চুটকি গল্পের সেই আক্কেল মিঞাকে মনে আছে, যে ইংল্যান্ড ঘুরে এসে, সে সম্বন্ধে গল্প করার সময় বলেছিল, ‘দেখলাম সাহেব-মেমদের ছোট পোলাপানগুলাও কত শিক্ষিত! কেমন সুন্দর ফরফর করে ইংরাজি বলে!’
ভাষা জানা সম্বন্ধে এমনই ধারণা কিন্তু আমাদের দেশে অনেকেরই আছে। অনেকেই মনে করেন, ‘আমি তো বাংলা জানিই। বাংলায় কথা বলি, বাংলা পড়তে পারি, লিখতে পারি…’ (অর্থাত্ তাহলে আর ব্যাকরণ শেখার বা অন্য কোনো বাড়তি পরিশ্রম করার দরকারটা কি!)
মাতৃভাষা ভালোভাবে শেখার ব্যাপারে অবশ্য সব দেশেই কিছুটা ঢিলেমি আছে। এটা ঠিক যে শুনে শুনে পুনরাবৃত্তি করে আর যান্ত্রিকভাবে অনুকরণ করে ভাষার ব্যবহার কিছুটা আয়ত্ত করা যায়, কিন্তু নির্বিচার অনুকরণের বিপদ এই যে, একবার কেউ, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ভুল করে বসলে, বহু লোক সেটা ধরতে না পেরে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে।
বাংলাদেশে অনেকেরই কথাবার্তায় (অনেকের লেখায়ও) স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ভাষা থেকে মাঝেমধ্যে অল্প কিছু ফারাক লক্ষ করা যায়। কারণ বোধহয় দেশের প্রায় প্রত্যেকের ওপর উপভাষা অথবা সাধুভাষার প্রভাব, যা সম্পূর্ণ দূর করার মতো সহজ অথচ সযত্ন প্রয়াস প্রত্যেকের দিক থেকে থাকে না।
আধুনিককালে সব ভাষার লেখ্যরূপই হলো সেই ভাষার কথ্যরূপের লিখিত রূপ। কিন্তু যাঁদের ওপর উপভাষার এবং/অথবা সাধুভাষার প্রভাব থেকে যায়, তাঁরা স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ভাষায় কথা বলা বা লেখার সময়ে নিজের অজান্তেও সাধুভাষার কিছু শব্দ ব্যবহার করে ফেলেন। যেমন ‘পূর্বে’ ‘দিবে’ ‘নিবে’ ‘গ্রহণ করা’ ‘প্রদান করা’ ‘ইতোমধ্যে’ ‘ইতোপূর্বে’ ইত্যাদি। কথ্যভাষায় শেষোক্ত দুটো শব্দের অনুপ্রবেশের কথা চিন্তা করে দেখুন। হঠাত্ একদিন কেউ আবিষ্কার করেছিলেন ‘ইতিমধ্যে’ বা ‘ইতিপূর্বে’ ব্যাকরণসম্মত নয়, তাই তিনি এবং তাঁর দেখাদেখি অনেকে সাধুভাষার ‘ইতোমধ্যে’ আর ‘ইতোপূর্বে’ শব্দ দুটোতে ফিরে গেলেন, এটা বিবেচনা করলেন না যে, তত্সম শব্দের পরিবর্তন ব্যাকরণ মেনে হয় না, এবং পরিবর্তিত শব্দ প্রচলনসিদ্ধ হয়ে গেলে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি পায় (স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘ইতিমধ্যে’ আর ‘ইতিপূর্বে’ ব্যবহার করেছেন)।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই স্বীকৃত হয়ে আসছে, আমরা যে বাংলা ভাষার পক্ষে দাবি তুলছি, তা স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ভাষাই এবং সেটা হলো বাংলা সাহিত্যের ভাষা (যা নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষা তথা কলকাতার ভাষা তথা শান্তিনিকেতনের ভাষা)। এই স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ভাষা সুষ্ঠুভাবে না শেখার কারণে এ ভাষা ব্যবহারে যে ভুলগুলো হয়, সেগুলোর ওপর বৈধতা আরোপ করতে কেউ যদি বলে, ভূভাগ আলাদা ভাষা, তো কিছুটা আলাদা হবেই, তাহলে তার অর্থ ভুলগুলোকে থাকতে দেওয়া এবং আরও বেড়ে চলাকে উত্সাহ দেওয়া। মনে রাখতে হবে, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদির মধ্যে হাজার হাজার মাইল সমুদ্রের ব্যবধান থাকলেও বহু বছরেও এসব দেশের ইংরেজি ভাষার সামান্যও হেরফের ঘটেনি, অল্প কয়েকটি শব্দের বানানে ছাড়া।
আমাদের দেশে এই স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ভাষায় কথা বলার বা লেখার সময়ে কেউ যদি আঞ্চলিক উপভাষার উচ্চারণ বা শব্দ অথবা সাধুভাষার শব্দ ব্যবহার করেন, তবে সেটাকে ভুল বলেই শনাক্ত করতে হবে।
একজনের ভুল বহুলোকে নির্বিচারে পুনরাবৃত্তি করে চলেছে, এমন একটি উদাহরণ হলো ‘সম্পৃক্ত’ শব্দটি। বাংলা ভাষার দীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র স্বল্পকাল হলো শব্দটির প্রাদুর্ভাব হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সুবিপুল রচনা-সম্ভারের কোথাও এই ‘সম্পৃক্ত’ শব্দটি পাওয়া যাবে না। আগে লোকে কোনো কিছুর সঙ্গে ‘যুক্ত’ থাকত, অথবা ‘জড়িত’ থাকত, অথবা ‘সংশ্লিষ্ট’ থাকত, অথবা ‘সম্পর্কিত’ থাকত; তারপর বোধহয় একদিন কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি ‘সম্পর্কিত’ শব্দটি ব্যবহার করতে চেয়ে বলে ফেললেন বা লিখলেন ‘সম্পৃক্ত’, অমনি শুরু হয়ে গেল ‘সম্পৃক্ত’ শব্দটির পাইকারি ব্যবহার (কোনো কোনো অভিধানও শব্দটির এমন ব্যবহার গ্রাহ্য করেছে!) কিন্তু এই অর্থে ‘সম্পৃক্ত’ শব্দটি পরিহার্য, বিশেষত এই কারণে যে শব্দটি পারিভাষিক শব্দ। রসায়নবিদ্যার Saturated শব্দটির প্রতিশব্দ ‘সম্পৃক্ত’ বা ‘পরিপৃক্ত’। এই বিশেষ অর্থটি ছাড়া শব্দটিকে অন্য কোনো অর্থে ব্যবহার করা ঠিক নয়।
আর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ, ‘স্বৈরাচার’ শব্দটি। দীর্ঘদিন ধরে সবাই ‘স্বৈরাচারী’ শব্দটি ব্যবহার করে আসছিলেন। হঠাত্ একদিন একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক জাতির উদ্দেশে তাঁর প্রথম বেতার-টিভি বক্তৃতায় ‘স্বৈরাচার সরকার’ কথাটি ব্যবহার করলেন, অমনি অজস্র লোক চিন্তাভাবনা না করে ঠাওরালেন ‘স্বৈরাচারী’ শব্দটি ভুল এবং সবাইকে দেখা গেল ব্যবহার করছেন ‘স্বৈরাচার অমুক’ ‘স্বৈরাচার তমুক’ ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে কেউ ‘স্বৈরাচারী’ কিনা, তা নিয়ে মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু কেউ কোনোভাবেই ‘স্বৈরাচার’ হতে পারেন না।
মনে হয় বেশ কিছু শব্দ সম্বন্ধে বা শব্দের উচ্চারণ সম্বন্ধে অনেকের অহেতুক সন্দেহ যে ওগুলো ‘গ্রাম্য’। একটু খোঁজ নিলেই তাঁরা জানতে পারতেন ওগুলো মোটেই ‘গ্রাম্য’ নয়, কিন্তু তা না করে তাঁরা সোজাসুজি সাধুভাষার শব্দ ব্যবহার করে মনে করেন, তাঁদের কথাবার্তার বা লেখার ওজন বাড়ল। যেমন, তাঁরা স্বাভাবিক ‘দেবে’ শব্দটি না-বলে বা না-লিখে ব্যবহার করেন ‘দিবে’ (এমনকি ‘প্রদান করবে’), ‘নেবে’ শব্দটি বাদ দিয়ে বলেন বা লেখেন ‘নিবে’ (এমনকি ‘গ্রহণ করবে’)। এদের অনেকে ধন্যবাদ দিতেও বিব্রতবোধ করেন, তাঁরা ধন্যবাদ ‘প্রদান’ করেন। আমি একবার এক অধ্যাপককে দেখেছি, ‘আমি আগেই বলেছি’ বলে ফেলে লজ্জা পেয়ে (এবং বোধহয় মনে মনে ‘থুক্কু’ বলে) আবার বললেন, ‘আমি পূর্বেই বলেছি…’। ‘বিয়ে’ শব্দটি এঁরা অপছন্দ করেন, এঁরা বোধহয় মনে করেন ‘বিবাহ’ একটি গুরুতর ব্যাপার, ‘বিয়ে’ সে তুলনায় হালকা। এঁরা কেউ ‘বছর’ লেখেন না, লেখেন ‘বত্সর’। একটি হাস্যকর শব্দ এঁদের খুব প্রিয়, সেটা হলো ‘অত্র’। ‘এখানে’ বা ‘এই’ লিখলে খেলো হয়ে যায় এমন ধারণা থেকেই বোধহয় বহুকাল আগে থেকে অপ্রচলিত ‘অত্র’ শব্দটিকে আজকাল ব্যবহার করা হয়। আধুনিককাল পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি এমন আরও একটি পরিত্যক্ত শব্দ ‘বিধায়’। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যদি কখনো ‘বিধায়’ লিখতেন, তবে তাঁকে উপহাস সহ্য করতে হতো। অথচ এখন আমাদের দেশে ‘বিধায়’ শব্দটি যেন শত শত লোককে পেয়ে বসেছে।
ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে আমাদের দেশে আরও একটি রহস্যময় বিষয় এই যে কোনো শব্দ হয়তো দীর্ঘদিন ঠিকমতো ব্যবহার করা হচ্ছে, তারপর কেউ অজ্ঞতার কারণে শব্দটিকে অশুদ্ধভাবে ব্যবহার করল এবং তারপরই দলে দলে লোক নির্বিবাদে সেই ভুলের অনুকরণ করে চলল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ‘মূল্যায়ন’ এমন একটি শব্দ। শব্দটির অর্থ ‘মূল্যবিচার করা’ বা ‘মূল্য কত তা নির্ধারণ করা’। এই অর্থেই দীর্ঘকাল শব্দটি ব্যবহার করা হতো। হঠাত্ কিছুদিন হলো দেখা যাচ্ছে, অনেকেই ‘মূল্য দেওয়া’ বা ‘গুরুত্ব আরোপ করা’ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করছে (যেমন, ‘সিনিয়র নেতাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বলে তাঁরা ক্ষুব্ধ’)।
আর একটি অদ্ভুত ভুল আমরা অহরহ দেখি, বলি, কিন্তু সে সম্বন্ধে চিন্তা করি না। সেটা হলো ‘ডান-বাম’ঘটিত ভুল। ‘বামপন্থী’, ‘বাম রাজনীতি’ ইত্যাদি চলে, কিন্তু বাংলা কথ্য ও লেখ্যভাষায় ‘বাঁ দিক’ সব সময়েই ‘বাঁ দিক’, কদাপিই ‘বাম দিক’ নয়। ‘ডান’ শুদ্ধ ‘ডানদিক’ বললে, কিন্তু দিকের নাম হিসেবে শুধু ডান বললে (যেমন ‘আমি এখন ডানে যাব’) ডান ভুল। বলা উচিত, ‘আমি এখন ডাইনে যাব’। ‘ডাইন’ একটি পুরোপুরি শুদ্ধ কথ্যভাষার শব্দ।
বহু বছর আগে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ইংরেজি ‘যেড’ অক্ষরের মতো উচ্চারণের জন্য ‘য’ অক্ষরটিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল (যেমন ‘নামায’ ‘ফরয’ ‘জানাযা’ ইত্যাদি), কিন্তু তাতে সমস্যা আরও জটিল হয়েছিল। কারণ বহু আগে থেকে বহু বহু বাংলা শব্দ ‘য’ হুবহু ‘জ’-এর উচ্চারণে স্থায়ীভাবে অবস্থান করছিল। যেমন—এই ‘যেমন’ শব্দটিই দেখুন। তা ছাড়া ‘যে’ ‘যদি’ ‘যিনি’ ‘যত’ ‘যত্ন’ ‘যুদ্ধ’ ইত্যাদি শব্দের ‘য’ কি বদলানো সম্ভব? পক্ষান্তরে আমাদের দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বহুলোকই ‘জ’ আর ‘য’-এর ভেদাভেদ না করে সবই একইভাবে ইংরেজি ‘জেড’-এর মতা করে উচ্চারণ করেন।
পৃথিবীর অনেক ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষার লেখ্যরূপ কথ্যরূপকে বিধৃত রাখতে পারে অনেক বেশি, তবুও বেশ কিছুটা গরমিলও থেকে যায়। কারণ পৃথিবীর কোনো ভাষার লেখ্যরূপই ক্যাসেট-রেকর্ডার নয়। ভাষার ধ্বনিরূপ আর লিপিবদ্ধ রূপের মধ্যে যেটুকু গরমিল থাকে, পাঠক তা নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি অনুসারে পূরণ করে নেন। কিন্তু পাঠকে পাঠকে জ্ঞান-বুদ্ধির গরমিল থাকলে?
বাংলা বানান বদলে এবং অনবরত হসন্তচিহ্ন ব্যবহার করে বাংলা ভাষার ধ্বনিরূপকে আরও ভালোভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখা যায়, কিন্তু তাতে উপকার যা পাওয়া যাবে, আয়াস-আয়োজন করতে হবে তার চেয়ে বেশি। তার চেয়ে বড় কথা, নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা সাহিত্যের হাজার হাজার মূল্যবান বই দুষ্পাঠ্য হয়ে যাবে। আমরা কেউ-ই অবশ্যই তা চাই না।
এ প্রসঙ্গে বাংলা কথ্যভাষার লিপিবদ্ধ রূপ-সংক্রান্ত একটি মজার রহস্যের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সাধুভাষার ক্রিয়াপদের বানানগুলো দেখুন: ‘হইল’ ‘করিল’ ‘বলিল’ ‘দাঁড়াইল’ ‘ধরিল’ ইত্যাদি—কোথাও কোনো ও-কার নেই। কথ্যভাষার লিপিবদ্ধরূপে এগুলো হয়ে গেল ‘হল’ ‘করল’ ‘বলল’ ‘দাঁড়াল’ ‘ধরল’ ইত্যাদি—এগুলোতেও কোথাও ও-কার নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও কথ্যভাষায় লেখার সময়ে ক্রিয়াপদগুলো এভাবেই লিখতেন। কিন্তু তারপরই বড় বড় লেখক লিখতে শুরু করলেন (এখনো অনেকে লেখেন): ‘হলো’ ‘করলো’ ‘বললো’ ‘দাঁড়ালো’ ‘ধরলো’ ইত্যাদি। এই ও-কারগুলো ঢুকল কীভাবে? বানানকে উচ্চারণের অনুরূপ করার জন্য? তাহলে তো আধাখেচড়াভাবে শুধু শেষ অক্ষরে ও-কার না দিয়ে পুরোটাকেই উচ্চারণের অনুরূপ করা উচিত ছিল, ‘হোলো’ ‘কোরলো’ ‘বোললো’ ‘ধোরলো’ ইত্যাদি!
এসব না করে পাঠকের জ্ঞান-বুদ্ধির ওপর আস্থা রেখে ক্রিয়াপদগুলোর সহজ সরল ‘হল’ ‘করল’ ‘বলল’ ‘মারল’ ‘বসল’ ইত্যাদি বানানেই ফিরে যাওয়া বেশি সুবিধাজনক নয় কি?
তবে, আরও সহজবোধ্য হয় বলেই কয়েকটি শব্দে ও-কার লাগানো যেতে পারে। যেমন—‘যাই হোক, আমি তো আপনারই মতো রবীন্দ্রনাথের মতো সমর্থন করি’—এই বাক্যটিতে ‘হোক’ ‘তো’ ‘মতো’ শব্দগুলোর অর্থ ও-কারের কারণেই স্পষ্ট।
মাতৃভাষার ব্যাপারে যাঁরা ভুল দেখেও দেখেন না, প্রতিবর্ণীকরণের ভুল যে তাঁরা একেবারেই গায়ে মাখবেন না এবং একজনের ভুল যে ১০জনে অনুকরণ করতে থাকবেন, তা বলাই বাহুল্য। কোনো বড় শহরের কোনো এলাকার নামের অংশ হোক অথবা সমচতুর্ভুজ বা বর্গক্ষেত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ হোক, জনসাধারণ সহজেই উচ্চারণ করত ‘স্কোয়্যার’। কিন্তু বাংলাদেশে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর আগে যেদিন নিজের নাম ঘোষণা করল ‘স্কয়ার’, সঙ্গে সঙ্গে শত শত লোক প্রশ্নমাত্র না-করে ‘স্কোয়ার’ ভুলে গিয়ে ব্যবহার করে চলেছে ‘স্কয়ার’!
কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানকে ভাষাবিষয়ক অনেক কিছুরই অভিভাবক বলা যায়, সেই প্রতিষ্ঠানটি নিজের নামের প্রতিবর্ণীকরণ কীভাবে করেছে! প্রতিবর্ণীকরণের মূলকথা হলো: এক ভাষার শব্দের ধ্বনিরূপকে অন্যভাষার অক্ষরে ধারণ করা। বাংলা শব্দ ‘এক’ আমরা লিখি ‘এক’, কিন্তু উচ্চারণ করি ‘য়্যাক’—সবটাই বাংলা ভাষার মধ্যে, বাংলা ভাষার নিজস্ব রীতিতে। ইংরেজি ভাষায় মূলে ‘য়্যাক’ ধ্বনি থাকলে প্রতিবর্ণীকরণে আমাদের ‘অ্যাক্’ই লিখতে হবে, কোনো মতেই ‘এক’ নয়। তাহলে ‘বাংলা একাডেমী’ ‘একাডেমী’ কেন? ‘বাংলা অ্যাক্যাড্যামি’ নয় কেন? অতীতের পণ্ডিতদের ভুল বজায় থাকতে দিয়ে তাঁদের সম্মানরক্ষা করা হয় না, বরং অসম্মানই জানানো হয় এবং বর্তমান প্রজন্মকেও ভুল শেখানো হয়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আমরা কথা বলার সময়ে অনেক ইংরেজি শব্দ এত বেশি ব্যবহার করি যে শব্দগুলো প্রায় বাংলাই হয়ে গেছে। সেইসব শব্দের ধ্বনিরূপ লিপিবদ্ধ করার সময়ে অনেক শব্দের বেলায় আমরা ‘এ্যা’ ব্যবহার করি, যা নিতান্তই ভুল। আমাদের বোঝা দরকার যে প্রত্যেক ব্যঞ্জন অক্ষর উচ্চারণ করতে হলে সেই সঙ্গে ‘তা’ উচ্চারণ করতেই হবে। আমরা যখন ‘ব্যাগ’ ‘ব্যাট’ ‘ফ্যান’ লিখি, তখন যে য-ফলা আ-কার লাগাই তা ‘ব’ অথব ‘ফ’-এর সঙ্গে নয়, বরং ‘অ’-এর সঙ্গে। তাই ব্যঞ্জনবর্ণ না-থাকলে য-ফলা আ-কার লাগাতে হলে তা লাগাতে হবে এই ‘অ’-এর সঙ্গেই। যেমন, অ্যাডমিশান, অ্যালিউমিনিয়াম, অ্যালটেমন্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট, অ্যাডভোকেট, অ্যামিবউল্যান্স্ ইত্যাদি।
নানারকম ছোট ছোট ভুলের খতিয়ান আরও বাড়ানো যায়। আসলে দেখাদেখি অনুকরণ করে কিছু শেখার বিপদ এমনিই। খোদ আমাদের রাষ্ট্রের নামটাই ধরুন। দেশের অনেক শিক্ষিত লোকও আমাদের রাষ্ট্রের নাম অবলীলাক্রমে লেখেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’, যদিও প্রকৃত নাম হলো ‘বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্র’। বাংলাদেশ শব্দটির আগে বিশেষণের মতো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বসানোর কোনো কারণ আছে? প্রায় যেন ‘কালা জাহাঙ্গীর’ ‘গালকাটা কামাল’ ‘লম্বু রশিদের’ মতো, শনাক্তকরণের জন্য বিশেষণ দরকার! অতীতে এক সময়ে পক্ষ শনাক্তকরণের প্রয়োজনে লেখা হতো ‘বলশেভিক রাশিয়া’ বা ‘জারতন্ত্রী রাশিয়া’, ‘কমিউনিস্ট চীন’ বা ‘জাতীয়তাবাদী চীন’, কিন্তু ‘বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্র’ বললেই তো পরিষ্কার কোন দেশ সম্বন্ধে বলা হচ্ছে। ওপার বাংলা প্রথম থেকেই ‘পশ্চিমবঙ্গ’। আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, বাংলায় আমাদের সংবিধান ছাপানোর সময়ে আমাদের রাষ্ট্রের নাম যেন ছাপানো হয় ‘বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্র’। এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার বিষয়।
বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্র সরকারের উচিত, নিজের শত শত অফিসের প্রধান ফটকের ওপর উঁচু করে লাগানো শত শত নামফলক পাল্টে দেওয়া। এবং সেই সঙ্গে ‘মন্ত্রণালয়’ শব্দটিও বদলে ফেলা। কারণ ‘মন্ত্রণালয়’ শব্দটিও ভুল। ‘আলয়’ শব্দটির অর্থ প্রধানত ‘নিবাস’, একটি নিরেট তৈরি বাড়ি, সেকালের রাজাদের শলা-পরামর্শ করার জন্য যেমন একটি নির্দিষ্ট নিরিবিলি ঘর বা বাড়ি ছিল। মিনিস্ট্রি একটি প্রশাসনিক-সাংগঠনিক ব্যবস্থা, কোনো ‘আলয়’ নয়। পশ্চিমবঙ্গে মিনিস্ট্রি শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘মন্ত্রক’ লেখা হয়, কিন্তু এখানেই আমাদের কর্তাব্যক্তিদের অহমিকা প্রধান বাধা—‘কী! আমরা পশ্চিমবঙ্গের অনুকরণ করব! ওদের পারিভাষিক শব্দ ধার করব!’ অথচ একই ভাষার পারিভাষিক শব্দ তো একই হবে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলায় আমাদের উচ্চশিক্ষার পাঠ্যবইগুলোতে যে শত শত পারিভাষিক শব্দ দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহূত হয়ে আসছে, সবই পশ্চিমবঙ্গে নির্ধারিত এবং উদ্ভাবিত (কারণ কাজটা প্রথমে পশ্চিমবঙ্গেই শুরু হয়েছিল)। শত শত পারিভাষিক শব্দ ধার নিতে আপত্তি নেই, শুধু ‘মন্ত্রক’ শব্দেই আমাদের আপত্তি!
পক্ষান্তরে ‘সচিবালয়’ শব্দটি কিন্তু সঠিক, কারণ সচিবেরা সত্যিই স্থানিক একটি বাড়িতে উপস্থিত থাকেন এবং কাজ করেন।
সচরাচর যে ভুলগুলো চোখে পড়ে এবং সেজন্য অস্বস্তি বোধ করি, সেগুলোর দিকে সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। এগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হলে ভালোই হবে। যদি ধৃষ্টতা প্রকাশ করে থাকি, তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১২, ২০১০
Leave a Reply