‘ভাই, আমি কি আপনার নামটি জানতে পারি? আপনাকে কেন জানি চেনা-চেনা লাগছে। না মানে, সমস্যা থাকলে দরকার নেই। জাস্ট কিউরিসিটি।’
‘আসল নাম তো বলা যাবে না। নকল নাম—হিট খাইছি ৪১০। পরিষ্কার শুদ্ধ উচ্চারণে বললে হিট খেয়েছি ৪১০।’
‘জি!’
‘কিছুই বোধহয় বুঝতে পারছেন না, তাই না?’
‘আসলে এমন নাম হয় কিনা…এই প্রথম শুনেছি…আমার বোকামির জন্য মাফ চাইছি। যদি খোলাসা করতেন!’
‘ঠিক আছে খোলাসা করছি। আমি একজন ব্লগ রাইটার। ব্লগ রাইটারদের কখনো আসল নামে লিখতে নেই। তাদের সব সময় নকল নামে লিখতে হয়। ব্লগে আপনি যা ইচ্ছা লিখবেন, আসল নামে লিখলে কি চলে?’
‘ও আচ্ছা।’
‘ও আচ্ছা বলবেন না। দুনিয়াটা ও আচ্ছার দুনিয়া না। দুনিয়াটা হচ্ছে নকলের দুনিয়া। পাবলো পিকাসোর কথাটি শোনেননি? খারাপ শিল্পীরা নকল করে, ভালো শিল্পীরা চুরি করে। ব্লগকর্মী হিসেবে আমি হয়তো এখনো কিছুটা ভালনারেবল পর্যায়ে আছি। তাই শুধু নিজের নামটাই নকল করছি। যখন আরও একটু শক্ত পর্যায়ে চলে যাব, চুরি শুরু করব। পিকাসোর কথা অনুযায়ী ভালো শিল্পীদের চুরির লক্ষণগুলো তখন আমার মধ্যে প্রকাশ পেতে থাকবে। যা হোক, আমার বন্ধু বাজিদ বোহেমিয়ানকে চেনেন তো?’
‘সরি। বাজিদ কোন মিয়ানের কথা বললেন? আমি সত্যিই দুঃখিত তাকে একটু চিনতে…।’
‘বাজিদ বোহেমিয়ান।’
‘জি, বাজিদ বোহেমিয়ান!’
‘চেনেন না, তাই তো? গত দুবার একুশে বইমেলার সে ছিল বেস্টসেলার! বেস্টসেলার অর্থ বোঝেন? যার বই দিনে লাখ কপি সেল হয়। কথায় কথায় আমরা যাকে ‘হটকেক’ বলি। অ্যানিওয়ে, বাজিদের সর্বাধিক বিক্রীত পাঁচটি বইয়ের নাম বলতে পারবেন?’
‘সরি। আমি আসলেই ওনাকে চিনি না…আমাকে মাফ করবেন।’
‘ঠিক আছে, মাফ করলাম। তার পাঁচটি বইয়ের নাম আমি বলছি। আপনি হাতে গুনতে থাকুন: ১. এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর; ২. আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে; ৩. তোমার শঙ্খ ধুলায় প’ড়ে; ৪. আমি কান পেতে রই…’
‘জনাব, আপনি থামুন।’
‘থামব? কেন বলুন তো?’
‘আমি বোধহয় বুঝতে পেরেছি।’
‘কী বুঝতে পেরেছেন?’
‘মানে…আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পেরেছি। আপনি বলতে চাচ্ছেন, উনি রবীন্দ্রনাথ থেকে ধার করে চালাচ্ছেন। আমি কি এটা ঠিক বলেছি?’
‘আপনার তো বিরাট জ্ঞান ভাই! জ্ঞানের দিক দিয়ে আপনি সাহিত্য-সমালোচকদের পর্যায়ে।’
‘কিন্তু ওই সম্পর্কে আপনার দুটো কথাও আছে।’
‘জানি আপনি কী বলবেন। উলসন মিজনারের কথাটি বলবেন তো যে, একটা থেকে কপি করা চৌর্যবৃত্তি, দুটো থেকে কপি করা রিসার্চ। যা হোক, আপনাকে একটা কথা বলি। এই জায়গায়, ইতোমধ্যে আমি কিন্তু একটা চুরি করে ফেলেছি। আমার চুরিটি কী, আপনি ধরতে পেরেছেন?’
‘আপনি আবার চুরি করলেন কবে?’
‘ধরতে পারেননি?’
‘জি না।’
‘তা-ই হয়। আপনারা যারা অধিক সচেতন, আপনাদের গুবলে খাওয়া আমাদের কাছে টু-ফোর ব্যাপার মাত্র। জাস্ট ২-৪ মাত্র।’
‘টু-ফোরটা বুঝলাম না। ওয়ান-টু শুনেছি, টু-ফোর শুনিনি।’
‘ঠিক আছে বলছি। আচ্ছা খেয়াল করুন তো আমি দুইয়ের পর তিন সংখ্যাটি বলেছি, নাকি চারে চলে গেছি? দেখেছেন কথায় কথায় একটা সংখ্যা চুরি করে ফেললাম! আচ্ছা পিথাগোরাসের সংখ্যাতত্ত্বটি কি আপনার জানা আছে? না থাকলে আজ থাক। অন্যদিন এটা নিয়ে কথা বলব। যা হোক, আমরা আগের কথায় ফিরে যাই। হিট খাইছি ৪১০ সম্পর্কে জানতে চাইছেন তো? বলছি। আমি তখন কবি জসীমউদ্দীন হলে থাকি। রুম নম্বর ৪১০। আয়রন মেশিনে একদিন কাপড় আয়রন করতে গিয়ে হাতে ছেঁকা খেয়েছিলাম। সেইদিনই নামটা সিলেক্ট করেছি ‘হিট খাইছি ৪১০’। তারপর গাউসুল আজম মার্কেটের সাইবার ক্যাফে গিয়ে ওই নামে একটা আইডি খুলেছি। এই জাতীয় আইডি অবশ্য আমার একটা নয়, আরও আছে। আমার যেমন অনেকগুলো মোবাইল সিম, ঠিক তেমনি ব্লগে ব্যবহারকারী অনেকগুলো নামও। শুনবেন? আচ্ছা বলছি। ১. নুনুর আছে ঘড়ি। প্লিজ বাজে অর্থে নেবেন না। নুনু আমার ডাক নাম; ২. ওটা আমার কাটা রাইফেল। ‘ওটা’ মানে বুঝছেন তো, মানে ওটা আমার প্রিয় কলম)।
‘তা নয় বুঝলাম। কিন্তু ব্লগে আপনি কী কী লেখেন? মানে আপনার বিষয় কী থাকে?’
‘দেশ নিয়ে লিখি ভাই! দেশ ভেসে গেল রসাতলে! গেল গেল, সব গেল! এসব নিয়ে লিখি। আসলে আমাকে তো আর টক শো-তে ডাকে না, কিন্তু আমার ভেতরও হাজারো ‘টক’ গিজগিজ করে। কী করবো বলুন? তখন ব্লগের টক টপিকে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’
‘আচ্ছা।’
‘আবারও আচ্ছা বললেন? আচ্ছা বলবেন না। এটা আচ্ছা বলার দুনিয়া নয়। টক-ই হচ্ছে দুনিয়ার আসল জিনিস। টক না থাকলে মানুষ বাঁচবে না। ম্যাথু হরিজ কী বলেছেন জানেন? বলেছেন, কথা না বলতে পারলে মানবকুল বৃক্ষ হয়ে যেত। বুঝতে পেরেছেন?’
‘তা বুঝতে পেরেছি।’
‘কি বললেন? বুঝতে পেরেছেন? আশ্চর্য, বুঝতে পারলেন কী করে? আমি তো কথাটা বানিয়ে বললাম! ম্যাথু হরিজ নামে আসলে কেউ নেই। এইমাত্র আমি বানিয়ে নামটি এবং তার নামে কথাটি ব্যবহার করলাম। আপনি বুঝতে পারলেন কী করে? তা-ই হয়। আমি অনেকগুলো সত্যের মধ্যে কিছু মিথ্যা এমনভাবে মিলিয়ে দিই, যাতে কেউ ধরতে না পারে। দুনিয়াটাই সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ। গুরুচণ্ডালি দোষের মতো সত্য-মিথ্যার দূষণে দূষিত।’
‘ও।’
‘যা হোক, আপনাকে একটা ধাঁধা বলি। আপনার আইকিউ চেক করে দেখি। উত্তর দিতে হবে কুড়ি সেকেন্ডের ভেতর। না পারলে নকআউট। পারবেন তো?’
‘দেখি। পারব বলেই তো মনে হয়। বিসিএস দিয়ে যেহেতু টিকেছি…দেখি।’
‘গুড। ভেরি গুড। তাহলে বলি। মনে করেন আপনি একটা বাস কাউন্টারে টিকিটের জন্য লাইন দিয়েছেন। ধরলাম বাসের নাম বন্ধন। জিপিওর মোড়ে কাউন্টার। আপনি যাবেন নারায়ণগঞ্জ। লাইনে আপনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন, আপনার অবস্থানটি হচ্ছে প্রথম থেকে ১৭ এবং শেষ থেকে সাত। এখন বলতে হবে, কুড়ি সেকেন্ডের ভেতরে, আপনার অবস্থানটি আসলে কোন পর্যায়ে; অর্থাত্ আপনি লাইনের কততম ব্যক্তি?’
‘ভাই তো চিন্তায় ফেলে দিলেন।’
‘চিন্তা করেই বলুন। চেষ্টা করুন। আমি কাউন্টডাউনে চলে যাচ্ছি—ষোল…সতের…আঠারো…কুড়ি। সরি, আমি আবারও একটা সংখ্যা বাদ দিয়েছি। উনিশ সংখ্যাটি।’
‘সরি ভাই, পারলাম না!’
‘আমি জানতাম আপনি পারবেন না। যা হোক। ব্লগে কী লিখি জানতে চাইলেন না? এই জাতীয় ধাঁধাও মাঝেমধ্যে ব্লগ রাইটারদের লিখতে হয়। কারণ তাদের কাজ হচ্ছে তাদের জগাখিচুড়ি লেখাটার প্রতি পাঠকদের মনোযোগ ধরে রাখা। পাঠক আকৃষ্ট করাই তাদের প্রথম কাজ।’
‘ভাই আপনার হাতটা একুট দেবেন? যদি মাইন্ড না করেন।’
‘হ্যান্ডশেক করবেন? তার মানে আপনি আমার সঙ্গে পরিচিত হতে চান? ঠিক আছে বলুন। পরিচয়পর্বটা জানার পর্ব দিয়েই শুরু হোক। আগে আপনার কথাই বলুন।’
‘আমি সাহিত্যের শিক্ষক। এই তো। বাংলা পড়াই।’
‘গুড। আপনার বাবা কী করেন?’
‘কী আর করবেন? বয়স হয়েছে। ওই আর কি…কিছু একটা করে খাওয়া। বলার মতো কিছুই করেন না।’
‘এমন নমিত মুখ করেছেন কেন? ওই আর কি মানে কী? আপনার বাবা কি কৃষিকাজ করেন? কৃষিকাজ কি খুব ঘেন্না করার মতো কোনো কাজ? স্যার আইজ্যাক নিউটনের পিতাও কৃষক ছিলেন। বাদ দেন, কফিটি কেমন লাগছে বলুন? এটা ব্রাজিলিয়ান বিনস কফি। কফি মেশিনে করতে হয়।’
‘খেতে খুব ভালো লেগেছে।’
‘গুড।’
‘আরেকটা খাব নাকি ভাবছি…।’
‘অবশ্যই। হায় হায়! কারেন্ট যে চলে গেল! ব্ল্যাকআউট হয়ে গেল! আপনার কপালটাই বোধহয় খারাপ।’
‘সমস্যা নেই। ঠিক আছে। ঠিক আছে আপনার ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই।’
‘সমস্যা নেই বলেছেন? ঠিক আছে, কফি খাওয়ার বিষয়টা তাহলে ভুলে যাওয়া যাক। অন্য বিষয়ে কথা বলি, কি বলেন?’
‘আমি একটা বিষয় জানতে চাই। সবকিছুর নাকি একটা অ্যাডভান্টেজ থাকে; এই যে লোডশেডিং, এটার কোনো অ্যাডভান্টেজ আছে?’
‘লোডশেডিঙের অ্যাডভান্টেজ আছে কি না জানি না। তবে আমার বন্ধু বাজিদ বোহেমিয়ান আমাকে একটা গল্প বলেছিল। তার গল্প শুনে মনে হয় কিছুটা হলেও আছে। গল্পটি বলি। প্রভু বিশাল মসনদে বসে পাপী-তাপীর বিচার করলেন। বিচারে যারা পুণ্যবান তাদের জন্য স্বর্গ আর যারা পাপী তাদের জন্য নরকের শাস্তিভোগ নির্ধারিত হলো। নরকবাসীর জন্য নির্ধারিত শাস্তির নাম ইলেকট্রিক শক। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর অবশ্যই ইলেট্রিক শক নিয়ে পাপীদের পাপ মোচন করতে হবে। পাপ মোচন করলেই স্বর্গের টিকিট মিলবে। প্রভুর পক্ষ থেকে একটা বিশাল অফার। যা হোক, ইলেকট্রিক শক নেওয়া যাবে দুই কায়দায়। প্রভু বিশেষ সদয় হয়ে নরকবাসীর জন্য অপশনের ব্যবস্থাও করলেন—আমেরিকান ইলেকট্রিক শক, বাংলাদেশি ইলেকট্রিক শক। দুই অপশনের জন্য দুটি আলাদা রুম করা হয়েছে। রুমের সামনে দারোয়ান রাখা হয়েছে। পাপীকে গিয়ে বলতে হবে তিনি কোন কায়দায় শক নেবেন।
ম্যাথু হরিজ আমেরিকান নাগরিক। বিচারে রায় হয়েছে, সে হবে নরকবাসী। সুতরাং তাকে স্বর্গবাসী হওয়ার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর ইলেকট্রিক শক নিয়ে পাপ মোচন করতে হবে। যেহেতু আমেরিকান কায়দা উন্নত এবং প্রাঞ্জল—সে ভাবল, ওই কায়দাতেই ইলেকট্রিক শক নেবে। আর বাংলাদেশি কায়দায় শক নিতে গেলে দেখা যাবে, হয়তো শক দিতে গিয়ে মেরেই ফেলেছে। যা অব্যবস্থাপনা! কিন্তু হায়! ম্যাথু হরিজ আমেরিকান কায়দায় শক নিতে গিয়ে দেখল, লাইনে ও ছাড়া আর একটি প্রাণীও নেই। সে কিছুটা ভড়কে গেল। থতোমতো খেয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, সবাই গেল কই, বলবেন? দারোয়ান ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিল পাশের দরজাটি। দেখা গেল, পাশের দরজায় বিশাল একটা কিউ। পাপী-তাপী সবাই ওখানেই ভিড় করছে।
‘দয়া করে কি বলবেন, সবাই আমেরিকানদের উন্নত কায়দা ফেলে ওই বস্তাপচা বাংলাদেশি কায়দায় কেন?’
একটাও পাপী ধরতে না পেরে বিষণ্ন-মনে দারোয়ান বলল, ‘ওটাই তো শ্রেয়।’
‘মানে?
‘বাংলাদেশে তো চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর চব্বিশ ঘণ্টাই লোডশেডিং থাকে। এক মিনিটও শক না নিয়ে পাপ মোচনের এমন সুযোগ কে হাতছাড়া করবে বলুন?’
হিট খাইছি ৪১০-এর সামনে বসে যিনি এত কফি খাচ্ছিলেন তার বোধহয় কিছুটা আক্কেলগুড়ুম হয়েছে। তিনি বোকার মতো হিট খাইছি ৪১০-এর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হয়তো ভাবলেন, লোকটা আসলেই বিরাট জ্ঞানি। হয়তো আরও ভাবলেন, ভাগ্যিস বৃষ্টি পড়ছিল, তিনি অগত্যা কোনো জায়গা না পেয়ে এই কফি শপে সময় কাটাতে ঢুকেছিলেন এবং লোকটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৫, ২০১০
কাল্পনিক চরিত্র
চমৎকার!