বাহান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সূচিত ছাত্র-আন্দোলন, গণআন্দোলনের চালচিত্র কমবেশি আমাদের জানা। কয়েকটি প্রাণের বিনিময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে শহীদ দিবস। একুশের আন্দোলন তৎকালীন প্রদেশব্যাপী জনচেতনা এতটা স্পর্শ করেছিল যে, ১৯৫৩ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি শহীদ দিবস’ হিসাবে পালিত হয়েছে। শুধু শোক প্রকাশ নয়, রাজনৈতিক প্রতিবাদের দিবস হিসাবেও। ক্রমে একুশে হয়ে উঠেছে জাতীয় জীবনে প্রগতিবাদী ও প্রতিবাদী চেতনার ধারক-বাহক। মেডিক্যাল হোস্টেল প্রাঙ্গণে তারা শহীদ মিনার শাসকগোষ্ঠী ভেঙ্গে ফেলা সত্ত্বেও পরবর্তী বছর তিন-চার ঐ স্থানটিই শহীদ মিনারের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। হয়েছে প্রভাতফেরির যাত্রা শুরুর স্থান হিসেবে।
আজ হয়তো অনেকের মনে নেই, আর তরুণ প্রজন্মের জানার কথাও নয় যে, ১৯৫৩ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উদযাপনে যে আদর্শগত আবেগের প্রকাশ ঘটতো এখন তা নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত। রাজনীতি, বিশেষ স্বার্থপর রাজনীতি তাকে গ্রাস করেছে। অনুষ্ঠানের চরিত্রে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে আমরা অর্থাৎ, একুশের আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, হয়তো বা পরবর্তী সময়ের যুক্তিবাদী আরো অনেকের মন তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। জানতে চাইবে, বুঝতে চাইবে, কেন এ পরিবর্তন।
ঐ তেপ্পান্ন সালে প্রথম শহীদ দিবস পালন করতে গিয়ে আবছা ভোরে আমরা খালি পায়ে বাহান্নর দিনটির কথা ভাবতে ভাবতে প্রভাত ফেরিতে যোগ দিয়েছি। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানের মাঝে মাঝে শহীদ দিবসের গান কণ্ঠে নিয়ে শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি হয়ে এগিয়ে চলেছি আজিমপুরে শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। সে গান শুরুতে ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ কিংবা ‘ভুলবো না একুশ ফেব্রুয়ারি’। পরের বছর থেকে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গাওয়া শুরু। কিন্তু কোথাও কোথাও আগের গান দুটোও এসেছে। সে সুরের মায়ায় ঘুম ভেঙেছে আশপাশের মানুষেরণ্ড বারান্দায়, ব্যালকনিতে কখনো ছাদে তারা গভীর মমতায় চেয়ে থেকেছে, মনে হয়েছে মাতৃভাষার সূত্রে সমভাষিক মানুষের সঙ্গে আত্মিক বন্ধন। এরপর মিছিল, শ্লোগান, রাজপথ পরিক্রমা। নতুন ঢাকা পুরনো ঢাকা একাকার। বিকেলে যথারীতি বিশাল জনসভাণ্ড পল্টন ময়দানে আর্মানিটোলা ময়দানে। গোটা দিনটাই যেন ভাষিক জাতীয়তাবোধের সুরে বাঁধা।
এমনি করেই পালিত হয়েছে পঞ্চাশের দশকের শহীদ দিবস। ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উপলক্ষে নানা সংগঠনের তরফ থেকে প্রকাশিত হয়েছে শহীদ দিবস স্মরণিকা। সূচনায় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ও মোহাম্মদ সুলতানের পুঁথিপত্র প্রকাশিত সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই শুরু। বছরের পর বছর প্রকাশিত স্মরণিকা তৈরি করেছে একুশে সাহিত্য। গণতান্ত্রিকতা ও প্রগতিবাদিতায় চিহ্নিত ঐসব সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে প্রচলিত ধারা থেকে বাঁক ফেরা চরিত্র। ক্রমে সেই ধারার বিকাশ।
শহীদ দিবস উদযাপনের এই ধারা চলেছে দীর্ঘদিন। এরমধ্যে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচনা উপলক্ষে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু শহীদ দিবসের উদযাপন বন্ধ হয়নি। বরং তা এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। শুদ্ধ আবেগে ধৃত মন নিয়ে খালি পায়ে ফুল হাতে উষার স্নিগ্ধ আবহে যেন এক পবিত্র সমাপন।
ঐ বছরই জাতীয় পর্যায়ে প্রথমটির কাছাকাছি জায়গায় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনণ্ড সে বছরই সেখান থেকে একইভাবে প্রভাতফেরি এবং দিনভর মিছিলে মিছিলে ভিন্ন এক শহরের অভিজ্ঞতা মনে ধরে ঘরে ফেরা। এরপর এক সময় শহীদ মিনার নির্মাণণ্ড শহীদ দিবসে মিনারের বুক ছেয়ে গেছে নানারঙা ফুলে। সেই ভোর, সেই প্রভাতফেরি, সেই আজিমপুর কবরস্থান।
কিন্তু শহীদ দিবস ছাড়াও শহীদ মিনারের চত্বরে নানা উপলক্ষে প্রতিবাদী সমাবেশ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা দেখা গেছে মিনার চত্বর থেকে। শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে আন্দোলনের, প্রতিবাদের প্রেরণা, কিন্তু সেসব জাতীয় জীবনে ভিন্ন এক প্রয়োজনে। তবু শহীদ দিবস একইভাবে পালিত হয়েছে।
এরপর ঠিকই একদিন শহীদ দিবসের আনুষ্ঠানিক রূপ পালটে গেল। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিপরীতে ভোরের অনুষ্ঠান চলে গেল মধ্যরাতে। প্রভাতফেরির ঐতিহ্য হল বিলুপ্ত। গোটা অনুষ্ঠান চলে গেল রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। শুরু হল রাজনৈতিক দলের খেয়োখেয়ি, অশুভ প্রতিযোগিতা। আনুষ্ঠানিকতা স্বভাবতই হয়ে উঠল শহীদ দিবস পালনের প্রধান চরিত্র। পরিবর্তনের প্রথম বছরটিতে শহীদ মিনার প্রত্যক্ষ করেছে মধ্যরাতের ভয়াবহ অনাচার। প্রভাতী স্নিগ্ধতার বদলে মধ্যরাতে অস্বাভাবিক আবহ। সে এক কলংকিত অধ্যায়। পরিবর্তনের হাত ধরে শহীদ দিবসের রাত শেষে সকালটা এল ছাত্র সাধারণ, জনসাধারণের অধিকারে। ফুল হাতে মিছিল অথবা খালি হাতে মিছিল শহীদ মিনারে এসে গতানুগতিক দায় শেষ করে। সেই আবেগ, সেই শুদ্ধতার প্রকাশ অনেকটাই অবস্থার কারণে আগের মতো হয়ে ওঠে না। যেন এক দায়সারা কর্তব্যের সমাপন। কণ্ঠে নেই গান আর শ্লোগান। স্মরণিকা প্রকাশের আবেগও শেষ হয়ে গেছে।
অবশ্য অন্যদিকের প্রাপ্তি নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে চলে প্রবন্ধ পাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তার চেয়েও আকর্ষণীয় অমর একুশের বইমেলা। বইপ্রেমী মানুষের কিংবা নিছক কৌতূহলী মানুষের পদচারণায় মুখর একাডেমী প্রাঙ্গণ। পায়ে পায়ে ধুলো ওঠে, কখনো সে ধুলো চাপা পড়ে পানির ঝাপটায়, অনেকে আসেন চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হবে তেমন আশায়।
কিন্তু বইমেলার স্থান সংকীর্ণ বলে তা অনেকের জন্য, বিশেষত বয়স্কদের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়ে ওঠে। নতুন বই দেখার আনন্দ তখন আর আনন্দ যোগায় না। তবু সময়ের ধারায় বইমেলাও হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আরেক অধ্যায়। তবে বিষয়টা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে অর্থাৎ একে আরো স্বচ্ছন্দ পদচারণায় আনন্দবহ করে তোলার ভাবনা। প্রশস্ত প্রাঙ্গণে সহজ চলাফেরা কার না ভালো লাগে।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ ছাড়াই প্রথমপর্বের একুশে, তার উদযাপন এখনো আমাকে পঞ্চাশের দশকের দিনগুলোতে নিয়ে যায়, স্মৃতিকাতর করে তোলে। অতীত মানেই উপভোগ্য এমন ধারণায় নয়। পূর্ব উদযাপনের যে ছোট্ট ছবিটা এখানে এসেছে তাতে কিন্তু বুঝতে কষ্ট হয় না একুশের সেই প্রাণ, সেই সজীবতা, সেই আবেগের মুগ্ধতা নিয়ে সূর্যহীন ভোরে পায়ে পায়ে চলা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সে একুশে এখন শুধুই স্মৃতি। ভালো-মন্দের হিসাব না করে একুশে এলে এমনটাই ভাবি। আর তখন এই মধ্যরাতের রাজনৈতিক একুশে পালনের ধারাটাকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। বায়ান্নর একুশে রাজনীতিকদের নয়, ছিল ছাত্রদের, তরুণদেরণ্ড এক কথায় তারুণ্যের সমাপন এবং অর্জন।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারী ০৫, ২০১০
Leave a Reply