হাজার রকমের গালাগালি স্টকে থাকতে রিকশাওয়ালা মনসুর আলী যেদিন ভাড়া নিয়ে বাগিবতণ্ডার চরম পর্যায়ে কোট-প্যান্টধারী একজন সুবেশ আরোহীকে মা-বোন না তুলে অতর্কিতে মূর্খ বলে গাল দিয়েছিল, সেই থেকে…পথেঘাটে আকছার ঝগড়াঝাঁটির মোক্ষম মুহূর্তে ‘মূর্খ’টা যে গণমানুষের মুখে তাদের অজান্তেই আসন পাকা করে ফেলেছিল—তার পেছনের ঘটনা খানিকটা বেদনাবিধুর, কারও কারও কাছে ইন্টারেস্টিং।
রিকশাওয়ালা মনসুর আলী জামতলা থেকে সাত রাস্তার মোড়ের বাসস্ট্যান্ডে খেপ দিতে রাজি হয়েছিল আগেভাগে ভাড়া সাব্যস্ত না করেই। আরোহীকে তার পছন্দ হয়েছিল। পরনে ভালো জামাকাপড়, শুধু ভালো না, বেশ ভালো। কোট-প্যান্ট, আবার গলায় লটপটে টাই, হাতে পাতলা ব্রিফকেস। আরোহী ভাড়া জানতে চাইলে সে বলেছিল, ‘ইনসাফ কইরা দিয়েন।’ লোকটা কথা বাড়ায়নি, ছোটো একটা লাফমতো দিয়ে সিটে বসে কোলের ওপর ব্রিফকেস রেখে বলেছিল, ‘চালাও’। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যেন খুব তাড়াহুড়োয় আছে এমন ঢঙে লোকটা ১০ টাকার একটা ময়লা নোট বাড়িয়ে দিতে, মনসুর আলী বলেছিল, ‘এইডা কী দ্যান?’ বলার ধরনটা খারাপ, আরোহীর না বোঝার কথা নয়। সে গরম হয়ে বলেছিল, ‘ঠিকই দিছি, ইনসাফ কইরা দিছি।’
‘বিশ টেকা দ্যান।’
‘মাগনা!’
‘মাগনা অইব ক্যান? খাটনি খাইটা আনছি। মাগনা কন ক্যারে?’
‘নিলে নে, না নিলে ভাগ।’
‘ভাগুম মাইনে! উচিত ভাড়া থুইয়া যান।’
‘খানকির পুতে দেখি রোয়াব করে!’
‘হেইই, গাইল পাইড়েন না। বিশ টেকা থোন।’
‘আয় নে, তোর বিশ টেকা নে।’
গালটা ঠিক পাতানো ছিল না, তারপরও চড়টা পড়ে পুরো পাঁচ আঙুলে। রিকশার হ্যান্ডেল থেকে ডান হাতটা তুলে গালচাপা দিতে দিতে মনসুর আলী চোখেমুখে অন্ধকার দেখছিল। পরমুহূর্তে চোখ না খুলেই সে অন্ধের মতো এক পা বাড়িয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা ঝট করে এক পা পিছিয়েছিল। এদিকে কাছাকাছি দূরত্বে কয়েকজন রিকশাওয়ালা মন দিয়ে ঘটনা অবজার্ভ করছিল। চড়টা মনমতো ও জায়গামতো বসানোর পর লোকটার সন্তুষ্ট হওয়ার কথা, কিন্তু সন্তুষ্টির বদলে সে হঠাত্ পরিস্থিতি প্রতিকূল আন্দাজ করে আরও এক পা পিছিয়েছিল। মনসুর আলী ততক্ষণে চোখ খুলে দুই পা এগিয়েছে। আর, দুই পাশ থেকে দুজন দুজন চারজন রিকশাওয়ালাও তিন-চার পা এগিয়ে প্রায় বৃত্তাকারে তাকে ঘিরে ফেলেছে। ঠিক এমন সময় রগরগে সম্ভাবনাটাকে একদম বরবাদ করে মনসুর আলী হাতের বদলে মুখ ব্যবহার করে। গলা ছেড়ে, যেন মাথায় তুলে আছাড় মারছে এমনভাবে বলে, ‘মূর্খ’।
ফল যা পাওয়া গিয়েছিল, অবিশ্বাস্য। লোকটা ভীষণ চমকে একনজর এদিক-ওদিক চোখ ফেলে, বিশেষ করে মুখোমুখি স্তব্ধ পাথর মনসুর আলীর দিকে তাকিয়ে দুটি দশ টাকার নোট মাটিতে ফেলে যা করেছিল তা বলার না। একছুটে সে ডান দিক থেকে আগুয়ান রিকশাওয়ালা দুজনের ফাঁকগলে একটা চলন্ত বাসের হাতল নিশানা করে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় শরীরটাকে শূন্যে লাড্ডু পাকিয়ে হাতলটা ধরে ফেলেছিল।
বিচিত্র প্রেরণায় মনসুর আলী দ্বিতীয়বার স্বগতোক্তির গলায় বলে উঠেছিল, ‘মূর্খ’।
রিকশাওয়ালা চারজন। যারা তাদের নিশপিশ হাত নিয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঘটনার নাটকীয়তায় থমকে গেল। ঘটনা তারা যা দেখল তা বলার অপেক্ষা রাখে না, খুবই মজাদার, বৈচিত্র্যময়, সন্দেহ নেই। কিন্তু মুখের বদলে হাত ব্যবহারের মজাটা যে আলাদা—কে না জানে! এতগুলো হাত! হাতের সঙ্গে না হয় মুখও চলত—অসুবিধা তো ছিল না। কিন্তু এ বেকুব খালি খালি মূর্খ বলল কোন আক্কেলে! বলল তো বলল, যেন কামান দাগাল মুখ দিয়ে।
মুহূর্তের প্রতিক্রিয়ায় তারা এত দূরই ভাবল। একটু পর তাদের মাথা চক্কর খেল। মূর্খ! এটা একটা গালি হলো—তাও এমন একটা বিরাশিসিক্কা থাপ্পর খাওয়ার পর! কিন্তু গালির চেয়েও যে বেশি, তার প্রমাণ তারা নিজেদের চোখে দেখেছে, যদিও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তাদের কারও কারও মনে হলো, মার যদি দিত শালাকে সবাই মিলে আচ্ছাসে, তাহলে কি হাতের সুখটা চোখে দেখার সুখের মতো হতো? কোনো সুরাহায় পৌঁছাতে না পেরে তারা মনসুর আলীর শরণাপন্ন হয়েছে।
‘আর গাইল পাইলি না!’
‘কী কামে?’
‘তোরে চটকনা দিল আর তুই কইলি…’
‘মূর্খ’।
‘তুই কি ইসকুলের মাসটের?’
‘মাসটের হমু কিয়ের লেইগা?’
‘কইলি যে।’
‘মূর্খ?’
‘হো, হো, একবার তো কইলি, গলা ফাডাইয়া কইলি, আমরা ব্যাকে শুনছি, আর কস ক্যান? আসল কতা ক।’
‘কী কমু?’
‘আর গাইল পাইলি না!’
‘কী কামে?’
‘দূর হালা।’
পরদিন দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমটা নয়াটুলী বাজারে। জেলা শহরের মোটামুটি গণ্যমান্য রিটায়ার্ড মেহদি রাঙানো সাব রেজিস্টার গোফরান কাজিকে এক ভাগা শরপুঁটি নিয়ে খ্যাঁচাখেঁচির একপর্যায়ে অতর্কিতে গালটা দেয় একজন মাছবিক্রেতা—মানে মূর্খ বলে। দেখতে বেশ বড়সড় ফিকে লালচে রঙের শরপুঁটিগুলোকে দেশি বলে মানতে রাজি ছিলেন না গোফরান কাজি। যতই তিনি ওগুলোকে চায়নিজ বলে দাবি জানাচ্ছিলেন, মাছওলা কুদরত ততই ঘাড়-মাথা-হাত নেড়ে প্রতিবাদ করছিল। শেষমেশ…। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে শহরের ভদ্র আবাসিক এলাকা মতিনগরের এক গলিতে। গুয়েঠাসা ট্যাংকি থেকে বালতি বালতি গু গলির ড্রেনে ফেলার প্রতিবাদে মারমুখো কলেজশিক্ষক আফজাল হোসেনকে গালটা ছোড়ে জমাদার ভটা না কটা।
১০-১৫ দিনে পরিস্থিতি বাড়াবাড়ির দিকে। যাকে-তাকে যখন-তখন মূর্খ বলাটা একরকম রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গেল। মুশকিল হলো, শিক্ষিতরা তো অশিক্ষিতদের মূর্খ বলে তৃপ্তি-আনন্দ কোনোটাই পায় না, পায় লিটারেলি যারা মূর্খ তারাই। শুধু যে তৃপ্তি, তা না, বরং কয়েকটা ঘটনার বিবরণ থেকে দেখা যায় হাত-পায়ের সুখ বলতে যা বোঝায়, তা যেন পুরোপুরি উসল করে নিচ্ছে। নাক-মুখ ফাটানো ঘুসিতে বা শরীরের সব জোর ঝেড়ে পাছায় কষে বসানো লাথিতেই যা আশা করা যায়। আবার অন্যরকম ব্যাপারও আছে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আর্থিংয়ের কাজ করতে এসে গৃহকর্ত্রীর খবরদারিতে নাজেহাল হয়ে উটকো তর্কে জড়িয়ে লাগামহীন তর্কাতর্কির তুঙ্গ মুহূর্তে ঝপাং করে কথাটা বলে ফেলছে। শঙ্কিত শিক্ষিত গৃহকর্ত্রীর এমন ধারণা হওয়া বিচিত্র নয়, রাসকেলটা একা পেয়ে দিনেদুপুরে সিম্বলিক র্যাপ করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় হাত-পায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্য প্রত্যঙ্গের সুখও বড় একটা উহ্য থাকছে না।
কিন্তু ব্যাপার হলো, যে নিজে আকাট মূর্খ সে অন্যকে, বিশেষ করে শিক্ষিতজনকে মূর্খ বলে মজাটা পাচ্ছে কী করে? কিসের মজা? মানে-টানে বুঝে বলছে, তাই বা কে বলবে! আর বলছে যে, তাও যে যার মতো—মুরখ্অঅ, মুরুক্ষ, মুক্ষ, মুইক্ষ্য, মুইক্ষ্যা। রিকশাওয়ালা মনসুর আলী সেই প্রথমবার ঠিক কী বলেছিল, কেউ নিশ্চিত বলতে পারে না। মনসুর আলীকে খোঁজে কেউ কেউ। যারা জানতে পেরেছে সে-ই আদি ঘটনার হোতা, তারা সম্ভাব্য জায়গায়—রেলস্টেশনে, লঞ্চঘাটে, জামতলায়, সাতরাস্তার মোড়ে তার খোঁজ করে। মনে হয়, সে যেন শহর ছেড়ে অন্য কোথাও গাঢাকা দিয়েছে। হতে পারে, দূরে দূরে ক্লান্তিহীন খেপের পর খেপ মেরে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে স্বরচিত গালাগালে নিত্যনতুন আরোহীদের ঘায়েল করে মৌজে আছে। তাকে পেলে খুব খাতির করে আস্তেধীরে পেট থেকে কথা বের করা যেত—রহস্যটা জানা যেত। স্রেফ একটা মাত্র আওয়াজে বিধ্বংসী ফলাফলের কারণ অনুসন্ধান সহজ হতো।
না পেয়ে, এমনকি সামান্যতম ক্লু খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে ব্যাপারটাকে পাগলামি-ছাগলামি বলে বাতিল করে দেওয়ার চিন্তা মাথায় এলেও মাথাভর্তি উকুনের মতোই তা বিরাজ করে। শহরের গুটিকয় চিন্তাশীল মানে প্রগতিশীল, মানে বামঘেঁষা মানুষজন এ অবস্থায় একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। সামাজিক অসাম্যের প্রতিবাদ হিসেবে, মানে অস্ত্র হিসেবে নিপীড়িত জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। একটু বেশিই সরল ব্যাখ্যা, নাইভ। ব্যাখ্যায় গলদ ধরা পড়ল যখন দেখা গেল নিপীড়িতরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটিতেও হরহামেশা কথাটা ব্যবহার করছে, লাগসই না হলেও করে যাচ্ছে। অল্প দিনে আরও দেখা গেল ব্যবহার মোটামুটি সবাই করছে। মূর্খরা তো শিক্ষিতদের বলছেই, শিক্ষিতরাও মূর্খদের বলছে, মাস্টার ছাত্রকে, ছাত্র মাস্টারকে, উকিল ম্যাজিস্ট্রেটকে, ম্যাজিস্ট্রেট উকিলকে, ভাড়াটে বাড়িওয়ালাকে, বাড়িওয়ালা ভাড়াটেকে, এমনকি প্রগতিশীল তথা বামেরাও ব্যাখ্যায় গলদ নিয়ে তাত্ত্বিক তর্কাতর্কির ফাঁকে আলগোছে রিলিফ হিসেবে একে অন্যকে বলছে।
এতদূর এসে ব্যাপারটা ধীরে ধীরে উত্তেজনার খোলস ছেড়ে রাগ-ঝালমুক্ত হয়ে আপনাআপনি মিইয়ে যেতে থাকে। যত্রতত্র যারতার মুখে বাছবিচারহীন প্রয়োগ হতে হতে শব্দটা অর্থব্যঞ্জনাহীন আপদহীন বাদামের খোসার মতো পড়ে থাকে। মানে, নানা কলরোলে চাপা পড়ে বৈশিষ্ট্যহীন তেজহীন অর্থহীন বাদামের খোসার মতোই পায়ে পায়ে চেপ্টে ধুলোবালিতে একাকার হওয়া ছাড়া তার আর উপায় থাকে না। বাস্তবিকই থাকে না, থাকার কথাও নয়। কারণ বোনজামাই যখন শালাকে, শালা বোনজামাইকে পাল্টাপাল্টি এমনি এমনি উঠতে বসতে বলে, বলতে বলতে হাই তোলে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না ভেতর থেকে প্রেরণা-ট্রেরনা পাচ্ছে না। প্রথম দিকে ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটে যাচ্ছিল—মানে, পরপর ধাপে ধাপে এগোচ্ছিল, তাতে সম্ভাবনা ছিল। রিকশাওয়ালা মনসুর আলী যে এমন প্রাণজুড়ানো প্রেরণায় ‘মূর্খ’টাকে অকথ্য গালি বা ঘুসি হিসেবে কোট-প্যান্টধারীর মুখে ছুড়ে মেরেছিল, তার পেছনে হয়তো একটা কিছু ছিল—হয়তো-টয়তো কী, নিশ্চয় ছিল। এমন বিধ্বংসী বিক্ষোভ, মনে হচ্ছিল না মাথায় তুলে আছাড় মারছে? জুতসই ব্যাখ্যায় খাটানো যায়নি, এই যা। ব্যাখ্যা আবার অঙ্ক কষে নিয়মকানুন মেনে খাটাতে হয়, তারপরও খাটে না সব সময়, তবে ব্যাখ্যাটাকে ব্যাখ্যা না করে যদি…।
আবার এমনও হতে পারে, কিছু না, স্রেফ রগড়। মনসুর আলী তো মনসুর আলীই, রিকশা চালায়, খেপের পর খেপে, সকাল দুপুর রাত। রগড় করলে করতে পারে। চড় খাওয়ার পরও করবে না কে বলবে? করতে তো পারে। শেষমেশ চিনাবাদামের খোসা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১২, ২০১০
debjani
not bad………