হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের খোঁজে
নারী, সৃষ্টি ও বিজ্ঞান—পূরবী বসু \ নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা \ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ \ ২৪০ টাকা
কথাশিল্পী যখন ‘এমনিওটিক ফ্লুইড’ বিশ্লেষণের কথা শোনান, জানান গর্ভথলির পানীয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে কেমন করে অনাগত সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় এবং কী তার সামাজিক ও জনমিতিক প্রভাব, সাধারণ পাঠক তা-ও অবলীলায় পড়ে যেতে পারেন, আত্মস্থ করতে পারেন এবং নিজের ভেতরের সংস্কারককে জাগিয়ে তুলতে পারেন।
পূরবী বসু তত্ত্ব ও তথ্যবহুল গবেষণার দুর্ভর বোঝা পাঠকের ঘাড়ে তুলে দেননি—সহজ কথায় কঠিন বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করেছেন।
এমনিওটিক ফ্লুইড বিশ্লেষণের ফল ২০০৬ সালের ইউএনএফপিএ প্রতিবেদন অনুযায়ী কেবল ভারতেই এক কোটি মেয়েশিশুর ভ্রূণ হত্যা করা হয়েছে। গর্ভথলির তরল পরীক্ষা করে মেয়েশিশু নিধন চলছে চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশে। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ কোটি মেয়ে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মুখ দেখতে পারেনি। এই একটি মানদণ্ডই নারীর অবস্থা বোঝাতে সক্ষম। নিরাপত্তাহীনতা এবং অনড় পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি
এমনকি নারীকেও নারীবিমুখ করে তোলে। অনাগত সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ায় নারীরও প্রথম পছন্দ পুত্র। কিন্তু সামাজিক নির্মমতা ও অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত পুরুষ ও নারীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। দেড় হাজার বছর আগে আরবের অন্ধকার যুগে মেয়েশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়া আর সভ্যতার চরম উত্কর্ষের যুগে প্রাক-ভূমিষ্ঠ সন্তানের লিঙ্গ নিশ্চয়নের মাধ্যমে মেয়েভ্রূণ হত্যা করার মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। এসব নিরুদ্দিষ্ট মেয়ে ও আগামী দিনের জনমিতিক সংকট নিয়ে লিখেছেন ‘হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের খোঁজে’ নামের প্রবন্ধটি।
এ ধরনের ২২টি নিবন্ধ নিয়ে পূরবী বসুর নারী, সৃষ্টি ও বিজ্ঞান। অনেক দিন আগে দেখা একটি
কার্টুন মনে পড়ছে। গোঁফওয়ালা দশাসই একজন পেয়াদা বিবস্ত্র একজন নারীকে টেনেহিঁচড়ে এজলাসে নিয়ে এল।
বিচারকের আসনে হাতুড়ি হাতে নিস্পৃহ বিচারক। পেয়াদা বলল, ‘মাই লর্ড, দ্য লেডি হ্যাজ জাস্ট ডেলিভার্ড এ ন্যাকেড বেবি—মহামান্য আদালত, এই নারী এইমাত্র একটি নেংটা শিশু প্রসব করেছে।’
নেংটা শিশু প্রসব! এটাও তো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। নারীকে নিয়ে যেসব সমাজসৃষ্ট বৈষম্য বিরাজ করছে, নারীর ‘অপরাধ’ বাড়াতে পারলে বৈষম্যের স্থিতাবস্থা বজায় রাখা সহজ হয়ে ওঠে।
পূরবী বসুর নিবন্ধগুলো এর আগে নারীর কথা শিরোনামে যখন প্রকাশিত হয়েছে, তা বোদ্ধা
পাঠকের দৃষ্টিতে পড়েছে। নিবন্ধগুলোর মধ্যে
রয়েছে—রজঃস্বলা নারী, নারীদেহে অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক অস্ত্রোপচার, গর্ভপাত: নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, আরও
কয়েকটি পিল, একুশ শতকে
নারী ভাবনা, সৃষ্টির রহস্য
নারী ও পুরুষ, নোবেলবিজয়ী
নারী।
তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, কলঙ্ক কি কেবল নারীরই বিষয়? যৌন কেলেঙ্কারিকে আমরা বলছি
নারী কেলেঙ্কারি—ভাষা
ব্যবহারে যে সেক্সিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি জীবনাচরণেও তা অভিন্ন থেকে যায়। যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক পাঠক বইটিকে পছন্দ করবেনই। পূরবী বসু ধন্যবাদ পেতে পারেন।
এম এ মোমেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১২, ২০১০
Leave a Reply