সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজ্জাদ শরিফ
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাজ্জাদ শরিফ: বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আপনি দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৯৬ সালে। সে সময়ের স্মৃতি নিয়ে লেখা বইটি বেরোল এবারের বইমেলায়। এত সময় লাগল যে?
মুহম্মদ হাবিবুর রহমান: সবকিছু গুছিয়ে লেখার জন্য লজিস্টিক সহযোগিতা আমার ছিল না। প্রথম আলো এ ব্যাপারে সহায়তা দিয়েছে, এজন্য আমি এটা লিখতে শুরু করি। এসব লেখা সঙ্গে সঙ্গে না লিখে সময় নিয়ে লেখা ভালো। ভাগ্যক্রমে আমার তথ্যাদির সমাহার মোটামুটিভাবে সন্তোষজনক ছিল।
সাজ্জাদ: এটি স্মৃতিকথা না ইতিহাস?
মু. হা. রহমান: এটা আসলে কতগুলো ঘটনার বৃত্তান্ত। এই অল্প কদিনের কাহিনিকে ইতিহাস নাম দেওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখি না। এটা হলো বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী কর্তৃক অর্পিত এক অভিনব দায় পালনের কাহিনি।
সাজ্জাদ: সমসাময়িক ইতিহাসের নানা পক্ষ-বিপক্ষ থাকে। কিন্তু এ ধরনের রচনায় লেখকেরা সাধারণত নিজের দিকের কথাই লিখে থাকেন। আপনি সে সীমারেখা মানেননি। বৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে কোনো সমস্যা বোধ করেছেন?
মু. হা. রহমান: এই বইয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত আমি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকাশ করেছি। এ ব্যাপারে কারও প্রতি আমার অনুরাগ বা বিরাগ ছিল না। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল, ডান-বাম, মধ্য-ছোট-বড় রাজনৈতিক দলের বক্তব্য সংক্ষেপে আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। না, লেখার ব্যাপারে আমি কোনো সমস্যা বোধ করিনি।
সাজ্জাদ: আপনি শুধু ঘটনার বিবরণ দিয়ে শেষ করেননি, ঘটনার মূল্যায়নও করেছেন।
মু. হা. রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভারকে আমি এক অভিনব দায় বলে বিশেষিত করেছি। এ দায় পালনে যেসব পরিস্থিতি বা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম তা কেবল বর্ণনা করলেই আমার কাজটা সম্পূর্ণ হতো না। আরোপিত কর্তব্য, কর্তব্য পালন এবং তার মূল্যায়নের কাহিনি এক সূত্রে গ্রথিত।
সাজ্জাদ: এ কর্তব্য পালনে কতদিন সময় নিয়েছেন?
মু. হা. রহমান: আমার সময় ছিল ৯০ দিন। এ সময়সীমার আট দিন আগেই আমি আমার কাজ সম্পন্ন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করি। আমাকে তখন অনেকেই অনুরোধ করেছিলেন, আরও কিছুদিন থেকে যেতে। তাঁরা চেয়েছিলেন, দেশের অবস্থা আরও ছিমছাম করার পর ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। ব্যাপারটা দৃশ্যত অবৈধ হতো। অনেকে এও বলেছিলেন, আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা আপনার অতিরিক্ত সময়ের কাজের বৈধতা দেব। আমি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে ‘না’ বলেছি। আমাদের দেশে কেবল এক ব্যক্তির জন্য তিনবার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি চতুর্থ ব্যক্তি হতে চাইনি।
সাজ্জাদ: কিন্তু গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে তিন মাসের বেশি সময় ধরে থাকল?
মু. হা. রহমান: দেশের প্রখ্যাত আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়েই হয়তো তারা নির্ধারিত সময়ের পরেও তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছেন। সময়সীমার বিধান সাধারণত বাধ্যবাধকতামূলক। সে বাধা অতিক্রম করার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষ উদ্ভাবনী ওকালতি অথবা আইনের পরিবর্তে গাইনের আশ্রয় নিতে পারে।
সাজ্জাদ: ‘গাইন’ কথাটা একটু ভেঙে বলুন।
মু. হা. রহমান: এটা বোঝানো যাবে না। এ ব্যাপারে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম। এর শেষ দুই চরণ ছিল, ‘গাইন আইনের আপ্ত অংশ/আইনের অপভ্রংশ।’
সাজ্জাদ: আপনার লেখা থেকে মনে হয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থাকে আপনি তির্যক চোখে দেখেন। অথচ আপনি নিজে এ দায়িত্ব পালন করেছেন।
মু. হা. রহমান: এ দায়িত্ব গ্রহণে আমি অস্বীকৃতি জানাতে পারতাম। এ দায়িত্ব যে আমি না নেওয়ার চেষ্টা করেছি, সে ব্যাপারে এ বইয়ে লিখেছি। নানা চিন্তা করে সংবিধান আরোপিত দায়িত্ব অস্বীকার না করে বেশ ঝুঁকি নিয়েই তা পালন করেছি।
সাজ্জাদ: ঝুঁকিটা কিসের?
মু. হা. রহমান: যেকোনো অসস্তুষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরীক্ষামূলক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বানচাল করে দিতে পারত। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ভেবেছিল তারা নির্বাচনে জিতবে। সে জন্য তারা আমার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। লক্ষ করে দেখবেন, নির্বাচনে উভয় রাজনৈতিক দলের ফলাফল প্রায় সমান।
সাজ্জাদ: কিছু ঘটনা নিয়ে আপনার বইয়ে পাঠক আরেকটু বিশদ বর্ণনা আশা করবেন, যেমন জেনারেল নাসিমের সেনাবিদ্রোহ। কিন্তু আপনি লিখেছেন অত্যন্ত মিতব্যয়ীর মতো।
মু. হা. রহমান: এর চেয়ে বেশি লেখার আর কোনো প্রয়োজন ছিল না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০১০
Leave a Reply