নিতান্ত কৌতূহলবশত সেদিন ওয়েব-রাজ্যে একটি খবরে আমার নজর পড়ে। খবরটা বেদনাদায়ক, কিন্তু অবাক করার মতো কিছু নয়। ক্যামেরুনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ফুরুবানার অধিবাসী এক মহিলা বিকিয়া ভাষায় কথা বলেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এ ভাষাটি জানেন। তাঁর ভাষিক নিঃসঙ্গতার কথা ভাবলে আমরা বিষণ্ন না হয়ে পারি না। এই মহিলার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এ ভাষাটি। একটি ভাষা গড়ে উঠতে কত সহস্র বছর লাগে। কত সব সৃষ্টিশীল মনের অবদানের যোগফল যে ভাষা, তা মাত্র একদিনেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে!
মার্টিন হাইডেগার, একালের দার্শনিকদের মধ্যে যিনি বিশিষ্ট হয়ে আছেন ভাষা এবং কবিতার ওপর আমাদের মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য। তিনি বলেছিলেন, ‘যেখানে ভাষা কেবল সেখানেই বিশ্ব।’ কিংবা ‘ভাষার ভিত্তির ওপর অস্তিত্বের সমগ্র ধারণাটা দাঁড়িয়ে আছে।’ অর্থাত্ ভাষার বাইরে আমাদের আসলেই কোনো অস্তিত্ব সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এই বিশ্বজগতের ধারণা করা। কারণ, তা কোনো না কোনোভাবে ভাষাশ্রয়ী। বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর তুলনায় বাংলা ভাষার অস্তিত্ব আমার হূদয়কে সারাক্ষণ অধিকার করে আছে—এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! ভাবুন, বায়ান্ন সালে সত্যি সত্যি যদি আমাদের ভাষার বিজয় না হতো, তাহলে আমাদের সৃজনশীলতা বা আগের সব সৃজনশীলতার যোগফলটুকু ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়ে যেতে পারত চিরকালের জন্য। ইতিহাসে এমন নজির কম নয়। গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাসে হাতে গোনা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন যিশুখ্রিষ্ট, তাঁর মুখের বুলি আরামায়িক বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও যে তা টিকে গেল, তার জন্য আমাদের গভীর শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা মহান ভাষাশহীদদের প্রতি, যাঁরা একেকজন আমাদের প্রাণের, আমাদের অস্তিত্বের চিরন্তন বর্ণমালা হয়ে আছেন।
প্রতিটি ভাষার মাধ্যমে বিশ্বজগত্ বা মানব অস্তিত্বের যে ধারণা মানুষের মনে গড়ে ওঠে, তার গড়ন ভাষাভেদে ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র। তার প্রকাশও আলাদা। প্রায় এক দশক আগে স্প্যানিশভাষী একটি দেশে থাকার সুবাদে আমার সামান্য যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে এ কথা বলা যায় যে ব্যাকরণের পরিভাষায়—পুরুষ এবং বচনভেদে ক্রিয়াপদের বৈচিত্র্যে বাংলা ও স্প্যানিশ অভিন্ন স্বভাবেরই অংশীদার। আবার এই দুই ভাষার সবলতা এবং দুর্বলতা, সুবিধা ও অসুবিধাও বিস্তর। বিশেষণ আর আবেগের আতিশয্য এই দুই ভাষার বৈশিষ্ট্য নজরে পড়বে যে কারোর। উষ্ণতা ও প্রগলভতায় উভয়ই যেন একই রক্ত ধারার। বাংলা ভাষার অনেক শব্দের সঙ্গে এই ভাষার মিলও রয়েছে। স্প্যানিশ বা কাস্তেইয়ানো লাতিন থেকে নিঃসৃত এক ভাষা। বাংলা যদিও লাতিন নয়। তবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ইউরোপীয় কোনো কোনো ভাষা আমাদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বা রক্তীয় হিসেবে নানান জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একই কারণে বাংলায় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অনেক শব্দ যেমন আছে, তেমনি আরবি-ফার্সিও রয়েছে প্রচুর। স্প্যানিশ ভাষায় সমগ্র শব্দভান্ডারের ৬০ শতাংশ লাতিন, ১০ শতাংশ গ্রিক, ১০ শতাংশ জার্মান আর ১৫ শতাংশ আরবি। সংখ্যার বিচারে প্রায় চার হাজার আরবি শব্দ আত্তীকৃত হয়েছে স্প্যানিশে। ফলে বাংলা অনেক শব্দের সঙ্গে রয়েছে এর মিল। মেহিকোর বিখ্যাত লেখক অক্তাবিও পাস তাঁর ইন লাইট অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে এ বিষয়ে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। যত দূর মনে পড়ে, আমাদের দেশে ‘সবেদা’ বলে যে ফলটি আছে, স্প্যানিশে তাকে প্রায় একই উচ্চারণে চিহ্নিত করা হয়। কমলার সমার্থক শব্দ ‘নারঙ্গি’। ফররুখ আহমদের কবিতায় এ শব্দটির ব্যবহার আছে। স্প্যানিশে শব্দটি উচ্চারিত হয় ‘নারান্হা’। পার্থক্য সামান্যই। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়েছিলাম ‘লোদো’ শব্দটি শুনে। কারণ, এ শব্দটি ওখানে শুনতে পাব, এটা ছিল আমার অনুমানের বাইরে। শহরের লোকজন প্যাককাদা বললেও গ্রাম বাংলায়, বিশেষ করে আমার গ্রামের লোকজন (শরীয়তপুরবাসী) ‘লোদ’ বলে। আমি ভেবেছিলাম, ‘লোদ’ শব্দটি খাঁটি বাংলা। অজপাড়াগাঁয়ে ব্যবহূত এ শব্দটির উত্স আসলে লাতিন। ভাবুন, ‘কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছে।’ আরও একবার অবাক হয়েছিলাম মাদারীপুরের ‘কালকিনি’ নামে মেহিকোতে একটি জায়গার নাম দেখে। আল্লাহ মালুম, কীভাবে এটা সম্ভব!
তবে মিল যতই থাকুক না কেন, দুটি ভাষার বৈশিষ্ট্যে পার্থক্যও আছে প্রচুর। প্রতিটি ভাষারই নিজস্ব ধরন এবং বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমাদের ভাষার অসাধারণ পণ্ডিত মহামান্য সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা রচনা আছে। শিরোনাম ‘আমার ভান্ডার আছে ভরে’। নানান ভাষায় তাঁর অবাধ যাতায়াতের কারণেই বিভিন্ন ভাষার সীমাবদ্ধতা এবং সুবিধাগুলো তাঁর জানা ছিল। যেমন ‘সমাস’-এর কথাই ধরুন। তিনি বলছেন, ‘সমাস বাড়ানোর প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতা কোনো কোনো ভাষায় নেই। ইংরেজি, ফরাসি কেঁদে-কুঁকিয়ে দৈবাত্ দু-একটা সমাস বানাতে পারে—যথা ‘হাইব্রান্ড’, ‘রঁদেভু’। এ প্রবৃত্তি যে ভাষার নেই, তার ঘাড়ে এটা জোর করে চাপানো যায় না। জার্মান ভাষা আমার জানা নেই, কিন্তু মুজতবা আলীর সূত্রে আমরা জানতে পারছি, জার্মান ভাষায় সমাস বানানোর প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতা বিস্ময়কর। ওই প্রবন্ধে তিনি দু-একটি লম্বা লম্বা নজির দেখিয়েছেন। সেগুলো এখানে উদ্ধৃত করে লাভ নেই, কারণ আমি ওগুলো উচ্চারণ করতে পারব না।
এ ক্ষেত্রে স্প্যানিশ ভাষার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বোর্হেসের অভিজ্ঞতা এবং ভাষ্যও হচ্ছে, ‘আলেমান, ইংরেজি, স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাষা কিংবা ডাচ্ ভাষার যে সুবিধা রয়েছে, স্প্যানিশ ভাষার তা নেই। মুজতবা আলীর মতো এই বহুভাষী লেখক ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষার সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষার তুলনা করে দেখিয়েছেন। বোর্হেসের মাধ্যমে জানতে পারছি যে হিব্রু ভাষায় সুপারলেটিভ নেই, ফলে ওই ভাষায় ‘সং অব সংস’ বা ‘গানের গান’ বললে বুঝতে হবে, আসলে ‘পরম গান’ বা ‘শ্রেষ্ঠ গান’ কথাটা বোঝাতে চাইছে। কিন্তু ভাষাভেদে এর অনুবাদ হয়েছে বিভিন্ন রকম। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলা ভাষার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, এর মধ্যে সুপারলেটিভ এবং সমাস বানানোর ক্ষমতা—দুটোই আছে। যদিও মুজতবা আলীর মতে, খাঁটি বাংলায় সমাসের নজির খুব বেশি নেই। তবে বাংলা যেহেতু সংস্কৃতের নিকটতম আত্মীয়, ফলে ধারকর্জ করে কাজ চালাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
তবে যা বলতে চাইছি তা হলো, ভাষার স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার কারণে বাক্য গঠনে ভিন্নতা চলে আসবে। বহু আগে বাংলা ভাষার কোনো এক কবির একটা বাক্য ছিল এ রকম ‘আজানু-লম্বিত-ভ্রমর-কৃষ্ণ-কুঞ্চিত-কুন্তলদাম’। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে গোটা বাক্যটিই একটি শব্দ হিসেবে কবি উপস্থাপন করেছিলেন। কিংবা যদি না-ও করে থাকেন তাহলে ছয় শব্দের এ বাক্যটিকে একটিমাত্র সমাসবদ্ধ শব্দে উপস্থাপন করলে এর অর্থ বোঝতে আমাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এখন দেখা যাক দীর্ঘ এই শব্দটি স্প্যানিশে কী রকম দাঁড়ায়। স্প্যানিশে যদি আমরা শব্দটির তর্জমা করতে চাই, তাহলে মোটামুটি এভাবে বলা যেতে পারে Su Calbello negro como el Escarabajo, Largo y chino hasta la rodilla. দেখা যাচ্ছে, স্প্যানিশে গিয়ে ওই একটি সমাসবদ্ধ শব্দের বদলে আমরা পাচ্ছি ১২টি শব্দ। শুধু এই একটি উদাহরণ থেকেই আমরা বুঝতে পারছি, স্প্যানিশ সমাস বানানোর ব্যাপারে কতটা দুর্বল এবং অকেজো।
তবে এই দুর্বলতা দেখিয়ে এই ভাষার অন্য সব বৈশিষ্ট্য বা সবলতাকে খারিজ করা বা ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলে, কোনো কোনো প্রাণিকুল কোনো একটি ইন্দ্রিয়র ঘাটতি সে পূরণ করে অন্য কোনো ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। আমার ধারণা, ভাষার ক্ষেত্রেও সে রকম ঘটে। স্প্যানিশ ভাষায় ধ্বনির নৈকট্য বেয়ে আলবুর (বাকচাতুরির মাধ্যমে অপর পক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল) করার যে প্রচণ্ড ক্ষমতা, তা আবার বাংলা ভাষায় খুব বেশি পাওয়া যাবে না। আর ভাষার এই যে বৈশিষ্ট্য, তা একটি জাতির সাংস্কৃতিক স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করে দেয়। বলা হয়ে থাকে যে মানুষ ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে বা মানুষ ভাষাকে পরিচালিত করে। কিন্তু আমরা স্প্যানিশ ভাষার এই বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করে নিলে বলতে পারি যে ভাষাও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাত্ তার সাংস্কৃতিক স্বভাব এবং বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে ভাষার একটি সক্রিয় ভূমিকা থাকে। অর্থাত্ ভাষা শুধু জীবন্ত ব্যাপারই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাও পালন করে বলে আমার ধারণা।
আমাদের দেশে অঞ্চলভেদে যেমন আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে, স্প্যানিশে সে ধরনের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য আছে বলে আমার জানা নেই। অঞ্চলভেদে পরিবর্তন যেটা রয়েছে, তা আঞ্চলিক টান নয়। বরং ভিন্ন প্রতিশব্দের ব্যবহার। একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যেতে পারে। আমাদের দেশের হাটের মতো একটা ব্যাপার রয়েছে মেহিকোতে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটা দিনে, নির্দিষ্ট একটা অঞ্চলে এই হাট বসে। হাট বললেও এটা আসলে কেবল গ্রামের কোনো জিনিস নয় মোটেই, শহর-গ্রাম সর্বত্রই এর অস্তিত্ব রয়েছে। ওরা এই হাটকে বলে ‘ছবরে রোয়েদাস’। কিন্তু মেহিকোর উত্তরাঞ্চলে সবাই ‘ছবরে রোয়েদাস’ বললেও দক্ষিণাঞ্চলের লোকজন একে বলে ‘তিয়াঙ্গিস’। কিংবা আপনি যদি কাউকে ‘কৃপণ’ বলে চিহ্নিত করতে চান, তাহলে বাহা ক্যালিফোর্নিয়ার লোকজন ‘কদো’ শব্দটা ব্যবহার করবে। আবার অন্য অঞ্চলের লোকজন তাকে ‘তাকান্যো’ বা ‘পিওহো’, আবার আরেক অঞ্চলের লোকজন বলবে ‘মেসিকনো’ বা ‘মিছেরাবলে’। এই যে একই শব্দের এতগুলো সমার্থক শব্দ, তা নিছক অঞ্চলভেদের কারণে। অর্থাত্ শব্দ চয়নের ভিন্নতাই আঞ্চলিকতাকে চিহ্নিত করে, ক্রিয়াপদের আঞ্চলিক রূপ নয়, যেটা আমাদের ভাষায় রয়েছে। সুতরাং এ অর্থে বাংলা ভাষার তুলনায় স্প্যানিশ অনেক বেশি সহজ।
যেকোনো ভাষার গুণ, শক্তি, সৃজনশীলতা, সৌন্দর্য এবং প্রতিভার প্রকাশ ঘটে সে ভাষার গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, ছড়ায় বা বলা যেতে পারে শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমগুলোয়। কিন্তু আমরা বোধহয় এ রকম ভাবতে অভ্যস্ত নই যে অনুবাদেও একটি ভাষার শক্তি ও প্রতিভার পরীক্ষা চলতে পারে এবং সফল অনুবাদের ফলে সে পরীক্ষায় চমত্কারভাবে উতরেও যেতে পারে। অনুবাদের মাধ্যমে একটি ভাষার গ্রহণ-ক্ষমতাকে আমরা লক্ষ করতে পারি। অনুবাদ, বিশেষ করে সফল অনুবাদ ভাষার জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। ধরা যাক, আমাদের কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসের প্রথম স্তবক ‘আলো ক্রমে আসিতেছে, এ নভোমণ্ডল মুক্তা ফলের ছায়াবত্ হিম নিলাভ। আর অল্পকাল গত হইলে, পুনরায় আমরা প্রাকৃত জনেরা পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। ক্রমে আলো আসিতেছে।’
এখন ধরা যাক, আমরা কেউ এ ক্ষেত্রে একজন স্প্যানিশ অনুবাদকের কথা কল্পনা করে নিতে পারি আলাপটাকে অব্যাহত রাখার জন্য। তিনি স্প্যানিশে অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে তা করবেন। প্রথমত, স্প্যানিশে চলিত-সাধুর কোনো বালাই নেই। দ্বিতীয়ত, বাক্যগঠন প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণের অনুগামী নয়। বরং কমলকুমারের সৃষ্ট বাক্যরীতি এতে প্রবহমান। তৃতীয়ত, আবহ, অনুষঙ্গ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিহ্নসমূহ। এ সবকিছু হুবহু স্প্যানিশভাষী কোনো দেশেই বোধহয় পাওয়া যাবে না। তারপর আরও যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ভাষিক চারিত্র ও স্বভাবের ভিন্নতা। এত সব বাধা ও ভিন্নতা সত্ত্বেও অনুবাদকেরা কিন্তু দুঃসাহসী সিন্দাবাদের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এগিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর মূল প্রস্তুতি হবে কমলকুমারের ভাষা এবং অনুষঙ্গ সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান ও কল্পনা। এটাকে পুঁজি করে তিনি নিজের ভাষাকে প্রস্তুত করে নেবেন, যদি তিনি সফল অনুবাদ করতে চান। এটা অনেকটা অসম্ভব একটি কাজ। তারপরও যদি করতে হয়, তাহলে দেখা যাবে, নিজের ভাষার প্রচলিত অনেক রীতি লঙ্ঘন করেই সেটা করতে হবে। আর সেটা করতে গেলেই ভাষা তার পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছে। আর এই পরীক্ষার ফলে নিজ ভাষার গড়ন ও চলনের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন দেখা দেবে। ভাষার ব্যাপারে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন অনুবাদক এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা না করে পারবেন না।
এবার আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই, আত্মশ্লাঘার জন্য নয়, বরং বাংলা ভাষার গ্রহণক্ষমতার একটা চমত্কার উদাহরণ হিসেবে। কিছুদিন আগে আমার বন্ধু এবং অনুবাদক রফিক-উম-মুনীরের আহ্বানে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ওপর ফিদেল কাস্ত্রোর একটি লেখা স্প্যানিশ থেকে বাংলা অনুবাদ করার সুযোগ হয়েছিল। লেখাটির এক জায়গায় ফিদেল প্রশ্ন করলেন মার্কেসকে: Tu Que estabas haciendo durante el Bogotazo? বাংলায় এর অনুবাদ হাজির করার আগে বাক্যের পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে একটু না জানালে হয়তো বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। কলম্বিয়ায় রাজনৈতিক তাণ্ডব, অর্থাত্ বোগোতায় রাজনৈতিক নেতা গাইতানের হত্যার পর হরতাল-ধর্মঘটের যে তাণ্ডব চলে, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই প্রশ্নটি। কিন্তু তাণ্ডব শব্দটি আলাদাভাবে কোথাও ব্যবহার না করে Bogoto শব্দটির সঙ্গে ‘za’ বর্ণ দুটি যুক্ত করে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন ফিদেল। শুধু ‘বোগোতা’ শব্দটি কেবল একটি স্থানকে নির্দেশ করে, কিন্তু স্প্যানিশ ভাষার অপূর্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে ‘Zo’ বর্ণ দুটি যুক্ত করে অন্য আরেকটি অর্থে, মানে একই সঙ্গে ‘বোগোতা’ এবং ‘তাণ্ডব’—এই দুটি অর্থকেই একসঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে। চমত্কার কয়েনিং। যদিও স্প্যানিশ ভাষায় এ ধরনের ব্যবহার ব্যাকরণসম্মত নয়, কিন্তু ভাষা তো আর সর্বক্ষণ ব্যাকরণকে তোয়াজ করে চলে না, তাই এই সৃষ্টি ছাড়া ব্যবহার। তবে ব্যাকরণসম্মত না হলেও স্প্যানিশভাষীদের কাছে তা অবোধগম্য নয়। প্রতিটা ভাষায়ই সম্ভবত এ রকম ব্যাপার থাকে। বাংলা ভাষায়ও নিশ্চয় ব্যতিক্রম আছে, যদিও স্প্যানিশ ভাষার মতো এ ধরনের প্রকাশ বাংলা ভাষায় নেই। কিন্তু সৃজনশীল মন আর লীলাচ্ছলে ভাষাকে ফুসলিয়ে নেওয়ার একটু হিম্মত থাকলে বাংলা ভাষায়ও তা সম্ভব হতে পারে। আমি একটিমাত্র শব্দে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে ওর অনুবাদ করেছিলাম এভাবে ‘গাবো, বোগোতাণ্ডবের সময় তুমি কী করছিলে?’ আমি হয়তো বলতে পারতাম, ‘গাবো, বোগোতায় ওই তাণ্ডবের সময় তুমি কী করছিলে?’ অনুবাদ নিঃসন্দেহে নির্ভুল এবং যথাযথ হলো, কিন্তু ভাষার শক্তির পরীক্ষাটা হতো না। আমার ধারণা, ‘বোগোতাণ্ডব’ শব্দটি দিয়ে আমি কাঙ্ক্ষিত অর্থকে প্রকাশ করতে পারছি। শব্দটি আবিষ্কার করে আমি নিজে যতটা না আনন্দ পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি বাংলা ভাষার আশ্চর্য গ্রহণক্ষমতার প্রতিভা টের পেয়ে। আমার বিশ্বাস, অস্তিত্বহীন অনেক কিছুকে এই ভাষায় সফলভাবে অস্তিত্বময় করা সম্ভব। এ জন্য আমাদের যা দরকার তা হলো—ভালোবাসা, ধৈর্য আর নিষ্ঠা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০১০
Leave a Reply