সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রশান্ত মৃধা
সেলিনা হোসেন প্রশান্ত মৃধা: ভূমি ও কুসুম উপন্যাসের জন্য ছিটমহলগুলোকে বেছে নেওয়ার পেছনে কোনো নির্দিষ্ট কারণ আছে?
সেলিনা হোসেন: নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, তবে সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময় থেকে ছিটমহলগুলোর সমস্যা, বিশেষ করে সেখানকার অধিবাসীদের বন্দিজীবন যাপন ইত্যাদি নিয়ে একটি উপন্যাস হতে পারে বলে বিশ বছর আগে ভেবেছিলাম। তার পরে বিভিন্ন খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। সাত বছর আগে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা দেখতে গিয়েছিলাম। একসময় কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত অনুরোধ করলেন ধারাবাহিকভাবে একটি উপন্যাস লেখার জন্য। তখন মনে হয়েছিল, ধারাবাহিকতার সূত্রে সময় নিয়ে এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে একটি উপন্যাস শুরু করি। মাসে একবার ছাপা হবে কয়েক পৃষ্ঠা—পাশাপাশি আমি অন্যান্য মেটেরিয়ালও দেখে নিতে পারব। যে তথ্য-উপাত্ত আমি সংগ্রহ করেছি, তার সঙ্গে আমি ব্যক্তির সম্পর্কের সূত্রগুলো দেখার চেষ্টা করেছি। এমন নয় যে যে কাহিনিটি এখানে গড়ে উঠেছে, ঠিক সেভাবেই সেখানকার বাসিন্দারা জীবনযাপন করে। বাস্তবতার সূত্র ধরে, কল্পনার মিশেল ঘটিয়ে উপন্যাটি লেখা হয়েছে।
প্রশান্ত: লিখতে লিখতে এই উপন্যাসের গঠন ও আখ্যানভাগের বদল করতে হয়েছে?
সেলিনা হোসেন: না। আমি কাহিনিটির যে ছকটি করেছিলাম সেই ছকটি ধরে এগিয়েছি। কারণ আমার ভয় ছিল, অন্যকিছু ভাবতে গেলে কাহিনির সূত্রটি এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। তবে, কিছু কিছু শাখা-প্রশাখা খুব ছোট আকারে যে ছাড়ায়নি তা নয়।
প্রশান্ত: কোনো সমস্যা উপন্যাসের মূল সমস্যা হিসেবে নির্দিষ্ট করে নিলে আখ্যান ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে? এ উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা হয়েছে কখনো?
সেলিনা হোসেন: না। একদমই না। কারণ, কাহিনিটিকে আমি ইচ্ছামতো তৈরি করেছি। বিষয়টি তো নির্দিষ্ট ছিল, কাহিনিকে আমি সব সময় বিষয়ের ভেতরে একীভূত করে রাখিনি। কারণ, কাহিনির মূল বিষয় ছিল ছিটের বাসিন্দাদের বন্দিজীবন যাপন। এই বন্দিজীবনের ভেতরে কাহিনির নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে। সেখানে অভাব-দারিদ্র্য যেমন আছে, প্রেম আছে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার নানা সূত্র আছে। এবং সবচেয়ে বড় জিনিস যে সীমান্তরক্ষীদের দ্বারা ওরা পরিবেষ্টিত, তাদের সঙ্গে ওদের সংঘর্ষের নানা দিক নিয়ে কাহিনির বিস্তার ঘটিয়েছি। এটা এমন নয় যে যা কিছু এখানে ঘটেছে, তার সবটাই ওদের বাস্তবতা। বাস্তবতা হলো কাহিনির উপাদান।
প্রশান্ত: কোনো চরিত্র এই উপন্যাসের যাপিত জীবনের সংকটের ভেতরে বাহাদুর হয়ে উঠেছে? যদি ওঠে, সে ক্ষেত্রে নিজেদের এই সংকটের থেকে পরিত্রাণ পেতে লেখককে কোনো উপায় বাতলে দিয়েছে?
সেলিনা হোসেন: বাহাদুর হয়ে ওঠার তো চেষ্টা করেছে বিভিন্ন জায়গায়। যেমন, দুটি চরিত্র আছে, যারা সতিন। গোলাম আলির কাছে তাদের জিজ্ঞাসা ছিল যে আপনি এত কিছু সবার জন্য করেন, ভাবেন, আপনি একজন পুরুষের দুটো তিনটে বিয়ে বন্ধ করতে পারেন না? গোলাম আলি বলে, কেমন করে করব, ধর্মেই তো চারটি বিয়ের কথা আছে। তখন সেই চরিত্রটি উত্তর দেয়, আমি ধর্ম বুঝি না, আমি সতিন বুঝি।
পথ বাতলে দেওয়ার সুযোগ ওদের নেই; কিন্তু নিজেদের মতো করে প্রতিবাদ করার জায়গা আছে। যেমন, একবার তিস্তায় একটি চর জেগে উঠল, বিএসএফ সঙ্গে সঙ্গে সেই চরটি দখল করে নিল। কিন্তু সেই ভূমির মালিক ছিল ছিটের বাসিন্দাদের একজন। চরের কথা শুনে সবাই দৌড়ে গিয়ে নদীর ধারে জড় হয়। ওদের জড় হতে দেখে বিএসএফের জওয়ানেরা তাদের দিকে রাইফেল তাক করে। সিটের বাসিন্দারা রাইফেলের মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তখন মনজিলা বলে, ওদেরকে একটা প্রতিবাদের চিহ্ন দেখাতে হবে। চলো, আমরা ওদের দিকে পাছাটা উঁচু করে হাঁটুতে হাত রেখে হেঁটে যাই।
প্রশান্ত: এই উপন্যাসের গদ্যে চরিত্রগুলোর বিকাশের বিভিন্ন দিক সহজে ধরতে পেরেছেন?
সেলিনা হোসেন: না। সব সময় ধরে ওঠা সম্ভব হয় না। আমি অনেক সময় বিশেষ একটি পয়েন্টে ছেড়ে যাই। যেখানে একটি চরিত্রকে একটি বিশেষ দিক থেকে বুঝতে পারে পাঠক। এই উপন্যাসের অনেক চরিত্রকে আমি এভাবে দেখেছি, কারণ, আমার লক্ষ্য ছিল ছিটমহলের পুরো বাসিন্দা। শুধু কয়েকটি চরিত্রের বিকাশ নয়। তাই উপন্যাসে এমন আসা-যাওয়া চরিত্র আছে, যারা জনসমষ্টির অংশ। ব্যক্তিহিসেবে তাকে বড় জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।
প্রশান্ত: রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সমাজের বাস্তবতা সব সময় ধরা যায়? এ উপন্যাসটি লিখতে লিখতে এমন সংকটে পড়েছেন?
সেলিনা হোসেন: এ উপন্যাসে ছিটমহলের অধিবাসীদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তারা এই ছিটমহলে ঢুকে অসংখ্য বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। সিটের অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যাতায়াতের সুযোগ দেয়নি। সুযোগ নিতে গেলে গুলি করেছে। অনেক সময় নারীদের ধরে নিয়ে গেছে। আবার বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় তাদের দরজাটা খোলা রেখেছিল, যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশের মানুষ আবার দরজা বন্ধ দেখতে পায়। নিজ ভূখণ্ডে নিয়মিত যাতায়াত করতে পারত না তারা। একটি ভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সংকট এই উপন্যাসে নানাভাবে এনেছি। আবার নিজ রাষ্ট্রের সঙ্গেও ব্যক্তির সংকট এই উপন্যাসে এসেছে। এভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের অধিবাসীরা আমার উপন্যাসের চরিত্র হয়েছে। অর্থাত্, যে দায়টি তার নয়, সে রকম দায়ের কারণে নষ্ট হয়েছে তার সুস্থভাবে বেঁচে থাকা।
প্রশান্ত: উপভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মান বা প্রমিত রীতি ব্যবহার করেছেন, বিশেষ করে সংলাপে। এটা কি ইচ্ছাকৃত না সহজবোধ্যতার জন্য?
সেলিনা হোসেন: দুটোই। কারণ, ইচ্ছাকৃত এই জন্য যে, যে সময়টায় আমি ছিটমহলকে দেখেছি, অত অল্প সময়ে ওই মানুষদের মুখের ভাষা ধরা আমার সাধ্য ছিল না। ভুল কিছু না করার জন্য আমি এই চেষ্টাটি একদমই করিনি। দ্বিতীয়ত, সহজবোধ্যতাও একটি কারণ। কারণ, পাঠক ধরে নিতে পারবেন যে এই পটভূমিতে মানুষ যে ভাষায় কথা বলেছে, সেটা তার মুখের ভাষা নয়।
প্রশান্ত: উপন্যাসটির দ্বিতীয় খণ্ড লেখার ইচ্ছে আছে?
সেলিনা হোসেন: না, দ্বিতীয় খণ্ড লেখার মতো আমার কোনো সুযোগ নেই। আমি যেখানে শেষ করেছি, একটি প্রেমঘন জীবন ছিল একটি চরিত্রের, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে যখন ওদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, তখন ওই ছেলেটির ডান হাতটা পুড়ে যায়। মনজিলার মেয়েটি তাকে ভালোবাসে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ছেলেটি যুদ্ধে যায় এবং শহীদ হয়। মেয়েটির জন্য এটি ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। ও চিত্কার করে বলে, আমি শহীদের স্ত্রীর গৌরব চাই না, তোমরা আমার ভালোবাসার মানুষটি ফিরিয়ে আনো। একদিন ও সিটের সমস্ত জায়গা থেকে কয়েক ডালি ফুল সংগ্রহ করে তিনবিঘা সীমান্তে এসে দাঁড়ায়। সীমান্তরক্ষীদের বলে, আমি আমার স্বামী যেখানে শহীদ হয়েছে, ভূরুঙ্গামারীর সেই জায়গাটিতে ফুল দিতে যাব। সীমান্তরক্ষীরা ওর বুকের ওপর রাইফেল ধরে। ও একটুও ভয় না পেয়ে চিত্কার করে বলে, তোমরা আমাকে মেরে ফেল, আমি এই ছিটের স্বাধীনতা চাই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০১০
Leave a Reply