দেখতে দেখতে তিন দিন পার হয়ে গেলো মেলার। বাংলা একাডেমীর ভেতর প্রাঙ্গণ ও সামনের রাস্তার উভয় পাশে বসেছে একুশের প্রাণের মেলা। পহেলা ফেব্রুয়ারি বিকেলে এই মেলার উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই রেওয়াজ চলছে, বলা যেতে পারে, গত দুই দশক ধরে। মাঝখানে অনেকে প্রস্তাব করেছিলেন বিশিষ্ট ও বয়োজ্যেষ্ঠ কোনো লেখককে দিয়ে মেলা উদ্বোধন করার কথা। তাঁদের বিবেচনা মূলত মেলাকে রাজনীতিমুক্ত রাখা। তবে তা বাস্তবায়িত হযনি। অদূর ভবিষ্যতে হবে বলে মনেও হয় না। কারণটাও বোধগম্য। বাংলাদেশ ও বাঙালির সৃষ্টিশীলতার প্রতীক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য। আর জাতীয়ভাবে সমূহ গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটিরই মুখ্য ব্যবস্থাপনা আর প্রকাশক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় প্রতিবছর মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে আমাদের এই জাতীয় গ্রন্থোৎসব। একারণে এই আয়োজনের তাৎপর্যই আলাদা। লেখক প্রকাশক সবাই চায় এই মেলায় সরকার ও জনগণ সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে সম্পৃক্ত হোক। সরকার প্রধানরাও এই মেলায় এসে আনন্দিত হন, মেলাও সর্বাধিক প্রচার ও মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে পড়ে, ফলে আমাদের সৃষ্টিশীল অভিব্যক্তিরও তুঙ্গীয় বিকাশের পথ প্রশস্ততর হয়। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় বিবেচ্য। তিনি আমাদের দেশের একজন মননশীল লেখক। প্রতি মেলায় তাঁর সুবৃহৎ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে থাকে যা আমাদের সমাজ ও দিন বদলের জন্য নির্দেশনামূলক। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বইয়ের বৈচিত্র্য ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথাও বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে উন্নীত করার পরিকল্পনাও তাঁর সরকারের রয়েছে। বিষযটি যথাযথ গুরুত্বের দাবি রাখে। এ কাজটি করতে হলে যে উদ্যোগ নেয়া জরুরি তার জন্য প্রথম পর্যায় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন। তা না হলে এটি কথার কথা হয়ে থাকবে।
আমরা প্রায় এক দশক আগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ শুরু করেছ্ি। কিন্তু নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সরকারী অনীহার কারণে এই উদ্যোগটি এখনো ফলপ্রসু হয়নি। কাজেই কম পরিকল্পনা ও বেশি বাস্তবায়নই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মাতৃভাষা সংরক্ষণ, তরুণ লেখকদের গুরুত্বদান এবং সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয় স্থাপনের কথাও বলেছেন। আমরা এই বলয়ের মধ্যে লেখকদের জন্য একটি পৃথক লেখক ভবন ও কমপ্লেক্স স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা আবার উত্থাপন করছি। সরাসরি ফিরে আসা যাক মেলা প্রসঙ্গে। আমরা যেমনটি ধারণা করেছিলাম মেলা ততখানি সম্প্রসারিত হয়নি। রাস্তায় নেমেছে, তবে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রবেশ করেনি। ভবিষ্যতে ঢুকতে হবে অবশ্যই। কেননা আগামী বার এবারের মতো ৫০৫ স্টল দিলে চলবে না, তার সংখ্যা বাড়াতে হবে। দু’দিন মেলায় ঘুরে মনে হয়েছে মেলা ভেতরের চেয়ে বাইরে বেশি জমজমাট। মাঝের আইল্যাণ্ডে দর্শক-ক্রেতারা চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, চলছে সুরের মুর্ছনাও। তবে অনেক প্রকাশককে দেখা গেলো এখনো আশাহত। তারা অনেকেই স্টল বরাদ্দ পেয়েও অধিকার করতে পারেননি। কে কারা তাদের জায়গায় স্টল বানিয়ে কর্তৃপক্ষকেই খানিকটা বোকা বানিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ দখল-সংস্কৃতি এখনো বন্ধ হয়নি। বাংলাবাজার ভিত্তিক একজন প্রকাশক জানালেন, বরাদ্দকৃত জায়গা অন্য কেউ দখল করায় তিনি আজ পর্যন্ত স্টল বানানোর কাজে হাত দিতে পারেননি। ভেতরেও কেশকিছু স্টল অনির্মিত রয়েছে।
পত্রিকায় দেখলাম, এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং মহাপরিচালকও। তৃতীয় দিন পর্যন্ত টাস্কফোর্সও কাজ শুরু করতে পারেনি। তবে আমার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পুরো প্রথম সপ্তাহ ধরে এই অস্থিরতা ও রদবদল চলবে। মেলা স্থিত হবে দ্বিতীয় সপ্তাহে। তখন অন্তত এক-তৃতীয়াংশ বই মেলায় এসে পড়বে। এখন আসছে দু’একটা করে, তখন আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে। বই প্রকাশিত হবে শেষ দিন পর্যন্ত। তবে কোনটি সঠিক বই তা বেছে নেয়া পাঠকের পক্ষে সুকঠিন হয়ে পড়বে। রাস্তার স্টলের নিরাপত্তা নিয়েও মালিকরা ভাবিত। দুপুর তিনটার পূর্ব পর্যন্ত রাস্তায় যানবাহন চলাচল করে। এটি নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি অবশ্যই। এর একটি বিহিত করা আবশ্যক। একমাস এই রাস্তায় অনাবশ্যক যানবাহন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। এ কদিনে মেলায় খুব বেশি লেখকদের আনাগোনা ছিল না। তবে জমজমাট মনে হয়েছে লিটল ম্যাগ চত্বর। লিটল ম্যাগের জন্য আলাদা স্টল দিয় লেখকদের বসার জন্য জায়গা করা হয়েছে প্রশস্ততর। তবে লেখকরা বেশি ভিড় করছেন যে সব টিভি সরাসরি সম্প্রচার করছে সেইখানে। লেখক-পাঠককে মেলার সর্বত্র আসা-যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া জরুরি। মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপও অনতিবিলম্বে শুরু করা ও চালু রাখা অত্যাবশ্যক। তা না হলে এটি অন্যান্য বারের মতো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যা-হোক, আমার তো মনে হয়েছে, যে কয়েকটি আপাত অপূর্ণতার কথা বলেছি তা বাদ দিলে মেলা অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারী ০৫, ২০১০
Leave a Reply