মিহির সেনগুপ্ত – সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, বিষাদবৃক্ষ, ধানসিদ্ধির পরনকথা প্রভৃতি স্মৃতিরকথাধর্মী বইয়ের জন্য আলোচিত। তাঁর রচনার প্রধান বিষয় দেশভাগের স্মৃতি। সম্প্রতি তিনি তাঁর মাতৃভূমি বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় প্রথম আলোর ‘সাহিত্য সাময়িকী’র জন্য দেওয়া এই রচনাটিও দেশভাগের সেই স্মৃতি নিয়ে লেখা।
প্রায় পঁচিশ বছর পর ভাবির সঙ্গে দেখা। এই পঁচিশটা বছরে খুব কম দিনই গেছে, যেদিন একবার না একবার ভাবির কথা মনে পড়েনি। গ্রামের কথা উঠলেই তাঁর মুখখানা যেন ঝলমলিয়ে উঠত। আর কারণে-অকারণে দেশের বাড়ির কথা যে আমার মনে পড়েই সে কথা তো আমার পরিচিতজনেরা জানেনই। দেশ ছেড়ে এপারে আসার পর থেকে এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
ভাবি, আলমগীর, জাহাঙ্গীর আর নাজমার মা। ওদের বাবা জনু তালুকদার আমার জেঠামশাইকে বাবা এবং বাবাকে কাকাবাবু ডাকতেন। সেই সুবাদে তিনি আমার জনুদা এবং তাঁর স্ত্রীকে ডাকতাম ভাবি। ভাবি ডাকটায় তাঁর খুব আপত্তি ছিল প্রথম প্রথম। বলতেন, নিজেগো ডাকগুলান বাবা, কাকা, দাদা রাইখ্যা মোরে ভাবি বোলাও ক্যা? বৌদি কইলে জাইত যাইবে? আমি বলতাম, আমার বৌদি আছে ম্যালা, ভাবি একজনও নাই। ভাবি বাড়ন্ত। ভাবি ডাকটাও আমার মিষ্টি এটটু বেশি লাগে, আমি ভাবিই ডাকমু তোমারে। কৈফিয়তটা পছন্দ হতো না ভাবির। ভাবি আমাকে একটা নতুন স্বপ্নের সঙ্গী করেছিলেন।
হাশেম তালুকদার, মানে জনুদার জনক পিতা ছিলেন আমাদের গ্রামের দক্ষিণ দিকের একটা মুসলমান-প্রধান গ্রামের মানুষ। আগে চিনতাম না। এক শীতের ভোরে বাবা জেঠামশাইয়ের কিছু উচ্চকণ্ঠের আলোচনা শুনে বাইরে এসে দেখি একজন প্রৌঢ় ও এক যুবক আমাদের সিঁড়ির ধাপে বসে কেঁদে কেঁদে তাঁদের কী বলছেন। প্রৌঢ় জোড়হাতে জেঠামশাইকে বলছিলেন, বাবু, মোর চাচাতো ভাই জুম্মন্ইয়া মোরগো ভিডাছাড়া করছে। বৌ-পোলাপানেগো লইয়া দাশের বাড়ির ওই ভাঙ্গা দালানে কাইল রাইত থিকা আছি। ও বাড়িডা তো আপনেরগো দখলে। মোগো যুদি ওহানে এটটু আশ্রয় দেন, আল্লায় আপনের ভালো করবে। হাশেম বাড়িটা জবরদখল করতে পাতেন। করেননি। সব শুনে জেঠামশাই বললেন, হাশেম, তুমি তো এহনো তালুকদারবাড়ির বড় পোলা। নামের শ্যাষে তালুকদার পদবিডা এহনো রাখছো। তোমার এ অবস্থা? যখনকার কথা তখনও মধ্যস্বত্ব লোপ হয়নি। হাশেম বললেন, দ্যাহেন বাবু, তালুকদার আছেলেন মোর পরদাদার বাপে। হ্যার তাল্লুক মুল্লুক কতডা কী আছেলে হেয়া তো আপনের অজানা না। হেনার বংশে মোরা এহন সংখ্যায় একশো ষাইট জোন। ভাগাভাগি তো অইছেই, হ্যার উপার য্যার খ্যামতা বেশি হে ছল্লিবল্লি, কল কৌশল করইয়া দখলদারি বাড়াইয়া খালি নিজের নিজের সাত্থ দ্যাখছে। শ্যাষতক মোরে তো কাইল বাড়ির থিহা পেরায় বাঁশডলা দিয়া লামাইয়া দেলে রাস্তায়। তালুকদার কাঁদছিলেন।
—থানায় গেলা না? মামলা করো। দ্যাশে আইন নাই না কি?
—ট্যাহা কই? থানায়, আদালতে তো গেলেই পয়সা চাইবে। মোর খাওনই জোডে না, মামলা-মোকদ্দমা ক্যামনে করি?
—গজনবী তালুকদারের বংশের পোলা অইয়া, এয়া তুমি কও কী?
—বাবু, এই জন্উয়ার মাথায় হাত রাইক্যা ধম্মসাক্ষী কই, মোর ভাগে ধান জমি পড়ছে মাত্তর এক কুড়া। টানইয়া টুনইয়া তিন, সাড়ে তিন মাসের চাউল জোডে, বাকি বেশির ভাগটাই চালাইতে অয় টাডেপিডে। আপনেরে কমু কী, মোরা বাপ-ব্যাডায় আইজকাইল কামলার কামও করি। প্যাড তো অনেকগুলা।
আমার জেঠামশাই অত্যন্ত বিষয়ী মানুষ। দয়া, মায়া, আবেগে ভেসে যাওয়া তাঁর স্বভাব নয়। তাঁর হিসাব পত্তর, দয়া, দাক্ষিণ্য সবই আখেরের লাভের কথা মাথায় রেখে। হাশেম তালুকদারের আর্জি শুনে বাবাকে একটু তফাতে নিয়ে গিয়ে কী-সব পরামর্শ করলেন। বাবা বললেন, না দাদা, হাশেমগো আশ্রয় দিতেই হইবে। জেঠামশাই বললেন, অবইশ্যই দিমু। কিন্তু নির্মল তো টাকা চাইবে। হেয়ার কী করমু? ও তো টাকা এহন দিতে পারবে না।
—কিস্তিতে দেবে। মানুষগুলা তো আগে আশ্রয় পাউক। আমি নির্মলরে লেহুম।
নির্মল দাশ দাশের বাড়ির ওয়ারিশ। তাঁরা আমার জন্মেরও অনেক আগে পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। তারপর একসময় বাড়িটার ছাদ ধসে, জঙ্গলে প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়ে একটা পোড়োবাড়িতে পরিণত হয়। দুএকবার নির্মলদা দেশে এসে সব বিক্রিবাটা করে মিটিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাপাটা খুব সহজ ছিল না। একসময়, যতদূর মনে আছে, বাবা জেঠামশাইকে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন যাতে বাড়িটা বিক্রি করে তাঁকে খবর দেওয়া হয়। বাড়িটার বিষয়ে আমার অতি শিশুকালের একটা স্মৃতি আছে। আমাদের পাশের বাড়ির এক জ্ঞাতির জনৈক কুটুম্ব ওই দাশের বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই থেকে বাড়িটার মালিক তিনিই হন; অবশ্য ভূত হয়ে। সেসব দিনে আমরা শিশুরা দূরস্থান, বড়রাও কেউ দিনেমানেও তার চতুঃসীমানায় যেতাম না। বাড়িটা ভূতের বড়ি হিসেবেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। কেউ ওদিকে গেলেই ভূত ভদ্রলোক নাকি ঢিল মেরে তাকে তাড়াতেন। অপঘাত-মৃত্যু কীনা। এসব ক্ষেত্রে এমনই হয়। যা হোক, জেঠামশাই বললেন, হাশেম, ও বাড়িডায় তো ছাদই নাই, ওহানে থাকপা ক্যামনে?
—আপনেরা যুদি মোগো ওহানে থাকতে দেন, তয় আইজঐ নাইরখোল পাতার চাল বান্ধইয়া থাহনের মতো ব্যবস্থা করইয়া ফালাইতে পারমু হ্যানে, ইনশাল্লা।
বাবা বললেন, গোয়ালঘরে দুই বান টিন আছে না দাদা?
—আছে, তয়—জেঠামশাই যেন মনে মনে একটু বিরক্ত হলেন।
—না, ‘তয়’ না, ওডা হাশেমরে দিয়াই দেও। পোলাপান লইয়া এই শীতে ও করবে হ্যানে কী নাইলে? আঃহারে!
—ঠিক আছে, তুমি যহন কইথে আছ। গজনবী তালুকদারের বংশ!
হাশেম তালুকদার জেঠামশাই আর বাবাকে হাত জোড় করে সমানে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর দুচোখে সে যে কী করুণ কাকুতি আর মুশকিল আসানের দৃষ্টি, তা আজও মনের মধ্যে স্পষ্ট। জেঠামশাই বললেন, আপাতত থাকো। পরে কথা অইবে হ্যানে। অর্থাত্ ব্যাপারটা একটু ঝুলিয়ে রাখতে চাইলেন। কিন্তু হাশেম তালুকদারও তালুকদার বংশেরই মানুষ। পরে বাবু যদি বেমত করেন, সেটা আগেভাগেই মিটিয়ে রাখতে চাইলেন। বললেন, বাবু, এই জনউয়া মোর আওলাদ। ধম্মসাক্ষী, আইজ থিকা আপনে ওর ধম্মবাপ। আশ্রয়ডা যহন দেলেনই, পাকা করইয়া দেন। জনুদা বললেন, আপনেরে মুই বাবা বোলাইলাম। আইজ থিহা আপনে মোর বাপ। ধম্ম সাক্ষী। আর এই ফুডাঘডির তালুকদারে খালি মোর জম্মদাতা। আর ইনি মোর কাকাবাবু। কয়েন, মোর আর্জি, মোর জম্মদাতার আর্জি আপনেরা কবুল করলেন তো!
দাদার সতর্কতার ইশারা-ইঙ্গিত ভুলে বাবা বললেন, কবুল। তোমরা ওই বাড়িথেই থাকপা ওয়াদা করলাম। জেঠামশাই বললেন, নির্মল দাশরে কি তয় আইতে লেখমু হাশেম?
—মোগো এট্টুু গুছাইয়া বইতে দেন। মোর অবস্থা তো বেয়াকই কইলাম। নিম্মল দাশেরে মুইই চিডি দিমু, আপনের লগে পরে বাতচিত্ করইয়া, যেমন আপনে কইবেন। আর ল্যাখফেন তো আপনেই। মুই তো গুছাইয়া ল্যাখথে পারমু না।
—বেশ হেইডাই ভালো। তয় আয়ো যাইয়া। কাম তো মেলাই আছে।
বাবা বললেন, ফডিকরে কই টিনগুলা বাইর করইয়া দিতে। কী কও দাদা? বাবা এ ব্যাপারটাও ঝুলে থাক, তা চাইলেন না।
—বেশ, তোমার যেমন ইচ্ছা, তয় ভাবছিলাম, গোমাইর ঘরের টিনগুলা বদলানো দরকার, থাউক হেয়া পরে দেহন যাইবে। হাশেম তালুকদার বললেন, বাবু, হেয়া সোমায়মতো মুইই ব্যবস্থা করইয়া দেতে পারমু আল্লার দোয়ায়।
হাশেম তালুকদার তদবধি আমাদের চাচা এবং তাঁর ছেলে জনু, জনুদা। এভাবেই অন্য সবার সঙ্গেও আমরা পরস্পর ব্যবহারিক এবং আত্মিক সূত্রে আবদ্ধ হলাম দুই পরিবারের সদস্যরা। অবশ্য লোকাচারের বেড়াটা থেকেই গিয়েছিল। যদিও হাশেম চাচা এবং জনুদাই এই সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন, কিন্তু এর আসল প্রাণদাত্রী ছিলেন ভাবি, জনুদার স্ত্রী, যাঁকে নিয়ে আমার মূল গল্প। অথবা একে ‘গল্পই’ বা বলি কেন!
আমাদের অঞ্চলের সাধারণ মুসলমান চাষির ঘরের মেয়ে-বৌ হলেও ভাবির শিক্ষা-দীক্ষাটা একটু ব্যতিক্রমী ছিল। ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়া মেয়ে সে যুগে এখানে হরবখ্ত মিলত না। তার ওপর তিনি বেশ একটু পুঁথিপত্তর-বিলাসী ছিলেন। বই পড়ার প্রতি তাঁর একটা স্বাভাবিক আগ্রহ ছিল। এই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার একটা অত্যন্ত সশ্রদ্ধ প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁকে প্রায়ই গল্পের বই জোগান দেওয়া আমার একটা নিয়মিত কর্তব্যকর্ম ছিল। আমি নিজেও শৈশবকাল থেকেই গল্পের বইয়ের পোকা ছিলাম।
তাঁর সঙ্গে আলাপের প্রথম দিনটির কথা আজও আমার পরিষ্কার মনে আছে। বাবা জেঠামশায়ের দেওয়া দুই বান (চৌদ্দখানা) টিনের ছাউনি লাগিয়ে দাশের বাড়িটা সাফ-সুতরো করে দিন চার-পাঁচের মধ্যেই ভাবি এক সন্ধ্যায় তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাড়ি মা-জেঠিমার সঙ্গে আলাপ করতে। আমি তখন সবে স্কুলের ছাত্র। কত আর বয়স! প্রথম আলাপেই আমাকে ‘ভাই’ বলে সম্পর্ক পাতালেন। জেঠিমাকে মা এবং আমার মাকে কাকিমা। সবই জনুদার সঙ্গে সম্পর্কের জন্য। আলাপ-পরিচয় সেরে আমাকে বলেছিলেন, ভাই, মোগো বাড়ি যাইও। অশিক্ষিত, হালইয়া চাষা মোছলমানের বৌ মানইয়া তুইচ্ছতা করইও না। তোমাগো লগে মেশলে মোর পোলারা হয়তো মানুষ অইবে। মোগো হালইয়া চাষার সোমাজে তো ল্যাহাপড়ার চলও নাই, উপায়ও নাই। খালি নিজেরা শিক্ষিত অইলেই চলবে? মা বলেছিলেন, বৌডিরে আমার বড় ভালো লাগল। যেমন লক্ষ্মী-লক্ষ্মী চেহারা, তেমনই মিষ্ট স্বভাব। সত্যিই ভাবি দেখতে এবং স্বভাবে ভারি চমত্কার ছিলেন। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের কোনো চাষি-ঘরের বৌকে অত চমত্কার ওখানে আর একজন দেখিনি। অবস্থা-নির্বিশেষে আমাদের অঞ্চলের মানুষেরা যে খুব পরিচ্ছন্ন এমন বলতে পরি না। তার মধ্যে ভাবিকে আমার একেবারেই আলাদা মনে হয়েছিল। অদ্ভুত সুন্দর এক শীলিত মন ছিল তাঁর।
এর বছরখানেক কি তারও কিছুদিন পরে মধ্যস্বত্ব-প্রথা সরকার রদ করে দেয় কোনো রকম পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। ফলে আমরা আর্থিকভাবে খুব অসহায় হয়ে পড়ি। বাবা জেঠামশাই শিক্ষকতাকে পেশা করেন, আমিও স্কুলের অবসরে প্রাইভেট ছাত্র পড়াতে শুরু করি।
তথাপি আকস্মিক নেমে আসা দারিদ্র্যের মোকাবেলা করতে পারছিলাম না। ভাবি আমাদের অবস্থাটা বুঝেছিলেন। আলমগীর ও জাহাঙ্গীরকে পড়ানোর জন্য এই সময়টায় তিনিও আমাকে নিয়োগ করেন। আমি পয়সা নিতে আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু ভাবি তা শোনেননি। তত দিনে হাশেম চাচা এবং জনুদা, দুই বাপ-ব্যাটা এই পোড়ো ভূতের বাড়িটাকে আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছেন। বাড়ির মজে যাওয়া পুকুরগুলো সংস্কার করে মাছের চাষ, হাঁস-মুরগির পালন, পাঁঠা-ছাগল, গরুবাছুর ইত্যাদির আয়োজন তো করলেনই, চাষের ব্যাপারে অভূতপূর্ব দক্ষতায় গোটা বাড়িটাকে একেবারে যেন বেহেশত করে তুললেন। সেটা এতই চোখ-ধাঁধানো এবং প্রশংসনীয় যে সরকার ঢাকায় হাশেম চাচাকে ডেকে এ উপলক্ষে পুরস্কৃত করেছিল। বাড়িটাকে প্রথমে নয়া বাড়ি এবং পরে তালুকদার বাড়ি বলে তাঁরা উল্লেখ করতে লাগলেন। ভাবি অবশ্য বরাবর নয়া বাড়িই বলে এসেছেন। নয়া বাড়ির নির্মাণে নিঃসন্দেহে হাশেম চাচা এবং জনুদার অমানুষিক শ্রম কার্যকরী ছিল। কিন্তু তাঁরা শুধু খাটতেই পারতেন। তাঁদের মগজে কোনো পরিকল্পনা, সৌন্দর্যবোধ বা দূরদর্শিতা তেমন ছিল না। সেখানে যে ভাবির পরিচালনাটাই মূলত দায়ী ছিল, সেটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। ভাবির বাপের বাড়ির লোকেরা মোটামুটি সম্পন্ন এবং দক্ষ চাষিগৃহস্থ ছিলেন। সেই পরিবারে শিক্ষা-দীক্ষার মানও যথেষ্ট না হলেও, অঞ্চলের অন্যান্য পরিবারের তুলনায় অনেকটাই উন্নত ছিল। এ রকম একটা পরিবারে ভাবির বিয়ে হওয়াটা একটা অবাক কাণ্ড। তাঁর অভিভাবকেরা বোধ হয় জনুদাদের তালুকদার ‘খানদান’-এর কথাটাই শুধু ভেবেছিলেন।
গ্রাম তখনও একেবারে হিন্দুশূন্য নয়। সুতরাং একটি মুসলমান পরিবার হিন্দুপ্রধান গ্রামে এসে গেরস্থালি পাতবে—এতটা উদারতা হিন্দু সমাজের কাছ থেকে হিন্দুরাও আশা করত না। গ্রামের অনেক ছাড়া-ভিটের দখলদারি অনেক মুসলমান সম্পন্ন পরিবারের হাতে চলে গিয়েছিল। তার খুব কমই অবশ্য জবর-দখলি সূত্রে। বিক্রি-বাটা সূত্রেই বেশি। এ অঞ্চলে দাঙ্গা বা লুটের ঘটনা কোনোদিনই ঘটেনি। আতঙ্কটাই ছিল। জমি, বাড়ি ইত্যাদির দখলদারির পেছনে নানা কারণই ছিল। কিন্তু তার বিশদে না গিয়ে ভাবির মানসিকতার কথাই বলি। ভাবির সঙ্গে এ নিয়ে আমার প্রায়ই আলোচনা হতো। তিনি জানতেন যে নিঃশব্দে গ্রামগুলোর শূন্য হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে একটা গভীর বেদনার ব্যাপার। দেশ ভাগ এবং দাঙ্গা বা উচ্ছেদের আতঙ্ক অবশ্যই এই সব গ্রামগুলোর জনশূন্য হওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ।
কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। হিন্দুরা যেমন কথায় কথায় বলে যে মুসলমানেরা আমাদের দেশছাড়া করেছে, চৌদ্দ-পুরুষের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করেছে, ব্যাপারটা ঠিক তেমন একমাত্রিক নয়। এর পেছনে অন্য সুদীর্ঘ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণ আছে। যেসব অনেক পরে বুঝেছি। অনেক মানুষ এতকাল বাদে আজও যে বুঝেছে এমন নয়। ভাবি বা আমিও সেই সময় যে পরিষ্কার তা বুঝেছিলাম এমনও নয়। আমাদের কারোরই সেই শিক্ষা ছিল না।
কেউই তেমন করে সমস্যাটা আমাদের বোঝায়নি। তথাপি আমাদের দুজনেরই একটা আকাঙ্ক্ষার জগত্ তৈরি হয়েছিল যে গ্রামগুলো আবার আগের মতো সুবসতি-পূর্ণ, সুন্দর হয়ে উঠুক। ভাবির সঙ্গে এখানেই আমার মিল।
ভাবি বলতেন, ভাইডি, য্যারা য্যারা ছাড়া-ভিডা খায়, হ্যারগো লালস খালি দখলদারি নেবার। হেয়া যেভাবেই হউক। কিন্তু দখল করাইয়া হ্যারা করতেডা আছে কী? হেহানে বসত তো করে না। খালি বাগবাগিচার গাছপালা কাড্ইয়া কুড্ইয়া বেচে, যে যে বাড়িতে সুন্দার সুন্দার ঘরদুয়ারগুলা আছেলে, হেসব ভাইঙ্গা চুরইয়া কিছু লাগায় নিজেগো বাড়িথে বাকি বেয়াক বেচ্ইয়া খায়, পুহইর, নালাগুলান বুজাইয়া ধান চয়। য্যান ধান ছাড়া আর চাষের বস্তু নাই। বাগবাগিচার ব্যাফারডা বোজে না।
আমি বলেছিলাম, হেয়া না করলে তো ছাড়া-ভিডা ছাড়া-ভিডাই থাইক্যা যাইবে। বেকার নষ্ট অইবে। লাভ কিছু অইবে কি? বাগবাগিচা করার বুদ্দি আলাদা।
—খালি ধান ‘চইলে’ও তো লাভ অইবে না। জমি তো কোম হাসেল করলে না এ্যারা, ফলন কি তেমন বাড়ছে? আর খালি ধান অইলেই অইবে? গিরস্থালির লইগ্যা মাইনসের কত কিছু লাগে। হেয়ার হিসাব করবে কেডা? চাষাবাদ করতে তো পানিডার দরকারই আসল। হেয়ার লইগ্যা এ্যারগো চিন্তা কই? আসলে গিরস্থালির শিক্ষাডা দরকার।
ভাবি তাঁর মতো সমস্যা সমাধানের সূত্র বলতেন। সেসব তাঁর বাস্তব দেখে শেখা। নিজের পরিকল্পনা এবং সক্রিয় কাজের মাধ্যমে নয়া বাড়ির নির্মাণ করেছিলেন তিনি। তাঁর আশা, গোটা গ্রামে এমনটাই হোক। মুসলমানেরা, যাঁরা নতুন দখলদারি পেয়েছেন, তাঁরা নতুন নির্মাণে আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসুন, হিন্দু যাঁরা আছেন, তাঁরা সহযোগিতা করুন। তাহলেই গ্রাম আবার পরিপূর্ণ হবে। তিনি জানতেন, নয়া বাড়ির মতো বসত এককভাবে টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু যাঁরা দখলদারির নয়া মালিক হচ্ছিলেন, তাঁরা তাত্ক্ষণিক লাভের লালসেই মত্ত ছিলেন। নতুন গৃহস্থালির নির্মাণে তাঁদের আগ্রহ ছিল না। যারা তা করতে আগ্রহী ছিল তারা পুরুষানুক্রমেই প্রায় ভূমিহীন খেতমজুর। তাদের জমি, বাড়ি শাসনে রাখার ক্ষমতা বা সঙ্গতি কোনোটাই ছিল না। বুদ্ধিও না। ভাবি চাইতেন, তাদের বসত করিয়ে শূন্যতাটা ভরাট হোক। সে কারণে তাঁদের এই নয়া বাড়ির চৌহদ্দিতে অন্তত দুটি ভূমিহীন পরিবারের গৃহস্থালির পত্তন তিনি করিয়েছিলেন। তাতে পরিবারগতভাবে তাঁদেরও স্বার্থ ছিল, কিন্তু সে স্বার্থ কৃষি-গৃহস্থালীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। তাকে বাদ দেওয়া যায় না।
মনে আছে, একদিন কথা প্রসঙ্গে, পরে ভাবিকে বলেছিলাম, তোমরা যেভাবে ভূতের বাড়িডারে এট্টা বেহেস্তি বাগান বানাইছো, হে রহম মনমেজাজ, বুদ্দি হিন্দুগোও কিন্তু আর নাই। হ্যারাও ‘ব্যাচো আর খাও’ এই পথ ধরছে। আমরা বেয়াকেই বোধ হয় লক্ষ্মীছাড়া হওনের পথ ধরছি।
—কিন্তু হেয়ার পিছে হিন্দুগো নাঅয় এট্টা কারণ আছে। শ্যাহেরাও ওই পথ লইলে ক্যান? হ্যারা তো আর হিন্দুস্থান যাইবে না। এহানেই তো থাকপে, না কি? আসলে ওই যে শাস্তরে কয়, এক ভসেসা আর ছাড়, দোষগুণ কমু ক্যার—হেই কতাডাই হত্য।
—আরও এট্টা শাস্তর আছে, জানো না?
—কী?
—দ্যাহাদেহি শ্যাহা নাচে। হিন্দুগো ভালডুক হ্যারা নিউক বা না নিউক। খারাপ যা যা আছে হেয়ার সবটুকই নে। তোমারই খালি উল্ডা। তুমি অত বেজাতইয়াপনা কর ক্যান?
—মুই যে তোমার থিহা এট্টু বেশি দেখছি। এই সব ঘর-গিরস্থালি মুই যে কী সুন্দার দেখছি এককালে, হেয়া যে ভোলতে পারি না। হেয়ার কারণেই মুই ‘খাব্’ দেহি, ছাড়া-ভিডাগুলায় মাইনসের বসত হউক, শান্তিমতো খ্যাত-খামার, বাগবাগিচা বানাইয়া, ভরাভতি হইয়া, মিলইয়া মিশইয়া আহুক বেয়াকে। য্যারা চলইয়া গেছে হ্যারা তো আর ফেরবে না, তয় এসব জাগা-জমি, শুইন্য শ্মশান-গোরস্তানের ল্যাহান থাহে ক্যান? মানু তো দ্যাশে কোম নাই। শহর-গোঞ্জে দ্যাহো না।
কথাও সত্য। এখান থেকে তিন মাইল দূর গঞ্জে লোক থিকথিক করে। অথচ গ্রামের পর গ্রাম বিরান হয়ে যাচ্ছে, সেখানে মানুষ নেই। মানুষ নেই শুধু হিন্দুরা গ্রাম ছেড়ে হিন্দুস্তান চলে যাচ্ছে বলে নয়। সেই সঙ্গে উঠে যাচ্ছে স্কুল, পাঠশালা। খেলাধুলার মাঠ অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোথাও জবরদখল করে পাবলিক-ফিল্ডটাকেই ধানখেত করা হচ্ছে। এসব হচ্ছে, কারণ খেলাধুলা করার ছেলেরা যারা হিন্দু, তারা হিন্দুস্তানে যাচ্ছে। মুসলমান ছেলেরা, যারা মোটামুটি সম্পন্ন বা হিন্দুর ছেড়ে যাওয়া সম্পত্তিতে উঠতি পয়সাওলা, তারা গঞ্জে, শহরে চলে যাচ্ছে। কেউ পড়াশোনার জন্য, কেউ বা চাকরির খোঁজে। তা আগেও যেত। কিন্তু গ্রামের বাস তুলে দিয়ে নয়। মূল বসতটা গ্রামে থাকতই। এখন ক্রমশ তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক জীবনের বিনোদন গ্রামে কিছু নেই। সুতরাং আকর্ষণেরও কিছু নেই। ভাবি এই পরিবস্থা শুরু হওয়ার প্রাক্কালেই চেয়েছিলেন তাকে রুখতে। কিন্তু তা বোধহয় হওয়ার ছিল না। দেশজুড়ে অসম এবং অবিবেচনাপ্রসূত বিকাশ-ক্রম, সরকারি কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব, গ্রামের প্রতি শিক্ষিতজনের অবহেলা, শহর এবং গ্রামের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের অসদ্ভাব—সুতরাং গ্রামগুলো ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ অবস্থার মুখে এসে পড়েছিল। ভাবি তাঁর স্বাভাবিক সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাপারটার ভয়াবহতাটা বুঝতে পারছিলেন। সে কারণেই তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল, যদি অন্তত তাঁদের মতো গৃহস্থালি গড়ে মানুষ গ্রামটাকে ভরপুর রাখে। তাঁর সহজ হিসাব ছিল, মানুষ থাকলে সব শূন্যতা একদিন আবার ভরাট হবে। কিন্তু তখন পাকিস্তানি আদর্শে নতুন নির্মাণের পদ্ধতিটা ভিন্ন ছিল। সেই পদ্ধতিটার সঙ্গে আঞ্চলিক পরম্পরা বা শেকড়ের যোগ ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং কট্টর মৌলবাদী শিক্ষায় নতুন প্রজন্মকে গড়তে গিয়ে গ্রামীণ নতুন প্রজন্ম একসময় একঘেয়েমি কাটাতে শহরমুখী হয় বিকৃত ভোগবাদী হয়ে। গ্রামগুলো ধুঁকতে থাকে নিঃসঙ্গতার নৈরাশে।
দুই
নাজমার জন্ম এই নয়া বাড়িতেই হয়েছিল। ততদিনে বাড়িটাতে আরও বেশ কয়েকখানা ঘর উঠেছিল। বাড়ির চৌহদ্দিতে জায়গা-জমি অনেকটাই। বাকি ঘরের মানুষেরা ভাবিদের পুরোনো গ্রামেরই অতিদরিদ্র অবস্থার প্রায় ভূমিহীন মানুষ। ভাবিই তাদের ওখানে বসত করিয়ে নিজের গৃহস্থালি মজবুত এবং তাদেরও থাকার ও রুজি-রোজগারের উপায় করে দিয়েছিলেন। নাজমার যখন জন্ম তখন নয়া বাড়ির অবস্থা জমজমাট। হাসেম চাচা তখন নেই। জনুদা বাড়ির কর্তা। জমিজমা এদিকে-ওদিকে মোটামুটি ভালোই ব্যবস্থা করেছেন। অবশ্য এসবের পেছনে ভাবিরই বুদ্ধি, পরিকল্পনা এবং তাঁর মূল স্বপ্নই কার্যকরী ছিল। সে কথা জনুদাও স্বীকার করতেন এবং ভাবির পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ করতেন না। এই অবস্থায় পৌঁছাতে তাঁদের মাত্র বছর পাঁচেক সময় লেগেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এরকম আর একটিও গৃহস্থালির নির্মাণ গ্রামে হলো না। বরং হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমশ আরও ক্ষীণ হতে থাকল। দুটি কারণবশত এটা হতে পারছিল না। মুসলমানেরা হিন্দু গ্রামের কোনো শূন্যভিটায় বসত করুক এটা যেমন পড়ে থাকা হিন্দুরা চাইছিল না, তেমনই এ ব্যাপারে মুসলমানেরাও এগিয়ে এসে নতুন নির্মাণের জন্য উদ্যোগী হচ্ছিল না। তদুপরি তাদের মধ্যে কাজ করছিল একটা তাত্ক্ষণিক লোভ এবং প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাটা লুটের; কে কত ছাড়াভিটা দখল করবে।
নাজমার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন থেকেই তার আবদার যে সেও তার বড় ভাইদের মতো ‘ভাই’-এর কাছে পড়বে। ভাবির দেখাদেখি সেও আমাকে ভাই বলেই ডাকত। ভাবি একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ও ভাই হোনো তোমার আল্লাদইয়া মাইয়ার কতা হোনো।
—কী কয় হেই মা লক্ষ্মী? আমি জিজ্ঞেস করি।
—কয় হেও নাকি তোমার ধারে পড়বে। তো মুই কইলাম, না তুমি হ্যানে হেলে হ্যারে জ্বালাইয়া খাবা। তোমারে মুই-ই হ্যানে পড়াইতে পারমু, হেডুক এলেম মোর আছে। হেথে হে রাইগ্যা গেছে। কয়, তোর ধারে মুই পড়মু না। তুই শ্যাহের মাইয়া মানুষ, আলেহা, বোন্দা। বোজো কতা।
—কথাডা তো হে মিথ্যা কয় নায়।
—মুই আলেহা, বোন্দা?
—না-আ, তয় শ্যাহের মাইয়া মানুষ যে হেয়াথে কি ভুল আছে?
—হে নিজে কী? কাওনের ঘরের মাইয়া?
—হেয়া তুমি জানো। তোমার যা হিন্দুয়ানি আর হিন্দু পিরিত—
—তুমি থামবা, না তোমার দাদারে ডাকমু?
—সুবিদা অইবে না। জনুদায় নিজে তো আমার ‘জেডার’ পোলা, দশে জানে। হে আবার কী কইথে কী কইবে। ছ্যাক্ দেও, ও বরং আমার ধারেই পড়ুক। শ্যাহের মাইয়া মাইনষের ধারে পড়ইয়া হ্যার কাম নাই। আমার ধারে পড়লে মাইয়াডা ‘আওরতে হাসিনা’ অইবে। ভাবি বললেন, থাউক, হেয়ার লইগ্যা মুছুল্লি, মোল্লারা আছেন। হ্যারা সোমানে কানের মইদ্যে আয়াত-বয়াত আওড়াইতে আছেন। মুই চাই হে এট্টু শিক্ষা-দীক্ষা পাউক, আইজ-কাইলকার উপযুক্ত মানুষ অউক।
ভাবির সঙ্গে সম্পর্কটা আমার এমনই ছিল। স্বচ্ছ, খোলামেলা। কিন্তু আমরা গ্রামের নবায়নকল্পে যতই সহমত হয়ে তখনকার গ্রামীণ ‘চাঁদতারা’ ক্লাবের সভ্যদের নিয়ে, ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট অফিসারের নেতৃত্বে সভা-সমিতি করি না কেন, পরিস্থিতির জন্য বাধ্য হয়ে একসময় যখন দেশ ছাড়ি, ভাবি বড় আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আঘাতের পরিমাপ হয় না।
তারপর পঁচিশ বছর কেটে গেছে। ভাবির স্বপ্নের কথা কোনোদিনই আমি ভুলিনি। ভুলিনি বলেই পঁচিশ বছর পর আবার এলাম সেই গ্রামে। জানতাম ভাবির স্বপ্ন সফল হয়নি। পঁচিশ বছর যাতায়াত না থাকলেও, গ্রামের আরও শূন্য হয়ে যাওয়ার খবর জানতাম। ভাবিরা নয়া বাড়িতে সবাই এখন থাকেন না। দু-তিন গ্রাম দূরের অন্য একটা গ্রামে তাঁর ছোট ছেলের বৌ মমতাজ একটা গ্রামীণ হেলথ হোমে চাকরি করে; সেই গ্রামটাতে আমার শ্বশুরবাড়ি; তাদের কাছেই শুনেছিলাম। ভাবি বেশির ভাগ সেখানেই থাকেন। ছোট ছেলে, মানে জাহাঙ্গীর দেশে নেই। জনুদা বছর তিন-চার হলো মারা গেছেন। আলমগীর শুধু তার পরিবারসহ নয়াবাড়িতে থাকে কোনোরকমে। অর্থাত্ ভাবির স্বপ্ন স্বপ্নের মতোই মিলিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা যে কতটা তা ভাবির সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই বুঝলাম।
সরাসরি গ্রামে না গিয়ে শ্বশুরবাড়িতেই উঠেছিলাম। শুনলাম ভাবি মমতাজের কোয়ার্টারেই আছেন। আগের দিন রাতে এসেছি। ভেবেছিলাম পরদিন ভোরবেলাই যাব ভাবির সঙ্গে দেখা করতে। সকালে হলো না। শ্বশুরবাড়িতে ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকে না। তাঁদের নির্দেশমতো চলতে হয়। জাঁহাবাজ শালা এবং শালা-বৌয়েরা রয়েছেন। সবারই বক্তব্য, ‘যাইবেন হ্যানে। ব্যস্তের কী আছে?’ আমার ব্যস্ততাটা এঁদের বোঝানো মুশকিল। এঁরা কেউ পঁচিশ বছর আগের স্মৃতির ব্যাকুলতা বোঝে না। বোঝার কথাও নয়।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর উঠোনের প্রান্তের আমগাছটার নিচে একটা চেয়ারে বসে স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগের অজস্র স্মৃতিকণা মনের আনাচকানাচে, আমগাছটার বোলগুলোর আশপাশের মৌমাছিগুলোর গুনগুনানির মতো ভিড় করে একটা মগ্ন চেতনার মধ্যে যেন নিয়ে ফেলেছিল। শীতের শেষ, বসন্তের শুরু এখন। প্রকৃতি মানুষের অপরিমেয় ধ্বংসকে উপেক্ষা করে অনিবার্য জীবনীশক্তি নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।
মাঘ শেষে আমের মুকুলের এই টুপটাপ ঝরে পড়া উদাসী অপরাহ্নে স্মৃতির মেদুর বিষণ্নতা এবং বর্তমানের নবীন পত্রোদ্গমের অহেতুক আনন্দ যেন আমাকে এক গভীর দর্শনে আচ্ছন্ন করছিল। গ্রামগুলোর প্রাচীন অবস্থান থেকে বিচ্যুতি, তাদের নবায়ন অথবা বিকৃতায়ন এবং ধ্বংস ও নির্মাণের লীলা—এসব নিয়ে যখন ঘোর মগ্নতায় বিভোর, তখন একটি ফেরেশতাসদৃশ বালক কচিকণ্ঠে যেন পঁচিশ বছর আগের একটি মোহময় মূর্তি পরিগ্রহ করে আহ্বান জানাল, ‘দাদি আম্মায় আপনেরে বোলায়।’ ঘোর ভেঙে তাকিয়ে দেখি, পঁচিশ বছর আগের জাহাঙ্গীর আমার পাশে দাঁড়িয়ে।
‘তুমি কেডা?’ আমার ভাষা পঁচিশ বছর আগের আঞ্চলিক প্রাকৃতেই স্বাভাবিক গতি নেয়। এখানে শীলিত ভাষা বেমানান। এমনকি অশ্লীল মনে হয়। প্রাণে আরাম হয় না ভিন্ন ভাষার ছদ্ম বচন-বাচনে। এই ভাষা ছাড়া আর যে কিছুই নেই আমাদের।
—জে, মোর নাম মো. শাহজাদা তালুকদার।
—তুমি কার পোলা? থাহ কই?
—জে, মোর আব্বাজানের নাম জনাব জাহাঙ্গীর তালুকদার। মোগো আসল বাড়ি নয়া বাড়ি, কেওরা গেরামে। এহন থাহি এহানের হেলথ সেন্টারের কোয়াটারে।
—তোমার আব্বা-জনাব এহন কোথায়?
—জে, হে তো মালয়েশিয়ায় চাকরি করে। বছরে একবার আয়। শিগগির করইয়া লয়েন, দাদি আম্মায় জলদি যাইতে কইয়া দেছেন।
শাহজাদা সত্যিই শাহজাদা। ঠিক যে বয়সটাতে আমি জাহাঙ্গীরকে দেখে গিয়েছিলাম, ওর এখন সেই বয়স। ওর পরিচয় জিজ্ঞেস না করেও চিনে নিতে আমার অসুবিধা হতো না। একদমই জাহাঙ্গীরের মুখটা বসানো। ভাবি সেই সময় দেখতে অসামান্য ছিলেন। তাঁরই আদলে জাহাঙ্গীর এবং জাহাঙ্গীরের আদলে এই শাজহাদা। রগড় করে জিজ্ঞেস করলাম, মুই কেডা, চেনো?
—জে না।
—মুই তোর একজন দাদা। দাদি কয়নায় তোরে?
—জে না। খালি কইলেন, হিন্দুস্তান থিহা ওই বাড়িথে যে আইছে, হেনারে ডাইক্যা লইয়ায়। আপনে কেডা?
—মুই তোর একজন হারাইয়া যাওয়া দাদা, বোজলেননি জনাব শাহজাহান বাদশা? আমি একটু নাতির সঙ্গে রগড় করি।
—জে, মোর নাম শাহজাহান না, শাহজাদা।
—শাহজাহানও হ্যার ছোডোকালে শাহজাদাই আছেলে।
শাহজাদা আমার কথাটা বুঝতে পেরে একটু লজ্জা পেল। বলল, লয়েন, দাদি হ্যানে উতলা অইবে। বুড়া মানুষ তো।
বুড়া মানুষ! ভাবি বুড়া? আবার একটা ধাক্কা। এবং সেটা পূর্ণ হয় যখন তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াই তখন। একটা খাটে ময়লা একটা কাঁথা জড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন বসে।
গিয়ে হিন্দু প্রথায় প্রণাম করতে মাথাটা বুকে নিয়ে, সে যে কী আকুল কান্না! বাসার অন্যরা কেউ আমাকে চেনে না। এক শাহজাদার সঙ্গে সবে আলাপ হয়েছে। কেউ কিছু বুঝতে পারছিল না। আমার সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। অনেক কথা বলার ছিল। কিছুই বলতে পারছিলাম না। ভাবিরও তা-ই।
ভাবিই প্রথম কথা বললেন, খাব পুরা অইলে না ভাই। গেরাম তো গেলেই, নয়া বাড়িডাও আবার ভূতের বাড়ি অইয়া গেলে। জিজ্ঞেস করলাম, মাইয়াডা কই? হে আছে কেমন?
—ওই এট্টা সুখ। মাইয়াডা আছে ভালো। বিএ পাস করইয়া চাকরি করে। মাস্টেরি। হ্যার সোয়ামিও মাস্টের। আর হেও মায়ের খাবের মইদ্যেই য্যান আছে। হ্যারা দুইজোনেই হ্যারগো গেরামের লইগ্যা নানান কাম লইয়া ব্যস্ত। আইথে সোমায় পায় না, তয় আছে ভালোই।
—কোন গেরামে বিয়া দিলা?
—শায়েস্তাবাদ। নিজের পছন্দের বিয়া। গেরামের কাম করতে যাইয়াই আলাপ।
—ভালোই তো। এইডা তো এট্টা লাখ টাহার খোশ্ খবর। না কি কও? তাইলে আর তোমার দুঃখ কী? অরা হয়তো পারবে অনেক নয়া বাড়ি বানাইতে।
—হ। বাড়ি যাবা না ভাই?
—গিয়া কী দেখমু?
—দ্যাখফা নয়া বাড়িডা আবার দাশের বাড়ি অইয়া ভূতের বাড়িই অইয়া গেছে। মুই তো এহন আর ওহানে টেকথে পারি না। আলমগীর হ্যার বৌ-পোলাপান লইয়া কোনোরহমে আছে বলইয়াই যাই মাজে মাজে। নাইলে পেরান টেহে না।
—এরহম অইলে ক্যান?
—মানুষ নাই। গেরাম শূইন্য। রোজ রাইতেই ড াহাতি, চুরি আর গুতাগাতা খাইয়া য্যারগো বওয়াইছিলাম, হ্যারাও ইদিক ওইদিক গ্যালে গিয়া। মুইও পারলাম না আর। লও, কাইল বেয়ানে যাই দুইজোনে। দেইখ্যা এট্টু কান্দইয়া আই দুইজোনে।
বললাম, না ভাবি। মনের মইধ্যে যে ছবিডা রইয়া গেছে, হেডা আর নষ্ট করমু না। ওইডুক থাউক। হেয়া ছাড়া নাজমারা তো নতুন করইয়া চেষ্টা করতে আছে। লও, কাইল অইবে না, পরশু হ্যারগো আর হ্যারগো কাম-কাজ দেইখ্যা আই। হয়তো এট্টু জোশ পামু হ্যানে। যা শ্যাষ হওনের হেয়া শ্যাষ অইবেই। লও, নতুনডা দেহি যাইয়া। ভূত দেইখ্যা কী অইবে?
—হেইয়াই ভালো। লও দুইজোনের পেরানেই আরাম অইবে হ্যানে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১২, ২০১০
Leave a Reply