়ার মনোহারী দোকান, যেখানে চকলেট, কাঠ পেনসিল, খাতা, এসব পাওয়া যায়। সাবদার মিয়া একদিন বিরক্ত হয়ে বলল মাইদুলকে, মোহসিনের সঙ্গে আর যেন সে কথা না বলে। বললে, তার বাবাকে বলে দেবে।
মোহসিন আলী গ্রামের সোনা মিয়ার ছোট ছেলে। সোনা মিয়া আওয়ামী লীগ করেন। মোহসিনও। তার বয়স কম। মাইদুল অবশ্য এসব বোঝে না। মোহসিনকে সে পছন্দ করে, তাকে মাঝেমধ্যে চকলেট দেয়, চোষ কাগজ দেয়। মোহসিন তাকে বলেছে, এবার এহিয়া খান শেষ। এহিয়া খান মদ খায়, তাঁর মদ খাওয়া এবার মাথায় উঠবে।
মদ কী জিনিস মাইদুল জানে না, তবে খারাপ যে, সেটা টের পায়। সে সাবদারকে কথাটা বলে। এহিয়া খানের দিন শেষ। সে মদ খায়। সাবদার রেগে ধমক দেয়। ‘আর একবার এ কথা বললে মেরে ফেলব,’ সে বলে। মাইদুল অবাক হয়। ‘এহিয়া খান তো খারাফ, আফনে জানইন না?’ সে জিজ্ঞেস করে।
এবার দোকান থেকে লাফ দিয়ে নামে সাবদার। মাইদুলের শার্টের কলার ধরে টানে, বলে, ‘কে কইছে, কে কইছে এহিয়া খারাফ? তুমি ইন্ডিয়ার মানুষ নি, হেঁ?’
মাইদুল কষ্টেসৃষ্টে ছাড়া পায়। তারপর দৌড় দেয়। সাবদার রেগে টং হয়ে আছে।
একদিন মোহসিন ভাই ডাকে মাইদুলকে। তার হাতে ছোট একটা কাপড়ের টুকরা, সবুজ, মাঝখানে লাল, তার মাঝখানে হলুদ। একটা বাঁশের কঞ্চিতে কাপড়টা বেঁধে সেটি সে মাইদুলকে দেয়।
‘এটা কী?’ মাইদুল জিজ্ঞেস করে।
মোহসিন আলি হাসে। ‘এটা কী, আমি বলব না, তোমাকেই জেনে নিতে হবে,’ সে বলে। মাইদুল জানে, মোহসিন আরও দুই মিনিট থাকলে সে জেনে নিতে পারত। কিন্তু মোহসিন ব্যস্ত, তার অনেক তাড়া। তার হাতে এ রকম আরও অনেক কাপড়ের টুকরা, বাঁশের কঞ্চি। সেগুলো সে দিচ্ছে যাকে পাচ্ছে তাকে। ঠিক আছে, মোহসিন ভাই না হয় ব্যস্ত, কিন্তু সাবদার মিয়া তো তা নয়। দোকানে বসে ঝিমাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল সাবদারকে, ‘ইতা কিতা, কউক্কা চাইন?’ মাইদুলের প্রশ্নটা চালাকির। যেন একটু রহস্য করে বললে সাবাদর মিয়া ধরে নেবে, মাইদুল প্রশ্নের উত্তর জানে, এবং সে যে আরও বেশি জানে, তা প্রমাণ করার জন্য বলবে, ‘ইকান কুনু প্রশ্ন অইলনি বা, ইকান তো…’
কিন্তু কঞ্চিতে লাগানো কাপড়টা দেখে সাবদার মিয়ার ঝিমুনি চলে গেল। তার মুখের পেশিগুলো হঠাত্ শক্ত হয়ে গেল। টুপির নিচে চুলগুলোও যেন দাঁড়িয়ে গেল। চোখে আগুন ঢেলে সে বলল, ‘মশকরা করছিন বেটা, আমার লগে?’ তারপর এক লাফে নেমে এসে কলার ধরল মাইদুলের। তারপর তার পিঠে কিলঘুষি মারতে লাগল। মাইদুলের চিত্কারে মোহসিন ভাই দৌড়ে না এলে সেই দিন কী হতো কে জানে। মোহসিন ভাইকে দেখে সাবদার লাফ দিয়ে দোকানে উঠল। তারপর হাত জোড় করে বলল, ‘বিয়াদবি করছিল্, মুহসিন ভাই।’
মোহসিন টেনে তুলল মাইদুলকে। মাটিতে পড়ে গিয়েছিল সে। মাটিতে পড়ে গিয়েছিল কাপড়ের টুকরাটিও। সেটি তুলে মাইদুলের হাতে দিয়ে বলল মোহসিন, ‘বাংলাদেশের নিশান মাটিত্ পড়ার জিনিস না, আসমানো উড়ার জিনিস, ধরো।’
নিশানটার দিকে ভালো করে তাকাতে গিয়ে হঠাত্ সেই বৈশাখের ছবিটা মনে পড়ল মাইদুলের। কেন, সে বলতে পারবে না। কিন্তু তার মনে হলো, সেই বৈশাখের ছবির মতো, স্মৃতির মতো, এটাও যেন খুব মূল্যবান। সে কঞ্চি থেকে নিশানটা খুলে ফেলল। তারপর সেটি ভাঁজ করে বুক পকেটে রাখল। হাত দিয়ে এর অস্তিত্বের উষ্ণতা অনুভব করল। এবং বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার কেন জানি মনে হলো, নিশানটার স্পর্শে তার বুকের ওই জায়গাটাতে বেশ আরাম হচ্ছে।
আরাম হচ্ছে, অথবা হচ্ছে না, কে জানে। এ সবই আমাদের অনুমান। আমরা অনেক কিছুই অনুমান করি যা সত্য নাও হতে পারে। কিন্তু মাইদুলকে যে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করব, তারও উপায় নেই। মাইদুল পড়েছে তার বাবার সামনে। বাবা তার জামায় মাখামাখি কাদা দেখে একটা থাপ্পড় দিয়েছেন। ফলে, তার বুকে আবার একটা জ্বালা উঠেছে। সেই জ্বালাটা এই নিশানের স্পর্শে কমছে কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন। কমছে কি? নিশ্চয় না।
কে কবে শুনেছে, একটা ছোট কাপড়ের টুকরার আছে এমন শক্তি?
৩.
সাবদার মিয়া পিছমোড়া করে মাইদুলের হাত দুটি বেঁধেছে। তারপর তাকে হাঁটিতে নিয়ে গেছে আধা মাইল। মাইদুল প্রথমে অবাক হয়েছিল, সাবদারের ওই হঠাত্ আক্রমণে, সে তো তার সঙ্গে আসলেই কোনো বেয়াদপি করেনি।
কিন্তু তার দোকানের সামনে মাইদুলকে দেখেই লাফ দিয়ে নেমেছে যে, তারপর এই কাণ্ড। মাইদুল জিজ্ঞেস করেছিল, কেন এই শাস্তি। কিন্তু সাবদার তাকে বলেছে, আর একটা কথা বললে মাটিতে পুঁতে দেবে। পুঁতে দেওয়ার আগে পায়ের রগ কেটে দেবে। মাইদুল ভয়ে আর মুখ খোলেনি। কিন্তু তার অবাক লেগেছে, রাস্তায় মানুষজন কত কম। যারা আছে, তারাও তাদেরকে আসতে দেখে, বিশেষ করে সাবদার মিয়াকে, কেন জানি আড়ষ্ট হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পথ করে দিয়েছে। কেউ জিজ্ঞেস করেনি, কেন মাইদুলের হাত বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে সাবদার। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। মাইদুলের শুরুতে জানতে ইচ্ছে হয়েছিল, কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু এখন সেই ইচ্ছাটাও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। তার ধারণা, একটা বিশাল অপরাধ সে করেছে, যার শাস্তি হিসেবে এখন কিছুক্ষণ হাত বেঁধে তাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাবে। কথা বললে বরং রগ কেটে মাটিতে পুঁতে দেবে।
প্রথম পার হয়ে একটা বাজার। রত্নার ওপর। সেখানে একটা হলুদ একতলা দালান। সেখানে এসে থামল সাবদার। তারপর তাকে ঠেলে ভেতরে ঢোকাল। মাইদুলের খুব ক্লান্তি লাগছে, পানি খেতে ইচ্ছে করছে। আজ রোদটাও খুব কড়া। সময়টাও দুপুর। কিন্তু পানি খাওয়ার ইচ্ছাটা তার উবে গেল যখন সে দেখল, চার-পাঁচ উর্দি পরা লোক বন্দুক হাতে সামনে দাঁড়িয়ে। মাইদুল চিনল। পাকিস্তানি মিলিটারি। এদের কথা সকালেই বাবাকে বলতে শুনেছে। গ্রামের পুব দিকে জেলেপাড়ায় তারা ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে, এ রকমও বাবাকে বলতে শুনেছে। বাবা কাজে না গেলে মাইদুলেরও বেরোনো হতো না বাড়ি থেকে। বাবা মানা করে দিয়েছিলেন, ‘খবরদার, বাড়ি থেকে ছুটে যাবি না।’
মিলিটারির সঙ্গে অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছে সাবদার, আর হাসছে, হাত কচলাচ্ছে, স্যার স্যার বলছে। অথচ লোকগুলো তো তার গোফরান স্যার, রকিব স্যার, প্রদ্যোত্ স্যার না। সাবদার হঠাত্ হাত ঢোকাল মাইদুলের পকেটে। তার হাতে উঠে এল বাংলাদেশের নিশান।
একটা মিলিটারি এসে তার হাতের দড়ি খুলে দিন। তার পরও একটানে তার প্যান্ট খুলে ফেলল। প্যান্টের বোতামটা বোধ হয় ছিঁড়ল। ফল হলো এই, মাইদুল ন্যাংটা হয়ে মহা বিস্মিত, মহা আতঙ্কিত চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকল। তার গা কাঁপছে, চোখ ঘুরছে, মাথাটা বনবন করছে। একটা মিলিটারি একটা বেত দিয়ে তার শিশ্নটা নাড়াচাড়া করল। মাইদুল শুনল, লোকটা বলছে, ‘ঠিক হ্যায়’ বা এ রকম কিছু। অথবা শুনল না। এটি আমরাই বরং শুনেছি। এবং আমরা দেখেছি, পাঁচ মিলিটারির চোখ কোনো এক পুলকে চিকচিক করে উঠল। মাইদুলের রং ফরসা। সাস্থ্যটা ভালো। তাদের একজন অবশ্য এই পুলকে কিছুটা পানি ঢেলে বলল, ‘কাপ্তান সাহেবের দাবিটা আগে, বুঝেছ?’
যে লোকটা বলল, সে একটা হাবিলদার। সে বলল সাবদারকে, ‘ভালো সময়ে উপঢৌকন এনেছিস। এখন একটু বস্। আমরা দুপুরের আহার গ্রহণ করব, তারপর রওনা হব। মাইল দুয়েক পথ। স্যার ক্যাম্প গেড়ে আছে। স্যারকে উপঢৌকন পৌঁছে দেব। মেজর স্যারের উপঢৌকন অবশ্য ভিন্ন। তার পছন্দ নারীসমাজ। সেটা তোর কাজ না।’ হাবিলদারটা এই কথাগুলো বলে উচ্চস্বরে হাসল। সাবদারও হাসল খিকখিক করে। হাসনেওলা হাবিলদারই এবার মাইদুলের সেই নিশানটা একটা গাছে সেঁটে বন্দুক তাক করে গুলি চালাল।
নিশানটার কী হলো, দেখার সুযোগ হলো না মাইদুলের। বন্দুকের শব্দে সে মূর্ছা গেল।
৪.
মাইদুলের মূর্ছা ভাঙিয়ে, পানি খাইয়ে, রুটি-গোস্ত গিলিয়ে মিলিটারিগুলো রওনা দিল, সঙ্গে সাবদার। দিনটা আরও বেড়েছে, যেন গরমে এখন সব মানুষ, পশু, পাখি, গাছ, বৃক্ষ সেদ্ধ হবে। হচ্ছেও নিশ্চয়। কারণ মাটি থেকে কেঁপে কেঁপে বেরোচ্ছে ভাঁপ, আর দূরের সবুজ যেন ক্রমে কালচে হচ্ছে পুড়ে পুড়ে। মাইদুলের হাত অবশ্য আর দড়িতে বাঁধা নেই, সেই দড়ি দিয়ে বোতাম ছেঁড়া প্যান্টটা বাঁধা কোমরের সঙ্গে। কিন্তু একটু পিছিয়ে পড়লেই একটা মিলিটারি বেত দিয়ে তাকে মারছে। মাইদুলের এখন কোনো অনুভূতি নেই। তার বিস্ময়-আতঙ্ক-রাগ এসব এখন জমাট বেঁধে গেছে। এসবের অঞ্চলে কোনো কাঁপনও উঠছে না। সে শুধু দুটি চোখ খুলে রেখেছে, আর অনিশ্চিত দৃষ্টি মেলে দেখছে আকাশ-মাটি-গাছ-ঘাসফড়িং-ফটিকজলদের দিকে। আশ্চর্য, এত হলুদ পাখি, অন্য পাখিগুলো কই? আছে নিশ্চয়। কিন্তু কোথায়? পাখিদের নিয়ে ভাবনায় সে একটু চঞ্চল হলো। সত্যিই তো, কোথায় গেল পাখি, সে দেখল, একটা খঞ্জনা উড়ে গেল। তিনটা শালিক। একটা চিল, উড়ছে আকাশের অনেক ওপর দিয়ে। তারপর অনেকগুলো কবুতর। দুটি কাকও এসে হাজির হলো দৃশ্যে। কাকগুলোকে দেখে হাসি এল মাইদুলের। কোথাও যাওয়ার সময় মাথার ওপর কাক উড়ে গেলে মা চোখ দিয়ে বলতেন, ফিরে আয়। অর্থাত্ অমঙ্গল।
কাক দুটি একটু দূরে গিয়ে মাটিতে নামল। হয়তো পোকা পেয়েছে। হয়তো কেঁচো। মাইদুলের চোখ সেদিকে যেতে সে চমকে উঠল। সেই গাছ! সেই গাছ মানে সেই অশ্বত্থ গাছ, যেখানে তার বৈশাখের স্মৃতির দিনটি এলোমেলো পড়ে আছে। সেদিনের পর গাছটিকে আর দেখেনি মাইদুল, দেখতে ইচ্ছেও হয়নি। আজও গাছটার দিকে তাকাতে পারল না মাইদুল। চোখ দুটি ওপরে, আকাশে মেলে হাঁটতে থাকল। কিন্তু গাছের কাছে এসে একটা মিলিটারি বলল বাকিগুলোকে, ‘থামো।’ তারা থামল। মাইদুল খুব কষ্ট পেল। তার পায়ে ফোসকা পড়েছে, হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে, নাক দিয়েও। তার পরও সে চায়নি এই গাছের নিচে থামতে। কিন্ত মিলিটারিগুলো থেমেছে।
সাবদার কোনো কথা বলছে না মাইদুলের সঙ্গে, যেন মাইদুলের ভাষাটি সে জানে না এবং সে যে ভাষায় কথা বলছে, তা মাইদুল বুঝবে না। সে কথা বলছে এক মিলিটারির সঙ্গে, যে এই কিছুক্ষণ আগেও তাকে বিরাট এক থাপ্পড় মেরেছে।
গাছের নিচে গোল হয়ে বসে মিলিটারিগুলো পানি খেতে থাকল কাপড়ে ঢাকা টিনের বোতল থেকে। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছল। দু-একটা গালিগালাজ ছিল। মাইদুল শুধু শব্দগুলো শুনল, কিন্তু কিছু দেখল না। চোখ দুটি সে বুজে রেখেছে। মিলিটারিগুলো বসেছে ঠিক সেইখানে, যেখানে…।
যাক গে, মাইদুলের অনুমান নিয়ে অথবা তার ওপর চাপানো আমাদের অনুমান নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। আমরা বরং দেখি, মিলিটারিগুলো কী করে, সাবদার কী করে। কারণ, এরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মাইদুলকে আর ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন নেই। সাবদার তাদের আশ্বাস দিয়েছে, কালই সে মাইদুল থেকেও উত্কৃষ্ট উপঢৌকন হাজির করবে। ফলে তাদের মধ্যে পুলকটা আবার ফিরে এসেছে। এখন তারা ভাবছে, খানিক জিরিয়ে ফিরেই যাবে।
৫.
মাইদুল হঠাত্ শুনল, অনেক ওপরে আকাশে যেন একটা গর্জন শুরু হয়েছে। তার চোখ বন্ধ, সে শুধু অনুভব করল। তার কোনো ধারণা হলো না, কেন এমন হচ্ছে। কোনো ঝড়তুফান নেই, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু তার বন্ধ চোখের পাতা কাঁপিয়ে আবার শব্দ হলো। এবারের শব্দটা কয়েক বছর আগের সেই বৈশাখ দিনের শব্দটার মতো। মট মট মট। শব্দটা এবার অনেক নিচে, অনেক প্রবল তার আঘাত। সেই শব্দে বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো মিলিটারিগুলো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মাইদুল অবশ্য তা দেখতে পাচ্ছে না, শুধু শুনছে। মট মট। মট মট। এবার সেই শব্দের সঙ্গে যোগ হলো পাতার গর্জন, পাখিদের কোলাহল। চোখ দুটি খুলতেই হলো মাইদুলকে। কিন্তু খোলা চোখ আবার বন্ধ করে দিল ঘন সবুজ ছায়ার মতো একগুচ্ছ পাতার ঝাপটা। একটু যেন ছিটকে পড়ল সে। কেন? সে তো বসে ছিল, পুকুরঘাটের সেই পাথরটার মতো। কে তাকে ঝাপটা দিয়ে সরিয়ে দিল? অশ্বত্থের পাতা? এবার সে শুনল প্রাণঘাতী কিছু চিত্কার এবং সাবদারের ক্ষীণ, ভয়ার্ত রব, ‘বাছাও, বাছাও।’ মাইদুল উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার একটা পা আটকে গেছে একটা ডালের নিচে। এটা ঝটকা দিয়ে হয়তো পা-টা বের করা যায়, কিন্তু তার হঠাত্ মনে হলো, তার দড়িবাঁধা প্যান্টটা, তার ঘামে ভেজা শার্টটা যেন উড়ে গেছে, সে ন্যাংটা হয়ে গেছে। তার খুব ক্লান্তি লাগছে, তার ইচ্ছে হলো, একটু ঘুমাবে। হ্যাঁ, ঘুমাবে। কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে উঠে বসল। দেখল, একটা বিশাল কালো ডাল পড়েছে মিলিটারিগুলোর ওপর। তারা যেন থেঁতলেই গেছে। সে দেখল, সাবদারের শরীরের আড়াআড়ি পড়েছে ডালের একটা প্রান্ত। তার চোখ বুজে আসছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। মাইদুলের ডানে আরেকটা ডাল, সেটির পাতা ঘন সবুজ। সেই সবুজের ওপর ওড়াউড়ি করছে কটি ফটিকজল। একটিকে ধরতে গেলে সেটি একটু দূরে গিয়ে বসল সবুজ পাতার মাঝখানে। সে দেখল, ফটিকজল ধরতে বাড়ানো তার হাত লাল রক্তে মাখামাখি।
মাইদুলের ক্লান্তিটা হঠাত্ যেন চলে গেল। যেন একটা স্বস্তি ফিরে এল তার। অথবা ফিরিয়ে দিল সেই ফটিকজলটা। পাখিটা যেন হাসছে। আর বলছে, ঘুমাও। সে দেখল, সবুজ পাতাগুলোর আড়ালে যেন একটা সবুজ আঁচল, দুটি আধবোজা চোখ, হালকা চুলের ঘের দেওয়া একটা ফ্যাকাশে মুখ। আর বেঢপ রুপার বালা পরা একটা হাত। সে হাতটা ধরে এবার সে ঘুমাতে যাবে।
কিন্তু হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে সেই মচকে, ফুলে যাওয়া হাতটা যে এত জোরে তাকে ঠেলে দেবে, আর সে ছিটকে পড়বে অনেকটা দূরে আর উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখবে আশ্চর্য এক ডালের আশ্চর্য কিছু পাতার নিচে চাপা পড়া একটা ফ্যাকাশে মুখ, কে তা জানত।
কে জানে, বলুন?
আর, কে কবে শুনেছে, ঝড় নেই, তুফান নেই, রাগী একটা হাওয়াও নেই, তার পরও একটা অশ্বত্থের এত বড় একটা ডাল এমনি এমনি ভেঙে পড়ে?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৯, ২০১০
Leave a Reply