শুদ্ধ বিমূর্ততা যে এ দেশে মৃততুল্য ধারায় পরিণত, সে বিষয়ে অবগত না থেকে পারা যায় না। তবে রশীদ আমিনের সাম্প্রতিক এচিং প্রদর্শনীতে চোখ রেখে দাবি করা চলে, বিশুদ্ধতা ত্যাগ করে নির্বস্তুকতার মধ্যে বস্তুগতের চিহ্ন তুলে এনে এ-ভাষার প্রাণ কিছুটা হলেও ধরে রাখা সম্ভব। ১৯৬৬ সালে জন্ম শিল্পীর; কাজে প্রাকৃত ভাব বর্তমান। লতাগুল্মময় তরুময় প্রকৃতির চেয়ে খড়বিচালি বা মাটির এসেন্স তুলে ধরার হিম্মতই প্রধান হয়ে ধরা দেয়, এই শিল্পীর কাজে।
দুই দশক ধরে এমন এক চিত্রধারার সঙ্গে নিজেকে তিনি জড়িয়েছেন, যা সৌন্দর্যজ্ঞানের সূত্রে কিছুটা হলেও ভিন্নমাত্রার। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিমূর্ততা চর্চায় যে সাজানো-গোছানো, ড্রয়িংরুম-উপযোগী সৌন্দর্যবোধের বিস্তার, তার বিপরীতে আমিনের চিত্রকল্প যথেষ্টই ইনফরমাল—সাদামাটা ও টেকনিকের কারিকুরি-বিরোধী। প্রাথমিকতার ছাপ এই শিল্পী রং, রেখা, ব্রাশের পোচের মধ্য দিয়ে চক্ষুষ্মান করে তোলেন। এই আয়োজনে আমিন যথেষ্ট দেশজও বটে; কারণ তিনি যে মেদুর দৃষ্টি ও মৃন্ময়তা হাজির করেন, তা তিনি খরা-বন্যা-বৃষ্টি-অতিবৃষ্টি আক্রান্ত বঙ্গদেশের সূত্রে লাভ করেছেন বলে মনে হয়।
ফলে তাঁর চিত্র, যা মূলত ধাতুতক্ষণ বা এচিং মাধ্যম ব্যবহার করে সৃষ্ট—সিনথেটিক পরীক্ষামূলক বা অমূলক আয়োজন নয়। এটি বাস্তব জীবনের স্বরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আরেক ভিন্ন বাস্তবতা।
অপর দিকে, বর্তমানের বেশ কিছু চিত্রকল্পে আধো-আকৃতির মানুষের অনুপ্রবেশ দেখা যায়। এ সূত্রেও শিল্পী বিশুদ্ধতা (বিমূর্ত ভাষার) বিতারণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। অর্থাত্ অন্তরাত্মার খোদ অঞ্চলে পৌঁছানোর নামে শিল্পীরা যে সিনথেটিক ফর্ম-নির্দিষ্ট চিত্রকল্প গড়েন এবং সেই সূত্রে বাস্তবকে অতিক্রম করতে সক্ষম হন বলে তৃপ্তি পান—এমন আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে শিল্পী নিজেকে রেহাই দিয়েছেন। আমিন অভিজ্ঞতালব্ধ দুনিয়ার অনুকৃতি নির্মাণ না করলেও তিনি যে শিল্পজ অভিজ্ঞতার জন্ম দিচ্ছেন, তা দুনিয়াদারির সূত্রে জায়মান। বলা চলে এটি অ্যাসথেটিক দুনিয়াদারির নমুনাবিশেষ, যাতে ভিন্ন দুনিয়ার ইশারা রয়েছে।
গত এক দশকের কাজ বিচার করলে স্থির করা যায়, এই শিল্পীর প্রাকৃত ল্যান্ডস্কেপ-ধর্মী ইমেজগুলো খোলামেলা হয়ে উঠছে। আগে যে রং এবং টেক্সচারে পর্দার কারণে রেখা ও অন্য উপাদানগুলো অস্পষ্ট হয়ে দর্শকের চোখে ধরা দিত, তা ক্রমে স্পষ্টতা পাচ্ছে। ‘ক্লাউড-১’ বা ‘কান্ট্রি অব গ্রিন ক্লাউড-১’ চিত্রদ্বয়ে দিগন্তরেখাহীন দিগন্তের বিস্তারই সামান্য আয়োজনে যেন ধরা দিয়েছে। দ্বিতীয়োক্ত চিত্রকল্পে খড়ের গাদাসুলভ স্তূপ, আকাশে ধূসর ছোপ ও নীল রেখার আঁকিবুঁকি ও রেখার চাঞ্চল্যতায় মানবমূর্তির ছায়া—সবই অভিজ্ঞতার স্মারক। ফলে সিনথেটিক সৌন্দর্যের চেয়ে উপলব্ধিগত সৌন্দর্য প্রাধান্য পেয়েছে বলে ধারণা হয়।
উল্লেখ নিষ্প্রোয়জন, তবু শিল্পীর নিজ সূত্রে বলা যায় যে কান্দিনিস্কির বিমূর্ততার উষালগ্নের অ্যাসথেটিক ক্ষণ নির্মাণের ইতিহাস এই শিল্পীর প্রাথমিক খোরাক। ‘কান্ট্রি অব গ্রিন ক্লাউড-২’ শিরোনামের কম্পোজিশনে এই চিত্র সবচেয়ে বোধগম্য।
সুডৌল ফর্মের প্রতি এই শিল্পীর পক্ষপাত দেখা যায় না। অর্থাত্ বিমূর্ততার (কান্দিনিস্কীয়) আবেগময় ভাষাই তিনি শ্রেয়তর বলে মান্য করেন। ফলে সুন্দর বা অসুন্দর নির্ধারণে পেলব ফর্ম বা টেক্সচার আমিন গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। তিনি যিকঞ্চিত্ নয়েজ বা আওয়াজের পক্ষের লোক। ফলে তাঁর কাজে রাফনেসের সূত্রে একধরনের মর্মগাঁথা প্রকাশিত হয়, যাকে বা নীরব উল্লাস নামে ডাকা যায়। বলাবাহুল্য, এই প্রকারের নীরবতার অধ্যায় তুলে ধরতে প্রবীণশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া সিদ্ধহস্ত, তবু আমিনে এর প্রাকৃত স্বরটি পাওয়া যায়।
অন্তর্দৃষ্টিই শিল্পীর চিত্রজ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সহায়ক উপাদান—এই উপলব্ধি আমিনে বর্তমান আছে। শুধু বাজিয়ে দেখা জরুরি যে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক চেতনার সেতু কিংবা আত্মন্তিক বার্তা ও আদ্যকথার মেলবন্ধন—এ সত্যে শিল্পী কতটুকু আলো ফেলতে পারলেন।
প্রায় অনির্দিষ্ট ও অনির্দেশ্য এই এলাকায় অনুপ্রয়োগের পথ যে এ শিল্পী খুঁজছেন, তার চিহ্ন আছে ‘ওয়ামেন অ্যান্ড দ্য গার্ডেন’ চিত্রে। হয়তো এমন চৈতন্যের খোঁজই শিল্পীর ‘ম্যান অ্যান্ড নেচার’ চিত্রকল্পটিকে কিছুটা হলেও আনসেটলিং ইমেজে পরিণত করেছে। এ-জাতীয় ড্রামা (হোক তা মানবীয় বা অতিমানবীয়) সাধারণ বিমূর্ততাপন্থীরা এড়িয়ে চলেন। আমিন তাঁর সাম্প্রতিক প্রদর্শনীটিতে এর ব্যতিক্রম ঘটাতে উদ্যোগী। হয়তো তাঁর চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথের আনসেটলিং ইমেজগুলো প্রেরণা জোগাবে।
ঢাকার শিল্পাঙ্গনে আয়োজিত ‘রিসেন্ট প্রিন্ট’ প্রদর্শনীটি আজ শেষ হচ্ছে।
মোস্তফা জামান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৫, ২০১০
Leave a Reply