রেনুর দুই চোখেই ছানি পড়েছে। কোমরে বাতের কারণে ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। গ্রামের বড় দিঘির কোনায় পরিত্যক্ত মাঠের কিনারে সারা দিন বসে থাকে। তার চারপাশে শুকনা কাঁঠালপাতা, বাঁশপাতা জমে স্তূপ হয়ে আছে। কয়েকজন সাংবাদিক এবং গ্রামের কিছু তরুণ-পরিবেষ্টিত সে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে। এতগুলো মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রে কেন সে বসে আছে বুঝে ওঠে নাই।
সাংবাদিকদের একজন রেনুকে প্রায় জোরজবরদস্তি করতে থাকে। সে যেন ঠিকঠাক বর্ণনা করে কী ভংয়করভাবে সে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধর্ষিত হয়েছিল। রেনু বেগম কারও সঙ্গেই কোনো কথা বলে না। একজন সাংবাদিক গুছিয়ে বলে, ‘মা, আপনাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। আপনি প্লিজ আমাদের বলুন ’৭১ সালে পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা। স্বাধীন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশার কথা অথবা স্বপ্নভঙ্গের বেদনার কথা।’ রেনু ওই সাংবাদিকের দিকে তাকায় না, যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি। শাড়ির একটা কোনা আঙুলে খুঁটতে থাকে। গ্রামের অন্যদের মুখে এই বীরাঙ্গনার প্রতি পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতার কাহিনি শুনে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায় সাংবাদিকেরা।
চৌধুরী বাড়ির আত্মীয় এবং আশ্রিতা রেনু জীবনে প্রথম ধর্ষিত হয় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। সারা গ্রামের লোকজন যখন ‘পাঞ্জাবি আইলো…পাঞ্জাবি আইলো…’ বলে যে যেদিক পারে পালাচ্ছে, রেনু তখন রান্নাঘরে ফুঁকনি দিয়ে আগুন ধরানোয় ব্যস্ত। চৌধুরী গিন্নি ও-ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে কচুরিপানার আড়ালে লুকানোর আগে রেনুকে ডেকে যায়—‘গ্রামে পাঞ্জাবি আইছে। সবাই দৌড়াইতাছে। তুইও আয়। চুলা নিভায়া আয়।’ রেনু তখনো ফুঁকনি দিয়ে চুলায় ধোঁয়া ছড়াচ্ছিল। গ্রামের কেউ কেউ পরে বলাবলি করেছে সে আসলে ধর্ষিত হওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
পাকিস্তানি সেনারা রান্নাঘরে ধোঁয়ার মধ্যে একজোড়া গভীর চোখের এক ছিপছিপে তরুণীকে দেখে একটানে হেঁচড়ে তাকে উঠানে নিয়ে আসে। দলনেতা আবৃত্তি করে—
‘ইয়ে জাহাঁ সে নেহি হ্যায় তুমহারি আঁখে
আসমানসে উতারি হ্যায় তুমহারি আঁখে।’
দলের সবাই হা হা হাসিতে ফেটে পড়ে। এর নয় মাস পর স্বাধীন বাংলাদেশে রেনু একটি বোবা মেয়ের জম্ম দেয়।
রেনুর মেয়ের জন্মের পর চৌধুরী বাড়ির কামলা ট্যাগরা করিমের সঙ্গে রেনুর বিয়ের আয়োজন করা হয়। রেনুর কান্নাকাটি, প্রতিরোধ কোনো কিছুই টেকেনি চৌধুরী সাহেবের এই সিদ্ধান্তের মুখে। চৌধুরী গিন্নি তাকে বোঝায়, ‘ট্যাগরা করিম রাজি না হইলে আমরা কোনো দিন তরে বিয়া দিতে পারতাম না।’ রেনুর কান্না থামে না, ‘আমারে বিষ দেন, খালা, তবুও মুনিষ ব্যাটারে বিয়া করতে পারুম না।’
বিয়ের পর রেনু শীত গ্রীষ্ম হেমন্ত শরত্ বসন্ত বর্ষা—সারা বছরই স্বামী কর্তৃক ধর্ষিত হয়। তার জ্বর, টাইফয়েড কোনো কিছুই তাকে বাঁচাতে পারে না।
বিয়ের প্রথম দিন থেকেই এক দিনের জন্যও সে তার স্বামীকে শ্রদ্ধা করে নাই, ভালোও বাসে নাই। স্বামীর প্রতি নিস্পৃহ থাকলেও তার বোবা মেয়েটি তার জীবনে নিত্যনতুন ছন্দ নিয়ে আসে। পায়ের নিচে শুকনো কাঁঠালপাতা, পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে পরিত্যক্ত মাঠের পাশে মা-মেয়ে সারা দিন চড়ুইভাতি খেলে। আর মেয়ে ঘুমিয়ে গেলে সুঁইসুতা অথবা কুশিকাটা দিয়ে মেয়ের ফ্রক বানায়, ফ্রকের নকশা তোলে বা এমব্রয়ডারি করে। মেয়ের ফ্রকগুলো ন্যাপথলিন দিয়ে পুরোনো সুটকেসে ভাঁজ করে রাখে আবার সুটকেস থেকে বের করে রোদে শুকাতে দেয়। মা-মেয়ে এবং ট্যাগরা করিম তিনজনের বোবা সংসার। মা-মেয়ের ইশারায় বাক্যবিনিময় হলেও স্বামীর সঙ্গে রেনুর প্রায় কথাই হয় না। সংসার এবং তার প্রতি অনাগ্রহ করিম টের পেলেও এ নিয়ে বলার জন্য কোনো কথা সে কোনো দিনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো বাক্যবিনিময় হয় না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরাঙ্গনা হিসেবে গ্রামের চেয়ারম্যান রেনুকে একদিন মিটিংয়ে নিয়ে গিয়েছিল, চেয়ারম্যান আঙুল তুলে সবাইকে দেখায়, এ নারীর ত্যাগ বাঙালি হাজার বছর স্মরণ করবে। সেই মিটিংয়ে ট্যাগরা করিমও গিয়েছিল তেলচপচপা চুলে। সেদিন চেয়ারম্যানের পাশে বসা বীরাঙ্গনা স্ত্রীর গর্বে তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
রেনুর প্রায় শব্দহীন সংসারে এক জাদুর বাক্স আনন্দ নিয়ে আসে গ্রামের চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মাহফুজ। জেলা শহর থেকে সে গ্রামে সাংবাদিক নিয়ে আসে। দৈনিক সংবাদপত্রে বীরাঙ্গনা রেনু বেগমের সাক্ষাত্কার ছাপা হয়। রেনুর ছবিসহ সংবাদপত্র রেনুকে এনে দেখায়। ফ্রেমে বাঁধাই করে রেনুকে উপহার দেয়। পদ্মফুলের দুটি মালা গেঁথে একটা রেনুর মেয়েকে পরিয়ে দেয় আরেকটি রেনুকে। ‘তোমার ত্যাগে এ দেশ ধন্য, তোমার ত্যাগে এই দেশের জম্ম, হে মহীয়সী নারী।’ রেনুর দুই চোখ কান বিস্ময়বিকিরিত হয়।
মাহফুজ একটা হারমোনিকা নিয়ে এসে রেনুর বোবা মেয়ে শিউলিকে বাজানো শেখাতে। সারা দিন সে ব্যয় করে কীভাবে মেয়েকে হারমোনিকা বাজানো শেখানো যায় সেই কসরতে। মা মেয়ে দুজন উপভোগ করে মাহফুজের হারমোনিকা বাজনা, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে।
মাহফুজের এ বাড়িতে আসা-যাওয়া নিয়ে রেনুর স্বামী করিমের কিছু বলার থাকে না, অথবা বলার সাহস থাকে না। মাহফুজ মা- মেয়েকে যাত্রাপালা দেখাতে নিয়ে যায়। ভরা পূর্ণিমা রাতে তিতাস নদীর ওপর নৌকায় ভেসে বেড়ায়। নৌকায় রাতভর মাহফুজ গান শোনায়। ঘন অমাবস্যার রাতে রেনু উত্তরপাড়ার কবরস্থানে যায়। মাহফুজের হাত ধরে দ্যাখে অন্ধকারে গাছভর্তি জ্বলতে থাকা জোনাকপোকা।
রেনু তার বোবা মেয়ে শিউলিকে একা ঘরে রেখে প্রথমবারের মতো বের হয়। জেলা শহরের বাজারের আড়তের পেছনে ছোট এক ঘুপটি ঘরে মাহফুজের সঙ্গে সাত দিন কাটায় তার স্বামী-সন্তান, অতীত-ভবিষ্যত্ বেমালুম বিস্মৃত হয়ে, যেন সে গাঢ় নীল সমুদ্রে পাল তোলা নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছে পুরোটা সময়।
মাহফুজ যখন তাকে ওসমান মাহমুদের বিশাল বাগানবাড়িতে নিয়ে আসে, চারপাশে এত গাছগাছালি-পাখপাখালির মধ্যে শিশুর উল্লাসে সে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দুই দিন আগে বাজারের আড়তের পেছনে ঘুপটি ঘরে ওসমান মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। শান্ত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গম্ভীর ভদ্রলোক। ওসমান সাহেবের বাগানবাড়িতে পুরো সকাল কাটিয়ে দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে যায়। রেনুকে বলে যায় বিকেলের মধ্যে সে ফিরবে। মাহফুজ বেরিয়ে গেলে তার বোবা মেয়ে শিউলিকে নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা তার মগজে বুদ্বুদ তোলে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, তার স্বামী করিম বাচ্চাটাকে নিজ সন্তানের মতোই ভালোবাসে।
বিকেলে বাড়ির মালিক ওসমান মাহমুদ আসে, রেনু বিছানায় শায়িত ছিল। তাকে দেখে খাটের কোনায় বসে। ‘বিকালটা একা একা কাটাইছেন, বিরক্ত লাগে নাই তো? কাজের মহিলা ঠিকমতো খাবার দিয়ে গেছে?’
‘না, কোনো সমস্যা হয় নাই। মাহফুজ তো চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।’
ওসমান তার সঙ্গে সম্পর্ক জমাতে চেষ্টা করে, সে বলে পাকিস্তানিরা তাকে ধর্ষণ করেছে এ ব্যাপারটা সে জানে। মাহফুজ তাকে বলেছে। ‘দেশের জন্য যে কত বিশাল আত্মদান!’ সে আরও জানায়, পাকিস্তানিদের ঔরসে তার একটি অসুস্থ সন্তান আছে, তাও জানে সে। বলে, ‘বেদনাদায়ক ঘটনা। পাকিস্তানিরা কতজন ছিল সংখ্যায়? এরা তো একেকজন নিশ্চয়ই পালোয়ান টাইপের লোক ছিল। এখনো যা সুন্দর, তখন তো নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী ছিলেন। আপনি কি ক্যাম্পে আটক ছিলেন?’
শুরুতে দু-একটা প্রশ্নের জবাব দিলেও একপর্যায়ে কথা বলা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় রেনু। হাঁটুতে মুখ রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে শান্ত বসে থাকে। খোলাচুল বাতাসে উড়ে উড়ে তার মুখের ওপর নানা রেখা আঁকে।
ওসমান আরও বলে যায়, তার স্ত্রী দীর্ঘদিন রোগশোকে অসুস্থ, সে আবার পতিতাগমনও পছন্দ করে না, যৌন অসুখের ভান্ডার এসব পতিতাদের চেয়ে একজন স্থায়ী বান্ধবী থাকা শ্রেয় মনে করে।
রাত নয়টা বিশে ওসমান তাকে ধর্ষণ করে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওসমান বলে, ‘যে মাহফুজের হাত ধরে আপনি স্বামী-সন্তান ছেড়ে পালায়া আসছেন, সেই মাহফুজ আপনাকে আমার কাছে বিক্রি করে গেছে। সে গ্রামে আর ফিরবে না। তার টাকার দরকার ছিল, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। আমার সাথে বহু বছরের লেনদেন মাহফুজের।’
রেনু চিত্কার করে ওঠে, ‘সব মিথ্যা কথা।’
এখান থেকে পালিয়ে গ্রামে চলে যাবে, এই যে ভাবনাটা মাথায় একমুহূর্ত এসেছিল, তাকে বাতিল করে দেয় সে। এখানেই থাকবে। মাহফুজ এখানেই ফিরে আসবে। তার সঙ্গে দেখা হতেই হবে। হয়তো ওসমানই পারবে মাহফুজের খোঁজ দিতে।
রেনু ওসমানের কাছেই থেকে যায়। ওসমানকে বারংবার অনুরোধ করে মাহফুজের ঠিকানা জোগাড় করে দিতে। সে বলে, মাহফুজের সঙ্গে জীবনে আর অন্তত একবার তার দেখা হতে হবে। ওসমান প্রথমদিকে মাহফুজের ঠিকানা জোগাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরের দিকে মাহফুজের নাম শুনে নীরব হয়ে যেত। ওসমান তাকে শুরুর দিকে এক-দুইবার জিজ্ঞাসা করেছে, ‘যে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল তার সাথে দেখা হইতে হবে কেন?’”
রেনু জবাব দিত, ‘তাকে একবার শুধু জিজ্ঞাসা করব আমার সাথে এমন করল কেন? আমি কী অপরাধ করছিলাম।’
মাস দুয়েক পরে নিজেই ওসমানকে সে বলে, ‘মাহফুজের সঙ্গে কেন অন্তত আরেকবার দেখা করতে চাই, শোনেন। তাকে আরেকবার শুধু বলব, পাগলের মতো এখনো তাকে ভালোবাসি আমি।’”
অন্ধকারে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুত্-চমকের মতো ফিরে আসে তার মেয়ে শিউলি, মাহফুজ এবং কখনোসখনো স্বামী ট্যাগরা করিম। যদিও রেনু সব সময়ই করিমের স্মৃতি ব্রাশ দিয়ে ঘষে মন থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছে।
কয়েক বছর পর রেনু গ্রামে ফিরে দ্যাখে তার ঘরের বেড়া-দরজা সব ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রেনু মেয়েকে খোঁজে, হুহু বাতাস তার কানে, শাড়িতে প্রবাহিত হয়। এ বাড়িতে কোথাও তার মেয়ে নাই। স্বামীও নাই।
চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছে জানতে পারে, সে চলে যাবার পর ট্যাগরা করিম তার মেয়েকে স্বীয় ঔরসজাত সন্তানের মতোই যত্নে-ভালোবাসায় বড় করছিল। গ্রামের লোকজন এর মধ্যে আবিষ্কার করে বোবা শিউলি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। ট্যাগরা করিমই এই কাজ করেছে এই অনুমান থেকে গ্রামের অতি-উত্সাহী কিছু লোক বাজারে প্রকাশ্যে তাকে প্রচণ্ড মারধর করে। করিম নাকি মার খেতে খেতে বার বার চিত্কার করছিল, ‘এইটা আমার সন্তান, আমার মেয়ে, ওর কোনো ক্ষতি আমি করি নাই। আমি জানিও না কে করছে।’
তারপরও গ্রামের লোকজন তাকে পিটিয়ে অর্ধমৃত করে বাজারে ফেলে রাখে। পরদিন সকাল থেকে গ্রামের লোকজন ট্যাগরা করিমকে আর কোথাও দ্যাখে নাই।
চৌধুরী গিন্নি বোবা মেয়েটিকে নিজ বাড়িতে এনে ধাত্রী দিয়ে চেষ্টা করেন গর্ভপাত করাতে। শিউলি মারা যায়।
চৌধুরী এবং তার স্ত্রী রেনুকে বলে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। তারা বলে, ‘তুই এখানে থাকলে গ্রামের লোকজন তোরে জ্বালাইব। আমাদেরও কথা শুনাইব।’
রেনু যায় না। সে বলে, ‘আমার মেয়ে আছে এইখানে। আপনারা মারেন কাটেন, যামু না আমি।’”
আরও অনেক বছর পর আবারও একদল সাংবাদিক আসে বীরাঙ্গনা রেনু বেগমের খোঁজে। রেনু বৃদ্ধা, চোখে ছানি। দিঘির পাড়ে পরিত্যক্ত মাঠের পাশে শুকনা বাঁশপাতা কাঁঠালপাতার স্তূপে শিয়াল-কুকুর-আর মনুষ্যবিষ্ঠার মধ্যে বসে থাকে। সাংবাদিকেরা নানা প্রশ্ন করে, রেনু কোনো জবাব দেয় না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৯, ২০১০
debjani
MORMOSPORSHI……….