সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
রাজু আলাউদ্দিন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী: বোর্হেসকে বলা হয় লেখকদের লেখক। তাঁর মতো এমন দুরূহপাঠ্য, জটিল একজন লেখকের যাবতীয় রচনা থেকে বাছাই করে বাংলায় একটি সংকলন করার ব্যাপারে আপনি উদ্যোগী হলেন কেন?
রাজু আলাউদ্দিন: বোর্হেস জটিল কিন্তু আনন্দদায়ক। বলব, ভীষণ রকমের আনন্দদায়ক। তবে জটিল বলছেন হয়তো তাঁর টেকনিকের কারণে। তিনি একটা গল্পকে যেভাবে যে শিল্প-কৌশলের মাধ্যমে গড়ে তোলেন, তা জটিল, এটা সত্য। যে কারণে অনেক বড় লেখক তাঁকে একবাক্যে গুরু বলে স্বীকার করেন। অন্যদিকে তাঁর গল্পের আনন্দদায়ক দিক হচ্ছে এর বিষয়। তাঁর গল্পের জন্য এমন সব ধারণাতীত বিষয় তিনি ভাবতে পারেন যা অবাক হওয়ার মতো। ট্লন, উকবার, অরবিস টাসিয়াস কিংবা ধরুন জন উইলকিপের বিশ্লেষণ কিংবা ধরুন প্ররোহী পথের বাগান। প্ররোহী পথের বাগান গল্পে বলা হচ্ছে অন্তহীন একটি উপন্যাসের কথা, যেখানে অসংখ্য সময়ের কথা চিন্তা করা হয়েছে। এবং প্রতিটি সময় ভিন্ন স্বভাবের কিন্তু তারা এক সঙ্গেই আছে। আমার কাছে সায়েন্সফিকশন ম্যুভির মতো জম্পেশ ব্যাপার মনে হয়। আপনি ভিজুয়ালাইজ করলে কিন্তু এই মজাটা পাবেন। ট্লন গল্পের ক্ষেত্রেও তা-ই। এ জন্যই আমি বলি, বিপুল আনন্দদায়ক। অ্যাকাডেমিশিয়ানরা হয়তো জটিল বলবেন। কারণ তাঁর টেকনিক অবশ্যই জটিল।
রফিক: আপনি বলতে চাইছেন তাহলে বোর্হেস সাধারণ পাঠকদের জন্য উপভোগ্য?
রাজু আলাউদ্দিন: আমার কিন্তু তা-ই মনে হয়। আপনি গার্সিয়া মার্কেসের ব্যাপারটা দেখুন। তাঁর লেখা সাধারণ মানুষও পড়ছে আবার মননশীল পাঠকেরাও পড়ছে। বোর্হেস পণ্ডিতধাঁচের লেখক কিন্তু পাণ্ডিত্য আর দার্শনিক ধাঁধা ও জিজ্ঞাসা তাঁর কাছে এক মজার জিনিস, যেগুলো নিয়ে তিনি খেলেন। এ খেলাতেই যত আনন্দ। এ আনন্দ উপভোগ করার জন্য গল্পের আকারে কিংবা প্রবন্ধের ছদ্মবেশে তাঁর সৃষ্টিশীলতার কাল্পনিক ভুবনে বোর্হেস পাঠককে আমন্ত্রণ জানান।
রফিক: আমরা যতদূর জানি, আপনি প্রায় এক যুগ ধরে এই সংকলনটির কাজ করছেন। নানা রকম প্রকাশনা-সংক্রান্ত জটিলতা, স্থবিরতার পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সংকলনটি প্রকাশনার আলো দেখছে। আপনার অনুভূতি কেমন?
রাজু আলাউদ্দিন: অতীব আনন্দের। আসলে বোর্হেসের এই প্রকল্পটা হাতে নিয়েছিলাম ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৯ সালে মেক্সিকো চলে যাওয়ার পর থেকে গেল বছর অর্থাত্ গোটা ১০ বছর প্রকল্পটা থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার পরও আমার ঘনিষ্ঠ তিন গুণী বন্ধু এটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দেশে ফিরে নতুন উদ্যমে কাজটাকে গুছিয়ে নিয়ে সম্পাদনা করলাম এবং শেষাবধি প্রকাশিত হচ্ছে। বোর্হেস নিজেই আমার জন্য একটি আনন্দ। তার ওপর এ বইয়ের প্রকাশনা একটি বাড়তি আনন্দের ব্যাপার তো বটেই। আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত অনুবাদকদের শ্রম ও মেধার প্রতি, যাঁদের পরিশ্রম এ বইটির পেছনে রয়েছে। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া এ বই করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।
রফিক: অনুবাদের ব্যাপারে একটি কথা প্রচলিত আছে। এটি একটি ইতালীয় প্রবাদ, সেটা হলো অনুবাদক মানেই বিশ্বাসঘাতক। বোর্হেসের এই অনুবাদ সংকলনটি করতে গিয়ে আপনি এই পরিপ্রেক্ষিতে কী বলবেন? মূল স্প্যানিশ বা ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলায় এসে বোর্হেস কতটুকু থাকেন?
রাজু আলাউদ্দিন: অনুবাদ একটি জটিল কর্মযজ্ঞ। অনুবাদ বিষয়টি নিয়ে বোর্হেস বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি কিছু উদাহরণ দাঁড় করিয়ে দেখান যে অনুবাদক মূল লেখক ও তাঁর রচনার প্রতি বিশ্বস্ত না থাকলেই বরং উত্কৃষ্ট অনুবাদ সম্ভব। অনুবাদকের স্বাধীনতার কথা বলছেন তিনি। এনিগমা অব অ্যাডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড প্রবন্ধে তার মূল প্রতিপাদ্য হলো রুবাইয়াত-এর ওমর খৈয়াম আর তার অনুবাদক অ্যাডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড দুজনে মিলে হয়ে যান এক, কবি ও তাঁর অনুবাদক অনুবাদের মাধ্যমে হয়ে ওঠেন এক অভিন্ন সত্তা। বোর্হেস নিজেও অনুবাদ করেছেন। ফকনার, কাফকা থেকে শুরু করে এমনকি বিস্মিত হবেন জেনে, তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতাও অনুবাদ করেছেন ইংরেজি থেকে। বলা বাহুল্য, ইংরেজি বিশেষ করে আমেরিকান সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কিছু স্প্যানিশ অনুবাদকর্মের রচয়িতা হলেন বোর্হেস। তো, বোর্হেস যখন অনুবাদ নিয়ে অন্যদের প্রসঙ্গে কথা বলেন, তখন অনুবাদকের স্বাধীনতার কথা বলেন, কিন্তু তিনি নিজে যখন ওয়াল্ট হুইটম্যান বা প্রমুখের রচনা অনুবাদ করছেন, তখন কিন্তু মূলানুগ থেকেছেন। এবং এটি একটি উত্কৃষ্ট অনুবাদ, স্ববিরোধিতা যাকে বলে।
আমার মতে অনুবাদ শেষ পর্যন্ত একটি সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম। আমি অনুবাদক বোর্হেসের মতোই মূলের কাছাকাছি থাকার পক্ষপাতী এবং এই সংকলনটিতে সে চেষ্টাই ছিল। যে ভাষা বা সংস্কৃতির লেখককে অনুবাদ করা হচ্ছে, তাঁর সংস্কৃতির, দেশকালের আবহ যেন থাকে ওই অনুবাদকর্মে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। যে ভাষায় এটি অনুবাদ হচ্ছে, সে ভাষায় এটি যেন একটি পাঠযোগ্য রচনা হয়ে ওঠে, সেটা দেখতে হবে। পাশাপাশি মূল ভাষা ও ওই সংস্কৃতির আবহটিও যেন হারিয়ে না যায়, যদ্দূর সম্ভব সে চেষ্টাও করতে হবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০১০
Leave a Reply