অনেক দিন পর বাড়ি ফিরে এলে সবকিছু কেমন যেন অচেনা আর দূরের মনে হয়! কত দিন পর এই বাড়ি ফেরা! না, বাড়ি কোথায়, এ তো বড় ভাইয়ের কেনা শহুরে অ্যাপার্টমেন্ট—সুসজ্জিত, পরিপাটি, কিন্তু আমার অচেনা—কোনো সম্পর্কই নেই আমার সঙ্গে। আমার যা-কিছু সম্পর্ক, যা-কিছু স্মৃতি, তার সবই রয়ে গেছে উদাসপুরে। সেখানে আর ফেরা হয়নি, হবে না কোনো দিন। তবু একে হয়তো বাড়ি ফেরাই বলবে সবাই, অন্তত আপনজনের কাছে ফেরা তো বটেই। আপনজন বলতে ওই পাগল বোন বুলু, ভাই মামুন, আর তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, বহুদিনের বিচ্ছিন্নতায় যাদের সঙ্গে একটা অচেনা দেয়াল তৈরি হয়েছে। কত বদলে গেছে সব! এই ছেলেমেয়েগুলোকে ছোট রেখে গিয়েছিলাম, এখন সব বড় হয়ে গেছে! ভাই-ভাবীর চেহারায় বয়সের ছাপ—চুলে পাক ধরেছে দুজনেরই। সেই মিষ্টি ভাবী, পাকা চুলে তাকে কেমন অচেনা লাগে। বাড়ি থেকে যখন চলে গিয়েছিলাম, আর কোনো দিন ফিরব না এমন সংকল্প করেই, তখনো ভাবী নতুন বউয়ের মতো মিষ্টি, আকর্ষণীয়। আর কী যে মধুর ছিল আমাদের সম্পর্কগুলো! দুষ্টুমি আর খুনসুটিতে ভরা, মমতা আর ভালোবাসায় সিক্ত। এখন সবকিছুতে ধুলো জমেছে, এই কদিনে ভাবীর সঙ্গে কুশল বিনিময় ছাড়া আর কোনো কথাই হয়নি। খাওয়ার সময় স্নেহময়ী হয়ে বসে থাকে বটে—ভাবীর এই স্বভাবটা মায়ের মতো, কিন্তু কোনো কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেসও করে না—এত দিন কোথায় ছিলাম, কেমন ছিলাম, কেনই বা আবার ফিরে এলাম, আবার উধাও হয়ে যাওয়ার মতলব আছে কি না! মা থাকলে হয়তো জিজ্ঞেস করত। যখন গিয়েছিলাম, মা বেঁচে ছিল। সেদিনের কথা আজও খুব মনে পড়ে। মা ঘুমিয়েছিল আর আমি তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছিলাম। মা জানতেও পারেনি, কিন্তু আমি জানতাম—ওটাই আমার শেষ দেখা। ওই পবিত্র দুঃখী মুখটি আজকাল খুব দেখতে ইচ্ছে করে। একজন মা কি তার সন্তানকে কখনো শেষ বিদায় জানাতে পারে! আমার মা একাধিকবার সেই কাজটিই করেছে—সেই যুদ্ধের সময়, যখন প্রতিটি যাওয়াই ছিল শেষবারের মতো যাওয়া, আর কখনো না ফেরার সম্ভাবনাটাই যখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। আবার যখন লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা করতে আসতাম, এমনভাবে আদর করত, যেন ওটাই শেষ আদর, আর কখনো সন্তানকে ফিরে পাওয়া হবে না তার। সেসব কথা এখনকার ছেলেমেয়েরা বিশ্বাসই করতে পারবে না, ভাববে—গালগল্প করছি, রূপকথা শোনাচ্ছি। হ্যাঁ, রূপকথার মতোই ছিল সময়টি। একদল সুসজ্জিত দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছিল যারা, তাদের কেউ রাজপুত্র ছিল না, ছিল কৃষকপুত্র। তাদের শিরস্ত্রাণ ছিল না, হাতে অস্ত্র ছিল না, ছিল ধুলোর টুপি—তারা সেগুলো দিয়েই দৈত্যদের পরাজিত করেছিল। এ এক ভীষণ গাঁজাখুড়ি রূপকথা ছাড়া আর কী-ই বা মনে হবে! তো শেষবার যখন বিদায় নিলাম, তখন আর বলিনি, মা জানতেও পারেনি আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—আরেকটি বিজয় না নিয়ে ফিরব না। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি—মা বেঁচে থাকতে আর ফিরিনি, এমনকি মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েও না। বিজয় যে অর্জিত হলো না, আমি কোন মুখে তার কাছে ফিরি! আজ ফিরেছি বটে, কিন্তু একে ফেরা বলে না। মা নেই, বাড়িটাও পদ্মায় ভেঙে নিয়ে গেছে—যেখানে আমার মা-বাবা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়েছিল। এ-ও একদিক থেকে ভালোই হয়েছে—পরাজিত মুখে অন্তত তাদের কবরের পাশেও দাঁড়াবার কোনো সুযোগ আর রইল না। নিজের কাছে যে প্রতিজ্ঞা, সেটা কখনো ভাঙতে নেই; আমি ভাঙিনি, যদিও পরাজিত হয়েই ফিরেছি। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ছিল, মরতে চেয়েছিও অনেকবার। হয়নি। মৃত্যু কেন যেন আসি-আসি করেও আসেনি আর। কেবল বয়স বেড়েছে আর বয়সের ভারে ক্লান্ত সৈনিক যেমন অবসর নেয়, আমিও তেমন অবসরে এসেছি—বিপন্ন, অবসন্ন। খানিকটা বিভ্রান্তও বটে। কিন্তু বিশ্বাস করি—এখনো যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ কখনো শেষ হওয়ার বিষয় নয়! একবার যে যুদ্ধে যায়, অন্তত মন থেকে যে যায়, সে কখনো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরে না, ফিরতে পারে না, আমৃত্যু যুদ্ধ করে যাওয়াটাই তার নিয়তি। আর যদি ফেরেই, তাহলে তার পরাজয় ঘটে যায়, যুদ্ধক্ষেত্রের পরাজিতরা মাঠ খালি পেয়ে দখল করে নেয়। আমি অন্তত তেমনটিই মনে করি। মনে করি তেমনটিই ঘটছে এই দেশে, এই কালে। এসব কথা কি কাউকে বলা যায়? কেউ কি বুঝবে এসব কথা? মনে হয় না। তারচেয়ে বরং চুপ করে থাকাই ভালো। অবশ্য বলেও কোনো লাভ নেই—কেউ কারও কথা বোঝে না। নইলে যাদের জন্য এতকাল ধরে কাজ করে এসেছি, যাদের জন্য জীবন বাজি রেখেছি, তাদেরকে কেন আমাদের কথা বোঝাতে পারিনি, কেন তাদেরকে আমাদের দলে টানতে পারিনি? নাকি কোথাও কোনো ভুল ছিল? বোঝার ভুল, জানার ভুল কিংবা বুঝিয়ে বলার ভুল? আদতেই কি চেষ্টা করেছি কাউকে বুঝিয়ে বলতে? এসব প্রশ্ন আজকাল খুব মনে জাগে। শুধু আজকাল নয়, কয়েক বছর আগে থেকেই জাগছিল। উত্তর পাইনি। কে-ই বা উত্তর দেবে, উত্তর দেবার মতো যারা ছিলেন, সবাই নিহত অথবা বিচ্যুত কিংবা প্রত্যাখ্যাত। এখন তো আমারই উত্তর দেবার বয়স, প্রশ্ন করার বয়স নয়। নতুন যারা আসে, তাদেরও অনেক প্রশ্ন থাকে। কিন্তু আমি নিজেই যেসব প্রশ্ন সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, সেগুলোর উত্তর কীভাবে দেব? এই ভুলের চিন্তাই আমাকে ফিরিয়ে আনল, নইলে হয়তো ফেরা হতো না। মনে হলো, এভাবে কিছু হয় না। এইভাবে পালিয়ে বেড়িয়ে, রাতের অন্ধকারে দু-চারজন লোককে মেরে বিপ্লব হয় না; বিপ্লবের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তারা নেই। আরেকটা কথাও মনে হচ্ছিল—আমার যাওয়াটা ছিল আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যাওয়া, আমি ওই পথকেই তখন জনগণের মুক্তির পথ বলে বিশ্বাস করে গিয়েছিলাম। আমার একটা দায়বদ্ধতা ছিল, আমার সামনে তখন আদর্শ হয়ে ছিলেন চারু মজুমদার আর সিরাজ সিকদার। আর এখন যারা আসে…!
এই সব ভাবি এখন এই অখণ্ড অবসরে একা বসে বসে, আর তো কিছু করার নেই। সময় কাটানোই এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুই ভালো লাগে না, কারও সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, আমার যাওয়ার কোনো জায়গাও নেই অবশ্য। বইটই পড়তে বা সিনেমা-নাটক দেখতেও ইচ্ছে করে না, বসে বসে তাই এই সব ছাইভস্ম লিখি। জানি এগুলো কারও কোনো কাজেই লাগবে না, কাজে লাগার জন্য লিখিও না। আমি এক পরাজিত সৈনিক—পরাজিতদের কথা পৃথিবীর কেউ জানতে চায় না।
২.
অনেক দিন পর আলম ফিরে এলে বাড়ির মানুষগুলো তাকে নিয়ে সত্যি সত্যি অস্বস্তিতে ভোগে। কেমন ব্যবহার করবে তার সঙ্গে—উষ্ণ, না শীতল; সমাদর করবে তাকে, নাকি অবহেলা; নাকি নীরব উদাসীনতায় তার আগমনকে একটি স্বাভাবিক ঘটনা বলে প্রমাণ করবে—যেন সবারই জানা ছিল, এমনটিই ঘটবে, এমনই ঘটার কথা, এমনই ঘটে থাকে সব সময়—এসব ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তই তারা নিতে পারে না। এই এত দিন সবাই তাকে প্রায় ভুলেই ছিল, ২০ বছর কম সময় নয় তো! ’৭৩-এ গিয়েছিল আর ফিরে এল এই ’৯৩-এ! একজন মানুষ এত দিন ধরে অনুপস্থিত এবং যোগাযোগবিচ্ছিন্ন থাকলে তার সঙ্গে আর কতটুকু সম্পর্কই বা থাকে! থাকে না বললেই চলে। তাকে নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না, যেন পরিবারের এক মৃত সদস্য সে, কখনো-কখনো দু-চারটে দীর্ঘশ্বাস তার জন্য বরাদ্দ করা যায়, বড়জোর দু-চার ফোঁটা অশ্রু! কিন্তু হঠাত্ যদি ফিরে আসে সে, দীর্ঘশ্বাস বা অশ্রু তখন আর থাকে না, অভিমান থাকে হয়তো এবং নিশ্চিতভাবেই থাকে অসংখ্য অভিযোগ—কিন্তু সেসব জানাবার মতো ভাষা বা উদ্যম কারোরই থাকে না। কিন্তু এসব ব্যাপারে আলমকে খুব একটা চিন্তিত বলেও মনে হয় না! তার আচরণে আবেগ নেই, উচ্ছ্বাস নেই, নেই বিস্ময় বা কৌতূহল, এমনকি নেই প্রশ্নও, অন্তত সে প্রকাশ্যে কোনো প্রশ্ন আজ পর্যন্ত করেনি—কোনো কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না। তার বিপুল পরিবর্তনটা শুধু দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে সবার, যেন কিছুই আর জানার নেই তার কারও সম্বন্ধে, কিংবা জানাবারও নেই নিজের সম্বন্ধে। আগে—সেটা অবশ্য অনেক দিন আগের কথা—খুব প্রাণবন্ত ছিল সে, একাই বাড়ি মাতিয়ে রাখত! সেই উচ্ছলতা হারিয়ে গেছে সেই কত কাল আগে! যুদ্ধের পর সে যখন ফিরে এল বিজয়ীর বেশে, তখনই বেশ খানিকটা বদলে যাওয়া মানুষ, কী যেন ভাবত একা-একা সারাক্ষণ। তারপর যে কী হলো, কীভাবে যোগাযোগ ঘটল সর্বহারাদের সঙ্গে, কখন তাদের দলে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিল, আর কবে কোনো এক রাতে নিঃশব্দে, কাউকে কিছু না বলে চলে গেল—কেউ তা ঠিকঠাক বলতে পারবে না। তখনো আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মুক্তিযুদ্ধে খুব বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, তার সাহস আর বীরত্বের গল্প তখন এবং পরেও মানুষের মুখে মুখে ফিরত। তার গল্প-কাহিনী এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, মনে হতো—এ যেন এক রূপকথার রাজপুত্র। শুধু আলমই নয়, মতিনও—বুলুর স্বামী—যোগ দিয়েছিল যুদ্ধে। বুলুর তখন নতুন বিয়ে হয়েছে, কয়েক মাস যেতে না-যেতে যুদ্ধ লাগল। বুলু ফেরানোর চেষ্টা করেছিল মতিনকে, পারেনি। মতিন ফেরেনি আর। মাত্র কয়েক মাসের বিবাহিত জীবন, তবু বুলু স্বামীর মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে পারল না আর কোনো দিন। ধীরে-ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ল। মাঝে তো অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, চিত্কার-চেঁচামেচি করত, জিনিসপত্র ভাঙচুর করত, লোকজনকে মারধর করত। এখন সেটা কমেছে বটে, কিন্তু মতিন যে আর ফিরবে না, সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করে না। মতিনের মৃত্যু, বুলুর অসুস্থ হয়ে পড়া আর আলমের সর্বহারা পার্টিতে যোগদান—এ সবই ছিল এই পরিবারের জন্য বিপর্যয়কর ঘটনা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত স্কুলশিক্ষক বাবার বড় ছেলে হিসেবে মামুনের ওপর যে অনিবার্য দায়িত্ব পড়েছিল, সে সেটা যথার্থভাবে পালন করার চেষ্টা করছিল। সংসারটাকে যখন অনেকখানিই গুছিয়ে এনেছে সে, তখনই যুদ্ধটা লেগে গেল। মতিন আর আলম যুদ্ধে গেল, তারও যাওয়া উচিত ছিল—সাহসে কুলায়নি। ভাইবোনদের মধ্যে আলম যতখানি সাহসী, সে ততখানিই ভীতু। সে যে যুদ্ধে যায়নি, এ জন্য তখন খুব লজ্জা বোধ হতো, এ জন্য ভয় থাকা সত্ত্বেও মতিন আর আলমকে না করতে পারেনি। যে ভয়টা সে পাচ্ছিল, তাই হলো—মতিন ফিরল না। আলম ফিরল ঠিকই, কিন্তু ভিন্ন মানুষ হয়ে। কেমন নিশ্চুপ আর চিন্তামগ্ন থাকত সব সময়। কে জানত যে ওর মাথায় রাজনীতির পোকা ঢুকেছে! তাও গোপন-নিষিদ্ধ রাজনীতি। ‘তার মাথায় এমন সর্বনাশা রাজনীতির ভূত ঢুকবে কেন? যুদ্ধ লেগেছে, বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিস, ভালো কথা; এবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আয়! পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরির চেষ্টা কর। আর তা ছাড়া, একজন বীর যোদ্ধা হিসেবে তোকে তো সবাই চিনত। একটা চাকরি বা ব্যবসা জুটিয়ে ফেলা তোর জন্য ছিল খুবই সহজ, তা না করে তুই গিয়ে ভিড়লি সিরাজ সিকদারের দলে। আরে! তোকে কি এসব মানায়? বিপ্লব দিয়ে তুই কী করবি? একজন মানুষ তার দেশের জন্য যতটুকু করতে পারে, তুই তোর সাধ্যমতো সেটুকু তো করেছিসই—হার না মানা যুদ্ধ করেছিস, কয়জন মানুষ এই কাজটুকু করতে পারে! এর পরও তোর এত কিসের দায়? কেন তোকেই বিপ্লব করতে হবে?’—না, এসব কথা মামুন কোনো দিন বলেনি তার ভাইকে। এ শুধু তার নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা—তছনছ হয়ে যাওয়া স্বপ্নের সংসার নিয়ে তার হাহাকারের কথা। মতিনের মৃত্যু, বুলুর অসুস্থতা আর আলমের সর্বহারা দলে যোগ দেওয়া—এই তিনটি ঘটনাই তাদের পরিবার থেকে সমস্ত হাসি-আনন্দ চিরদিনের জন্য কেড়ে নিয়েছে। মা-বাবা এসব শোকেই অকালে মারা গেল। একজন মানুষ কতটুকুই বা সইতে পারে! যে মানুষগুলোর সঙ্গে যুদ্ধের পরিচয় কেবল বইয়ের পাতায়, তাদের জীবনেই যদি সেটা নেমে আসে, তার পুত্র বা পুত্রসম কেউ যদি সেই যুদ্ধে মারা যায়, যে বিপ্লবের নামই কোনো দিন শোনেনি তারা, তার পুত্র যদি সেই বিপ্লবের নেশায় স্বাভাবিক জীবন ত্যাগ করে, তাহলে এগুলোকে কি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায়?
এই এত দিন পর আলম ফিরে এলে মামুনের একেকবার সবকিছুর হিসাব নিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে হয় বলে—যা যা করেছিস, সবকিছুর চুলচেরা হিসাব তোকে দিতে হবে। আমাকে বোঝাতে হবে, তোর সাফল্য কোথায়? আর যদি ব্যর্থই হবি, তাহলে গেলি কেন? যে অপরাজিত যোদ্ধা ভাইকে নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা ছিল না, সে কেন এমন নিশ্চিত পরাজয়ের পথে পা বাড়িয়েছিল? মামুন এসব ভাবে বটে, কিন্তু কিছুই বলে না। আসার পর থেকে সে কোনো কথাই বলেনি আলমের সঙ্গে। আলমও কোনো বিষয় নিয়ে কিছু বলতে আসেনি। না আসাই ভালো। এখন আর কী-ই বা বলার আছে? যে জীবন ব্যর্থতায় ম্লান হয়ে গেছে, সে জীবনের কথা শুনেই বা কী লাভ? সাফল্যের কথা শুনতে ভালো লাগে, ব্যর্থতার কথা নয়।
৩.
যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমার সাদামাটা জীবনটাকে পাল্টে দিয়েছিল, মনে হয়েছিল স্বাভাবিক পারিবারিক-সামাজিক জীবন আমার জন্য নয়। এই সংসার-সমাজ, এই গতানুগতিক পারিবারিক জীবন আমাকে তাই বাঁধতে পারেনি। যুদ্ধটা আসলে এমন এক বিষয়, এ শুধু শত্রুর মোকাবেলা নয়, একই সঙ্গে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়াও। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যে যোদ্ধারা ভিন্ন মানুষ হয়ে ফেরে, সেটা ওই বোঝাপড়ার জন্যই। আমি একবার বোঝাপড়া করেছিলাম ’৭১-এ, তারপর গত ২০ বছর ধরে।
যুদ্ধের পর থেকেই স্বপ্নভঙ্গ শুরু হয়েছিল, মনে হচ্ছিল—দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু মানুষের মুক্তি আসেনি; মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ, তার শেষ হয়নি। আর তখনই যোগাযোগ ঘটল সর্বহারাদের সঙ্গে। মনে হলো এটাই আমার পথ—যোগ দিলাম ওদের সঙ্গে; এক রাতে নিঃশব্দে, কাউকে কিছু না বলে চলে গেলাম। তারপর, এই এত দিন পর ফিরে আসা, পরাজিত মানুষের দায় মাথায় নিতে হবে, সেটা জেনেই ফিরে আসা। একজন পরাজিত মানুষের পুরো জীবনটাকেই মনে হয় ভুলে ভরা। আমার গত ২০ বছরের জীবনযাপনকেও সবাই নিছক এক বিরাট ভুল হিসেবে চিহ্নিত করবে, সেটা কি আমি বুঝিনি! কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয়ী হওয়া সত্ত্বেও তো এ দেশে অনেক দিন ধরেই বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে যুদ্ধের আগেই আমরা ভালো ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধটা ভুল ছিল! যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে যারা জঘন্যতম সব অপরাধ করেছিল, তারা এই দেশে বসে এখন বলার সাহস পাচ্ছে—একাত্তরে তারা কোনো ভুল করেনি। তারা যদি ভুল না করে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা ভুল করেছিলাম; দুই পক্ষই তো একসঙ্গে সঠিক হতে পারে না! ভুলটা আসলে কাদের ছিল? সারা দেশে যেভাবে ওদের হুংকার-হুমকি শোনা যাচ্ছে, ওদের কর্মকাণ্ড যেভাবে বেড়ে চলেছে, আর সরকারিভাবে ওদের যেভাবে প্রোটেকশন দেওয়া হচ্ছে বহুদিন ধরে, তাতে মনে হয়—হয়তো আমাদেরই ভুল ছিল, নইলে তো এই দেশে ওদের অস্তিত্বই থাকত না। এসব ভাবনা আমাকে আরও চুপ করিয়ে রাখে। অথচ কী আশ্চর্য এক সময় এসেছিল আমাদের জীবনে, ভাবলে আজও শিহরণ জাগে। পুরো জাতিটাই মেতে উঠল যেন এক পাগলা ঘণ্টির আহ্বানে। সারা জীবন ধরে যাদের দেখেছি সাধারণ একেকজন মানুষ হিসেবে, তারাও নিমেষে যোদ্ধা হয়ে উঠল, লাঙল আর কাস্তে ফেলে তুলে নিল বন্দুক। সারা দেশের মানুষ কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেল যোদ্ধাদের পেছনে—সাহস দিলা প্রেরণা দিল, ইতিহাসের বীভত্সতম অত্যাচার সয়েও, অকাতরে প্রাণ দিয়েও তারা জানিয়ে গেল—মুক্তিযোদ্ধারা একা নয়, এ দেশের কোটি-কোটি মানুষ তাদের পাশেই আছে। মনে পড়ে, পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউনের সময় আমরা ঢাকায় ছিলাম, তিন দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ঊনত্রিশে মার্চে সবাই মিলে ঢাকা ছাড়লাম। পথে হাজার হাজার মানুষ, সবাই যেন আমাদেরই মতো ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে, ছুটছে কোনো এক নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে—সবার মুখই দুশ্চিন্তায় ক্লিষ্ট। রাস্তাঘাটে অল্পসংখ্যক যানবাহন, তার প্রতিটিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ, চালকদের মুখও যেন ভীতসন্ত্রস্ত, যেন তারাও ঢাকা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে চায়। বাসে গাদাগাদি ভিড়, ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ লোক মুরগির মতো নিজেদের কোনোমতে সেঁটে দিয়েছে! কোনো দিকে তাকানো যাচ্ছিল না, যেদিকেই তাকাই, ছড়ানো-ছিটানো লাশ—রাস্তাঘাটে নিতান্ত অবহেলায় কেবল কাক ও কুকুরের খাদ্য হওয়ার জন্য এমন লাশের ছড়াছড়ি আমার মনে চিরদিনের জন্য গেঁথে গেছে। এত দিন আগের সেই দৃশ্যটি এখনো এতটুকু ম্লান হয়নি, চোখ বন্ধ করলে শুধু সেটাই দেখতে পাই। আমার সারা জীবনে দেখা সমস্ত সুন্দর দৃশ্য কেড়ে নিয়েছিল ওই একটিমাত্র করুণ, মর্মান্তিক, বীভত্স দৃশ্য। বাসে যে এত মানুষ, নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো উপায়ও নেই, অথচ প্রত্যেকটি লোক চুপচাপ, এমনকি ফিসফাস করেও কেউ কথা বলছিল না, যেন নিঃশ্বাসটাও ছাড়ছিল সাবধানে—এমন ভয়ংকর আতঙ্কে কেউ কোনো দিন ভুগেছে কী না সন্দেহ। এই মানুষগুলোর অপরাধ কী? কী কারণে এমন নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালানো হলো, কেন লক্ষ-কোটি মানুষকে নিরাপত্তাহীন করে তোলা হলো? আমার চোখমুখ শক্ত হয়ে এল—টের পেলাম। মনে হলো—যুদ্ধ যদি শুরু হয়েই যায়, তাহলে আমিও যাব। যা হোক, এক অবর্ণনীয় কষ্টকর পথ পেরিয়ে বাড়িতে পৌঁছলাম রাতের বেলা। আর পৌঁছে শুনলাম এক আশ্চর্য খবর—ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী পঁচিশে মার্চ রাতেই মানিকগঞ্জ থানা আক্রমণ করে ৭০০ রাইফেল লুট করে নিয়ে গেছেন যুদ্ধ করবেন বলে। এখন তিনি যুবকদের সংগঠিত করছেন, হরিরামপুরে আসবেন কালকে, এই উদাসপুর হয়েই যাবেন সেখানে। সারা শরীরে যেন শিহরণ খেলে গেল। মনে হলো, আর কোনো সংশয় নেই—আমিও যুদ্ধে যাব, যাবই। অথচ ওই দিনের আগ পর্যন্ত কখনো ভেবেই দেখিনি যে জীবনে কোনো দিন অস্ত্র হাতে নেওয়ার দরকার হতে পারে। আমি সাহসী ছিলাম বটে, কিন্তু কোনো দিন ঢিল ছুড়ে একটা পাখিও মারিনি, মায়া লাগত বলে। সেই আমার হাতে অস্ত্র, মানুষ মারছি—ভাবা যায়? অবশ্য যুদ্ধের সময় আমি কোনো মানুষ মারিনি, পাকিস্তানি সৈন্যদের মেরেছি, ওদেরকে আমার মানুষ বলে মনেই হতো না। যা হোক, ওই খবরটি শুধু আমাকেই নয়, মানিকগঞ্জের বিপুলসংখ্যক যুবককে উদ্বেল করে তুলেছিল। খবরটা যে পুরোপুরি সত্য নয়, সেটা আমরা জেনেছিলাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর। আসলে যে ক্যাপ্টেন হালিম মাত্র সাতটা রাইফেল পেয়েছিলেন, সেটা তখন জানলে এত জোয়ার সৃষ্টি হতো না, এত সাহসও পেত না যুবকেরা। তখন আমরা কতটুকুই বা বুঝতাম? বুঝলে তো এ কথা মনে হতোই যে একটা সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিপুল অস্ত্রসম্ভারের কাছে আমাদের ওই রাইফেল, তা সাতটিই হোক আর ৭০০ হোক—নিতান্তই খেলনা। ভাগ্যিস আমরা যুদ্ধের কিছুই জানতাম না, কিছুই বুঝতাম না; জানলে এমন এক অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সাহসই পেতাম না। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, ক্যাপ্টেন সাহেব তো বুঝতেন-জানতেন, তিনি তো পাকিস্তানের আর্মিরই ক্যাপ্টেন ছিলেন, ওদের শক্তি আর সামর্থ্যও তাঁর অজানা ছিল না, জেনেশুনেও ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নেমে পড়ার সাহস তিনি কোথায় পেয়েছিলেন! এখন বুঝি, ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের যতটা না ছিল প্রশিক্ষণ—তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল সাহস, দেশকে মুক্ত করার জেদ, আর দেশের জন্য প্রাণ দেবার আকুতি। একজন মানুষ যখন দেশের জন্য প্রাণ দেবার কথা ভেবেই যুদ্ধে যায়, তখন তার কোনো পিছুটান থাকে না, থাকে বিপজ্জনক-অপরিমেয় সাহস। পাকিস্তানিরা যে হেরে গেল, তার কারণ হয়তো এই যে, ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের এই মরণপণ প্রতিজ্ঞার ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি। বুঝতে পারেনি, এই দেশের ছেলেরা দেশের জন্য নিজের প্রাণ দেওয়াটাকে একটা তুচ্ছ অথচ গৌরবময় ব্যাপার বলে মনে করে। আর বুঝবেই বা কীভাবে—ওদের মধ্যে তো এর কোনোটাই ছিল না। স্রেফ ভাড়াটে সৈন্যের মতো ওরা এসেছিল এ দেশের মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য। সে জন্যই এত লুটপাট, এত খুন, এত ধর্ষণ, এত ধ্বংসযজ্ঞ। এমনকি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার কথা ভাবলেও ওরা এমন নির্মম নিপীড়ন করতে পারত না! আমার ধারণা—ওরা জানত যে এ দেশকে আর পাকিস্তানের সঙ্গে রাখা যাবে না। ওই যে হুংকার ‘দাবায়া রাখবার পারবা না’—এই হুমকিকে ওরা সত্যি বলেই মেনে নিয়েছিল, তাই শেষবারের মতো শাস্তি দেবার জন্য আয়োজন করেছিল এমন বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের। এটাকে যে শুধু পাকিস্তানিরাই সত্যি বলে ধরে নিয়েছিল তা নয়, বাঙালিরাও তাই ভেবেছিল, নইলে সহজ-সরল মানুষগুলো এমন মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত না। এখন মনে হয়—ওই সাহস, ওই স্বপ্ন আর স্বাধীনতার জন্য ওই তীব্র আকাঙ্ক্ষাই আমাদের জিতিয়ে দিয়েছিল। নইলে পাকিস্তানিদের অস্ত্রশস্ত্র, লোকবল, ট্রেনিং—এর কোনো কিছুর সঙ্গেই আমাদের পেরে উঠবার কথা ছিল না। আমরা পেরেছিলাম, কিন্তু তবু আমাদের কারও কারও মনে হয়েছিল—মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ, তার শেষ হয়নি। সে জন্যই আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যাওয়া। কিন্তু এবার পারলাম না। এখন, পরাজিত হয়ে ফিরে আসার পর, আমার মনে হয়—যুদ্ধজয়ের জন্য শুধু সাহস থাকলেই হয় না, স্বপ্নও থাকতে হয়, থাকতে হয় একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও গন্তব্য, আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছবার সম্ভাবনা। এবার যে পারলাম না, তার কারণটা হয়তো এত দিনে বুঝতে পেরেছি আমি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৯, ২০১০
Leave a Reply