প্রচলিত প্রাচ্যদেশীয় শিল্পকলা বললেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কোমল হাতের আঙুলের ইশারা, টানা টানা অর্ধ-উন্মীলিত চোখ। চিকন কটিদেশ, সুবিন্যস্ত কেশরাজি, সুকোমল দেহাবয়ব, মায়াবী চাহনি প্রভৃতির সমন্বয়ে সৃষ্ট শিল্পকর্ম। কিন্তু প্রাচ্যদেশীয় শিল্পকলা মূলত প্রাচ্যদেশীয় দর্শন ও ভাবের রূপায়ণ। এই শিল্পের প্রাণ রেখা। আলোছায়া পরিপ্রেক্ষিত এখানে গুরুত্বহীন। প্রাচ্যদেশীয় শিল্পকলা শুধু দেখার বিষয় নয়, সঙ্গে সঙ্গে পড়ারও বিষয়। বর্ণনার প্রাধান্যকে ছাড়িয়ে কখনোই গাণিতিক শুদ্ধতা প্রাচ্যকলায় বিবেচ্য বিষয় নয়।
স্বদেশি আন্দোলন প্রভাবিত নব্যবঙ্গীয় চিত্ররীতি প্রাচ্যদেশীয় শিল্পধারায় নতুন গতি সঞ্চার করে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর হ্যাভেলের সহযোগিতায় কলকাতা আর্ট স্কুলকে ভারতে আধুনিক শিল্পচর্চার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। অবনীন্দ্রনাথ মুঘল শিল্পরীতির অভিব্যঞ্জনা, প্রাচীন ভারতীয় সব শিল্পধারার নির্যাস, জাপানি শিল্পরীতির ওয়াশ পদ্ধতিকে গ্রহণ করেন। তিনি জাপানি শিল্পরীতির মতোই পশ্চাদ্ভূমিকে নগণ্য করে আঁকা বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে প্রাচ্যদেশীয় শিল্পরীতিতে নতুনত্ব সৃষ্টি করেন। পাশ্চাত্য রীতিতে যেকোনো বস্তুকে আকৃতিগত পরিমণ্ডলে উপস্থিত করে অর্থাত্ কাঠামোর ওপর নির্মাণের চেষ্টা করা হয়, অথচ প্রাচ্য রীতিতে শুধু কিছু রৈখিক টানে বস্তুর ভাবকেই দৃশ্যমান করে তোলা হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্য চিত্রকলার বন্ধন থেকে মুক্ত করে আধুনিক কালের ভারতীয় চিত্রকলার চর্চাকে প্রাচ্যধারায় সমৃদ্ধ করা। অবনীন্দ্রনাথের প্রয়াস ছিল আকৃতিতে ও প্রকৃতিতে নতুন যুগের ভারতীয় চিত্রকলাকে প্রাচ্যমুখী করে তোলা এবং এর ভিত্তিতে স্বকীয় চরিত্রে এই চিত্রকলার বিকাশ ঘটানো।
প্রাচ্যশিল্পের নবধারার বিস্তার দেখা যায় বর্তমান সময়ের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগে প্রাচ্যধারার রীতিনীতির অনুসরণ, কৌশলগত দিকের চর্চা করা হয়। এই ধারার অনুসারী ছয় শিল্পী আব্দুস সাত্তার, নাসরীন বেগম, আব্দুল আযীয, মলয় বালা, মিজানুর রহমান ফকির এবং মাসুদা খাতুন। ‘শিকড় সন্ধান’ শিরোনামে তাঁদের চিত্রকর্মের যৌথ প্রদর্শনী চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে। তাঁদের প্রত্যেকের কাজের বিষয়ববস্তু ও আঙ্গিকে নিজস্বতার ছাপ সুস্পষ্ট। শিল্পী আব্দুস সাত্তারের চিত্রে প্রাচ্যকলার বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষণীয় ছিল যদিও মাধ্যম কাঠখোদাই। একটি ভিন্ন মাধ্যমে ওয়াশ পদ্ধতির স্বচ্ছতা, রৈখিক কোমলতা ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে প্রাচ্যধারার শিল্পকলার পরিপক্বতার ছাপ শিল্পীর কাজে লক্ষণীয়।
শিল্পী নাসরীন বেগম তাঁর সংবেদী শিল্পভাবনায় স্বপ্নীল আবেশ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃজনশীলতা প্রাচ্যধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁর ‘সমুদ্র কন্যা সিরিজ’ দর্শককে নাগরিক জীবনের ক্লেশ থেকে মুহূর্তের জন্য হলেও সামুদ্রিক ভাবালুতায় নিমগ্ন করে তোলে।
শিল্পকলার ইতিহাসে ডুবে গিয়ে মাসুদা খাতুন তুলে আনেন প্রাচ্যদেশীয় অপরূপ ভাবগম্ভীর শিল্পকর্ম। তাঁর ‘বুদ্ধ সিরিজ’-এ বর্ণ প্রয়োগে পরিশীলতা ও পরিমিতির ছাপ প্রশংসনীয়। জীবনবোধের অন্তর্দৃষ্টিতে প্রাচ্যদেশীয় শিল্পরীতির কোমল বহিরাবরণে আবৃত তাঁর চিত্রকর্ম। শিল্পী আব্দুল আযীযের বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপস্থাপন কৌশল ও প্রকাশভঙ্গিতে স্বকীয়তার চেষ্টা লক্ষণীয়। কিন্তু প্রাচ্যদেশীয় শিল্পরীতির ভাব, লাবণ্যযোজন, রূপ, প্রমাণ, সাদৃশ্য—এসবের সমন্বয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা উত্সাহব্যঞ্জক নয়।
শিল্পী মলয় বালা ও মিজানুর রহমান ফকিরের কাজ প্রাচ্যদেশীয় শিল্পের কৌশলে পারঙ্গমতার পরিচয় দিলেও বিষয়বস্তু নির্বাচনে গতানুগতিক ও পুনরাবৃত্তিমূলক।
দ্বন্দ্বময় মানসিকতাই এ যুগের বাস্তবতা। ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, যন্ত্রণা বা আনন্দ উপস্থিত থাকে। তবে অতীতে মগ্ন হয়ে বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ ভুলে যাওয়ার সময় এখন নয়। প্রাচ্যদেশীয় শিল্পরীতিতে দর্শনগত দিকটিই প্রধান, কলাকৌশল নয়। প্রশ্ন হলো, যথার্থ প্রাচ্যদেশীয় শিল্প কি বর্তমানকালের শিল্পীরা অনুসন্ধান করছেন? এই সন্ধানের পথে অতীত ঐতিহ্যকে শিল্পীরা কীভাবে উপস্থাপন করে চলেছেন? সেই উপস্থাপনের অভিমুখ কোন দিকে—ভবিষ্যতে না অতীতে? শিল্পীরা নতুন নতুন ভঙ্গি ও বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেছেন তাঁদের নিজস্ব শিল্পপ্রয়াসে। ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে আধুনিকতার সংজ্ঞাও বিনির্মাণ করেছেন। তবে কালের প্রেক্ষাপটে উপলব্ধির চেষ্টাই হবে তাঁদের শিকড় সন্ধানের সার্থকতা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৯, ২০১০
Leave a Reply