স্বাধীনতার ঘোষণা বা বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। সেই সুবর্ণজয়ন্তীর সময় বাংলাদেশের কী পরিবর্তন ঘটতে পারে বা পারে না সে-সম্পর্কে এটি একটি দূরকল্পনাশ্রয়ী রচনা।
বাঙালি কথা ভালোবাসে। তার সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা বাকস্বাধীনতা। শ্রুতিসুখকর বচনভঙ্গি তাকে মোহিত করে। সে তার দেশকে সোনার বাংলা বলে, অপার সম্ভাবনার দেশ বলে অভিহিত করে।
গত ৩৮ বছর বেশ কিছু অসম্ভব জিনিস সে সম্ভব করেছে। এই তলফুটো ঝুড়িটা টিকে আছে। সারা বিশ্বে আজকে বাংলাভাষীদের সূর্য অস্ত যায় না। ভাষার জন্য তাদের আত্মত্যাগে আজ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
মুক্তিযুদ্ধ যে স্বপ্নের কল্পনা করেছিল সেই স্বপ্নের কথা এবং পরবর্তীকালে তার স্বপ্নভঙ্গের কথা প্রকাশ পেয়েছে সাহিত্যে—কবিতায়, উপন্যাসে, নাটকে। অতি স্বল্প সময়ে এ রকম ঘটনার সফল পরিণতি এবং পরবর্তীকালের বিকৃতি আমাদের হতভম্ব করে।
১৯৭১ সালের পটভূমিকায় লিখিত হয় মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন (১৯৭২), খেলাঘর (১৯৭৩); রশীদ হায়দারের খাঁচায় (১৯৭৫), রিজিয়া রহমানের একটি ফুলের জন্য; ইমদাদুল হক মিলনের কালো ঘোড়া, পরাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আত্মজৈবনিক রচনা আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩)। একই বিষয়কে ঘিরে রচিত হয় শওকত ওসমানের জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), দুই সৈনিক (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩) এবং জলাংগী (১৯৭৬)।
একাত্তর সালে পাঁচ মাসের বন্দিজীবনের ওপর ভিত্তি করে লেখা মন্টু খানের হায়েনার খাঁচায় অদম্য জীবন নির্যাতনের এক অসামান্য দলিল। এই একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের অভ্যন্তরে নিপীড়নের কাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিঘাতে একদা অনুপ্রাণিত লেখকগোষ্ঠী সেনাশাসন, মৌলবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং স্বাধীনতা-উত্তর অবক্ষয়, বিকৃতি, অস্থিরতা, সতত সুযোগ সন্ধানকে কেন্দ্র করে বহু উপন্যাস রচনা করেছে। মৌলবাদের উত্থানে শঙ্কিত হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস পাকসার জমিন সাদবাদ (২০০৪) থেকে সেই প্রশ্ন উত্সারিত হয়েছে, ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?’ কী চেয়েছিলাম আর কী পেয়েছি সেই চাওয়া-পাওয়ার হিসাবকে কেন্দ্র করে তেমন রসোত্তীর্ণ উপন্যাস কি লেখা হয়েছে?
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেকের কাছে সমসাময়িক ঘটনা। অনেকের এ সম্পর্কে ধারণা অপ্রত্যক্ষ, যদিও এর চেতনার পরিসর বিস্তৃততর। ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে বড় মাপের উপন্যাস লেখা হয়নি। নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের ছয় দশক পরে টলস্টয়ের ওয়্যার অ্যান্ড পিস রচিত হয়। মার্কিন গৃহযুদ্ধের সাত দশক পরে মার্গারেট মিচেলের গন উইথ দ্য উইন্ড প্রকাশিত হয়। এক বিরাট ঘটনা কীভাবে কোন লেখককে প্রণোদনা জোগাবে, প্রেরণা দেবে বা অতিষ্ঠ করে তুলবে যে সে এক বড় মাপের উপন্যাস না লিখে স্থির থাকতে পারবে না—তার হদিস আমাদের জানা নেই।
অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের বাচনিক ইতিহাস সংকলিত হয়েছে। তাঁর পৌরোহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা ট্রাস্ট থেকে সুকুমার বিশ্বাস সম্পাদিত প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারীর বিবরণ তিন খণ্ডে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ নারী (২০০৭) প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এক সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক সম্পাদিত একাত্তরের চিঠি (২০০৯) প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার বিবরণ, যার যে সূত্র অতীতে শুরু হয় এবং এখনো প্রবহমান—এই ভাবনায় আফসান চৌধুরী চার খণ্ডে বাংলাদেশ ১৯৭১ রচনা করেছেন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে গোটাত্রিশেক নাটক লিখিত হয়। উল্লেখযোগ্য হলো সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের সারা জীবন ও যুদ্ধ এবং যুদ্ধ, আবদুল্লাহ আল-মামুনের এখনও ক্রীতদাস, মমতাজউদ্দীন আহমদের রাজা অনুস্বারের পালা।
নাট্যকার সাঈদ আহমেদের বিবেচনায় গত শতাব্দীর সেরা ১০টি নাটক—আসকার ইবনে শাইখের বিদ্রোহী পদ্মা, মুনীর চৌধুরীর কবর, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বহিপীর, সাঈদ আহমেদের কালবেলা, আনিস চৌধুরীর মানচিত্র, আবদুল্লাহ আল-মামুনের সুবচন নির্বাসনে, সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, মামুনুর রশীদের ওরা কদম আলী, সেলিম আল দীনের কিত্তনখোলা ও মমতাজউদ্দীন আহমদের সাত ঘাটের কানাকড়ি।
নীলিমা ইব্রাহিমের যে অরণ্যে আলো নেই, কল্যাণ মিত্রের জল্লাদের দরবার, সেলিম আল দীনের মুনতাসীর ফ্যান্টাসি, কেরামত মঙ্গল ও চাকা; আলাউদ্দিন আল-আজাদের নিঃশব্দ যাত্রা, রণেশ দাশগুপ্তের ফেরী আসছে, কবীর আনোয়ারের পোস্টার, রশীদ হায়দারের তৈল সংকট, সাযযাদ কাদিরের সাড়ে সাতশ’ সিংহ, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকির অস্থির সুস্থিতি, হাবিবুল হাসানের সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ, শাহনূর খানের পেণ্ডুলামে খুন, হাবিব হাসানের কোহিনূর তরুণ ও বহমান ক্ষত, কাজী জাকির হোসেনের শান বাঁধানো ঘাট, রবিউল হাসানের জননীর মৃত্যু চাই; মমতাজউদদীন আহমদের এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, কী চাহ শঙ্খচিল, এস এম সোলায়মানের ইঙ্গিত, আমেনা সুন্দরী; আল মনসুরের রোলার ও নিহত এলএমজি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবে প্রত্যক্ষ দুটি বিজয় ঘটেছে আমাদের নাট্যাঙ্গনে। নাটকের টিকিট থেকে প্রমোদকর রহিত হয়েছে এবং নাটকের ওপর আরোপিত ১৮৭৬ সালের সেন্সরশিপ প্রথার আইনও বাতিল হয়েছে।
২০০২ সালের মার্চের ‘শিল্প-সাহিত্যে আধুনিকতা ও বাঙালির অন্বেষণ’ শীর্ষক এক সেমিনারে নাট্যকার সেলিম আল দীন বাংলা নাটকে কাব্য-উপন্যাস-নৃত্যসংগীতের দ্বৈতাদ্বৈত রূপকে প্রতিফলিত করতে চেয়ে বলেন, ‘উপনিবেশ কাল বিদূরিত হবার পরেও ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা প্রসেনিয়াম মঞ্চের আলোর ঘুলঘুলিতে—অন্ধকারের অপচ্ছায়ারূপে লেগে থাকবে—এ কোনো অবন্ধ ও মুক্ত শিল্পসৃষ্টির পন্থা হতে পারে না।…আত্ম-অন্বেষণের পথে আধুনিক বাঙলা নাটকের আদল খুঁজতে হবে আমাদের দেশকালের বাস্তবতায়, সে পথেই শিল্পসিদ্ধি—অন্য কোনো পথে নয়।’ এই বলিষ্ঠ বক্তব্যের প্রভাবে বেশ কিছু নাটক রচিত হয়েছে। আধুনিক যুগে প্রসেনিয়াম ও অন্যান্য মঞ্চ-প্রযুক্তি অস্বীকার করা যাবে না। স্বাধীনচেতা নাট্যকারগণ তাঁদের মৌলিক নাটক বা বিদেশি নাটকের প্রভাবে বা ছায়া অবলম্বনে লিখিত নাটকে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। তাঁরা কোনো লক্ষণরেখায় বেষ্টিত থাকবেন না।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে আগের চেয়ে ছোটগল্প অনেক বেশি জনমুখী ও রাজনীতিসংলগ্ন। লেখকদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন; তাঁদের লেখা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। দখলদার বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল বহু গল্পের অনুপ্রেরণার উত্স। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম গল্পসংকলন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭১) কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় বশীর আলেহলালের প্রথম কৃষ্ণচূড়া (১৯৭২), আবুল হাসনাত সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৭৩) এবং হারুন হাবীব সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫)। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সামাজিক অবক্ষয় ও সমাজ রাজনীতির অস্থিরতার প্রতিবাদে রচিত হয় হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নানা গল্প।
আমাদের কথাসাহিত্যিকদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি শিল্পীত উপাদান যা একাধারে আকর্ষণীয় বেদনাদায়ক এবং উজ্জীবক। মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, তার বিশাল প্রেক্ষাপট ও মনোবিশ্লেষণকে সাহিত্যিকেরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই স্বাধীনতাবিষয়ক বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতা রচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, জিনাত আরা রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন আজাদ, আলতাফ হোসেন, দাউদ হায়দার ও হুমায়ুন কবীর। ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার সঙ্গে সঙ্গে সামষ্টিক চেতনা বড় হয়ে দেখা দেয়। সাধারণ মানুষের মতো কবিরাও আশাহত হয়ে স্বপ্নভঙ্গের কবিতা লেখেন। দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ,’ রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাবো’ উচ্চস্বর দ্রোহ-রসে মিশ্রিত।
২.
শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের বয়স এক শ বছর। বিভিন্ন দেশের মুক্তি আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় বিদগ্ধ চলচ্চিত্রকারেরা মানুষের আনন্দ-বেদনা ও শোষণ-বঞ্চনার বিস্ময়কর ছবি করেন।
মানুষকে যে চলচ্চিত্র আলোড়িত করতে পারে, তার প্রমাণ রাখলেন জহির রায়হান। তাঁর জীবন থেকে নেয়া মুক্তিসংগ্রামের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান প্রেরণা হয়ে রইল। একুশের প্রভাতফেরি সাউন্ড ট্র্যাকে ভেসে আসা সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পাকিস্তানি সেন্সর বোর্ড থেকে ছাড়পত্র পায়নি। এক আবেগময় চলচ্চিত্র সৃষ্টি করল ফখরুল আলমের জয়বাংলা। স্বাধীন বাংলাদেশে তা মুক্তি পায়। জীবন থেকে নেয়া ও জয়বাংলা মুক্তিসংগ্রামের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান দুই উত্স। জয়বাংলা নির্মিত হয় ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ছোটগল্পের সমন্বয়ে। পরিচালক ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ সংগ্রামী চেতনা আশ্রয় করে স্বাধীনতা-পূর্বকালে সংগ্রামী মানুষের মুক্তিচেতনার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেন।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। আব্দুল জব্বার খানকে প্রধান করে ‘চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগ’ গঠিত হয়। জুলাই মাসে শুরু হয় জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড নির্মাণের কাজ। পরে একে একে নির্মিত হলো লিবারেশন ফাইটারস (পরিচালক আলমগীর কবির), ইনোসেন্ট মিলিয়নস (বাবুল চৌধুরী) এবং এ স্টেট ইজ বর্ন (জহির রায়হান)।
প্রচারধর্মী স্টপ জেনোসাইড কালক্রমে মুক্তিযুদ্ধের ওপর এযাবত্কালে নির্মিত অন্যতম সেরা ছবি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পর্দায় মানুষের যন্ত্রণাদগ্ধ হূদয়ের চিরকালের প্রতিকৃতির প্রতিফলন ঘটালেন জহির রায়হান। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও প্রেরণায় আলমগীর কবির নির্মাণ করেন লিবারেশন ফাইটারস—মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন, ট্রেনিং এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সাউন্ড ট্র্যাকে ওভারল্যাপ করে এই ছবিতে প্রথম আসে। আরও রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’য় শপথ গ্রহণ। সুর বাজছে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের। আলমগীর কবিরের লিবারেশন ফাইটারস পায় এক অনবদ্য সৃষ্টির মর্যাদা।
বাবুল চৌধুরী নির্মিত ইনোসেন্ট মিলিয়নস-এর বিষয়বস্তু সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের অসহায় শিশুরা। জহির রায়হানের এ স্টেট ইজ বর্ন—যে ইতিহাসের শুরু ’৪৭-পূর্বকালে।
ওই চারটি প্রামাণ্যচিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধকালে নির্মিত কয়েকটি ছোট নিউজ রিল ছাড়া পরে অন্য কোনো চলচ্চিত্র আর নির্মিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশ হলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রেক্ষাপট। ব্যক্তিগত উদ্যোগে লিয়ার লেভিন এসেছিলেন বাংলাদেশ ফ্রন্টে। তেমনি এসেছিলেন শুকদেব। ভারতীয় চলচ্চিত্রকার শুকদেব মহাকাব্যসম ছবি নাইন মান্থস টু ফ্রিডম-এ তুলে ধরেন একটি জাতির রক্তাক্ত, বেদনার্ত এবং সংঘাতময় জন্ম-ইতিহাস।
একাত্তর সালে যুক্তরাজ্যের টেলিভিশন চ্যানেল গ্রানাডার জন্য ২৬ মিনিটের প্রামাণ্য ছবি মেজর খালেদস ওয়ার তৈরি করেছিলেন এক ভারতীয় মহিলা। জাপানি চলচ্চিত্রকার নাগিশা ওশিমা নির্মাণ করেন বাংলাদেশ স্টোরি। পরে তিনি রহমান: দি ফাদার অব নেশন নামে নির্মাণ করেন আরেকটি ছবি। ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতা গীতা মেহতা নির্মাণ করেন ডেটলাইন বাংলাদেশ, যার বিষয়বস্তু গণহত্যা ও আমাদের মুক্তিসংগ্রাম। ভারতীয় চলচ্চিত্রকার দুর্গাপ্রসাদ নির্মাণ করেন দুরন্ত পদ্মা। পাকিস্তানি চলচ্চিত্রকার এ জে কারদারের বিট্রেয়াল-এর মতো কেউ কেউ পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতাকে ঢেকে দিতে প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেন। স্লটার হাউজ-এর উদ্দেশ্যই ছিল অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষকে হেয় করা। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত ভারতীয় চলচ্চিত্রকার আই এ জোহরের জয় বাংলাদেশ ছবির সিংহভাগ এক নর্তকীর দেহ প্রদর্শনেই ব্যয়িত হয়।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি লুপ্ত হয়ে গেল অর্থনৈতিক দাপটের কাছে? ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মিত হলো মাত্র চারটি। সে বছর চারটি উর্দু ছবিসহ মোট ৩০টি ছবি নির্মিত হয়েছিল এখানে। ১৯৭৩ সালেও নির্মিত হলো চারটি ছবি। সে বছরও একটি উর্দু ছবিসহ নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৩০। ১৯৭৪ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মাত্র দুটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। বাণিজ্যিক প্রবণতাকে জোরদার করতে মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে অনিবার্য পরিণতিতে এল নারীধর্ষণ এবং রাজাকার বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম নির্মিত ছবিটি হলো ওরা এগারো জন (চাষী নজরুল ইসলাম)। এই এগারো জন মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের সংহত করে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ছবিটি শেষ হয় শত্রুবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে। বেদনা বা দুঃখের কথা নয়, যুদ্ধের কাহিনিই এ ছবিটির একমাত্র সম্বল। সদ্য মুক্তিযুদ্ধফেরত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি এ ছবিতে অভিনয় করেন।
সুভাষ দত্ত নির্মিত অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীর কাহিনি মূলত এক চিত্রাভিনেতার মুক্তিযুদ্ধকালের অভিজ্ঞতাকে ঘিরে আবর্তিত। এ অভিনেতা যুদ্ধে যেতে পারেন না অথচ কাপুরুষের মতো লক্ষ করেন নানা ঘটনা এবং যার অনিবার্য পরিণতি ধর্ষণ। এই কাপুরুষ অভিনেতাই বিয়ে করে ফেলেন এমনি এক ধর্ষিত নারীকে।
বাণিজ্যিকতার ষোলকলা পূর্ণ হয় যখন এ দেশীয় ছবিতেও ভারতের আই এস জোহর নির্মিত জয়বাংলা ছবিটির মতো মুক্তিযুদ্ধ এবং নারীদেহের অশ্লীল প্রদর্শনী একাকার হয়ে গেল। বাঘা বাঙালী (পরিচালক আনন্দ) সে লক্ষণকেই প্রকট করে তুলল। একই সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত রক্তাক্ত বাংলাও (মমতাজ আলী) নামে মুক্তিযুদ্ধের ছবি হলেও বাণিজ্যিকতার কোনো উপকরণও এসব ছবিতে বাদ ছিল না। পাকিস্তানি নরঘাতকেরা এই ছবিগুলোতে এসে রীতিমতো তখনকার বোম্বের হিন্দি বা করাচির উর্দু ছবিগুলোর খলনায়কে রূপান্তরিত হলো। টেবিলে মদের বোতল, সামনে নৃত্যরত বঙ্গললনা ইত্যাদি উপকরণ পরিচালকদের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিটাকে প্রকট করে তোলে। ছবিগুলো সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র ঠিকই পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাস্তবতার বিকৃতকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণ স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেই শুরু হয়।
জহির রায়হানকে আমরা হারালাম। আলমগীর কবির নির্মাণ করলেন ধীরে বহে মেঘনা। মুক্তিযুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণের এক ব্যতিক্রমী চেষ্টায় প্রামাণ্য ও ফিকশন ছবির সমন্বয়ে সচেষ্ট হন আলমগীর কবির। মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধযাত্রা, ১৬ ডিসেম্বরে ট্রাকভর্তি মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি এবং ঘরে ফেরার দৃশ্যের একই ফুটেজ পরবর্তীকালে তাঁর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে নামের প্রামাণ্য ছবিতেও দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের তথ্য বিভাগ থেকে তোলা নিউজ রিল ও ফুটেজ ব্যবহার করে তিনি নির্মাণ করেন পুগ্রোম ইন বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ ডায়েরি নামে আরও দুটো প্রামাণ্যচিত্র। ১৯৭৪ সালে নির্মিত আলোর মিছিল (নারায়ণ ঘোষ মিতা) ছবিতে চলে এল সমকালীন বাস্তবতা—একই পরিবারে মুক্তিযোদ্ধা ও চোরাকারবারিদের সহাবস্থান।
যুদ্ধের কয়েক বছর পর হারুন-অর-রশীদের মেঘের অনেক রং ছবিটি একটি শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মিত—সদ্য বোধসম্পন্ন যে ছেলেটি তার মাকে খুঁজে বেড়ায়। এরই ফাঁকে চলে আসে যুদ্ধের কথা। পরিমিতিবোধের জন্য এ যাবত্ নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর কয়েকটি ছবির মধ্যে মেঘের অনেক রং-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শহীদুল হক খান নির্মিত কলমীলতায় যুদ্ধদৃশ্যের সঙ্গে গান এবং নৃত্য জুড়ে দিয়ে যুদ্ধের মতো ঘটনাকে বালখিল্যতার পর্যায়ে নামিয়ে আনা হলো।
১৯৭৩ সালে আবার তোরা মানুষ হ ছবিতে পরিচালক খান আতাউর রহমান দেখালেন, মুক্তিযুদ্ধে যাদের কেউ কেউ প্রত্যক্ষভাবেই বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ সমাজে লুটতরাজসহ নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত হয়। মোরশেদুল ইসলামের আগামীর মূল বিষয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের উত্থান এবং সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান।
তানভীর মোকাম্মেলের হুলিয়ায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব দশকের একজন রাজনৈতিক কর্মীর পলাতক জীবনসংগ্রামের কথা। আগামীর নির্মাতার দ্বিতীয় ছবি সূচনাতে চলচ্চিত্রকার ফ্লাশব্যাকে চলে যান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে—আবার ফিরে আসেন সমকালে। তিনি স্পষ্টতই দেখাতে চান, সংগ্রামী অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। একাত্তরে যা ছিল, আজও তেমনিভাবেই রয়েছে। মোস্তফা কামালের প্রত্যাবর্তন ছবিরও মূল বিষয় মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ এই প্রজন্মের জন্য অচ্ছেদ্য প্রেরণার উত্স। কোনো কোনো নির্মাতা অন্য বিষয়ে ছবি করতে থাকলেও পরবর্তীকালে কোনো না কোনো সময় সে বিষয়ে ফিরে আসছেন। আবু সাইয়ীদ প্রথমে আবর্তন নামে ভিন্নমাত্রার একটি ছবি করলেও তাঁর দ্বিতীয় ছবি ধূসর যাত্রায় মুক্তিযুদ্ধকেই অনুভব করতে চাইলেন। এ ছবি করতে গিয়ে তিনি বিষয় নির্বাচিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্মৃতিচারণাকে। আরেকটি মুক্তিযুক্তবিষয়ক ছবি খান আখতার হোসেন পরিচালিত দুরন্ত।
মুক্তিযুদ্ধ শুধু কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্রের বিষয় হয়েই থাকেনি। প্রামাণ্যচিত্রেও মুক্তিযুদ্ধ বা তার স্মৃতিচারণা মুখ্য বিষয়বস্তু হয়েছে। তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত স্মৃতি-’৭১-এর বিষয় একাত্তরের বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড। বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর পরিবারের নানাজন—মা, স্ত্রী, মেয়ে বা ছেলে স্মৃতিচারণা করেছেন সেই ভয়ংকর রাতের কথা যখন তাঁদের প্রিয়জনকে তাঁদের মাঝ থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী। দর্শকলাভে মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো অন্য যেকোনো বিষয়ের তুলনামূলকভাবে সাফল্য লাভ করে।
১৯৯৩ সালে নির্মিত একাত্তরের যীশু (নাসির উদ্দীন ইউসুফ) অধিকসংখ্যক দর্শক আকর্ষণে সক্ষম হয়। ১৯৯৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেণ আগুনের পরশমণি। একাত্তরের যীশু ও মুক্তির গান-এর মতো মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে যথার্থ চলচ্চিত্র নির্মিত হলে তা দর্শকনন্দিত হবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৯, ২০১০
Leave a Reply